স্বাধীনতার আগের বছর এই কোলকাতা তথা সম্পূর্ণ বাংলায় হিন্দুদের প্রতি সরকারের প্রশ্রয়ে ঘটে গিয়েছিল এক নিদারুণ বিপর্যয়।কি ছিল সেই বিপর্যয় বা কেমন ছিল তার রূপ,সেই বিষয়ের ওপর এই ধারাবিবরণী।এই ধারাবিবরণী লেখার আগের কিছু কথা জানানো দরকার যেমন,এই দিন মনুমেন্ট ময়দানে মুসলিম লিগ একটি সভা ডেকেছিল।এই দিন মিটিং ও ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষিত হয়।সেই উপলক্ষে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘আমরা নীতিশাস্ত্র আলোচনা করতে যাচ্ছি না। কি করতে হবে মুসলমানরা খুব ভাল করেই জানে।’ অর্থাৎ জিন্নাহ্ আগেভাগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন দাঙ্গার বিষয়ে।বাংলার বিভিন্ন মুসলিম পদাধিকারীগণও বিভিন্ন লিফলেট ছাপিয়ে আগামী দিনের হিন্দুদের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রাখছিলেন। ‘মুগুর’নামক একটি মুসলিম প্রচারণাপত্র লিখল ‘প্রত্যক্ষ লড়াই এর দিন এসে গেছে,যা মুসলিম জাতির মহত্তম কামনা তোমাদের জন্য স্বর্গের উজ্জ্বল দুয়ার উন্মুক্ত করা হয়েছে।এসো হাজারে হাজারে প্রবেশ করি।এসো আমরা সবাই মিলে বিজয়োল্লাস করি পাকিস্তানের, বিজয়োল্লাস করি মুসলিম জাতির ও বিজয়োল্লাস ঘোষণা করি সেই বাহিনীর যাঁরা জিহাদ ঘোষণা করেছে।’এইমত প্রচারণা চলার প্রথম হিন্দু জবাব প্রকাশিত হয় ১১ আগস্ট,১৯৪৬-‘বসুমতী’ পত্রিকার মাধ্যমে।জবাবটি ছিল মোটামুটি এইমত,’মুসলিম লীগওয়ালাদের জেনে রাখা উচিত হবে যে কেবল হুমকিতে কাজ হবেনা।হিন্দুরা হাসতে হাসতে বুলেট ও ছুরির মোকাবিলা করতে জানে।তাঁরা এক মূহুর্তের জন্যও পরাজয় মেনে নেয়না।লীগ আমাদের দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে পারে কিন্তু তা শুধু তাঁদের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।’এইভাবে তর্ক বিতর্ক চলছিলই আর তার মধ্যে সরকারি সহায়তায় তৈরী হচ্ছিল মুসলিম লীগ ও মুসলিম সমাজ এবার চলে যাই ১৫ আগস্ট,১৯৪৬ -দিন বাদে রাতের ঘটনায়। সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ তাঁর ‘হস্তান্তর’ গ্রন্থের মাধ্যমে জানাচ্ছেন,’আমি তখন বিবেকানন্দ রোড ও কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের সংযোগস্থলে থাকতাম।অফিস ছিল বর্মন স্ট্রীট।কম রাস্তায় হেঁটে গেলে একটা মসজিদ পড়ত ১৫ আগস্ট রাতে কাজ সেরে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল।১৬ আগস্ট ছিল শুক্রবার,প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন ঘোষিত হওয়ায় সব কিছুতে ছুটি ঘোষণা করা ছিল।পরপর দুদিন ছুটি ছিল।রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে মসজিদটির সামনে এসে অবাক হয়ে গেলাম।মসজিদটি যে হঠাৎ জেগে উঠেছে!সামনে একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।ট্রাক ভর্তি মানুষ।সব মানুষের হাতই সশস্ত্র- হাতে সড়কি,ছোরা, নিদেনপক্ষে লাঠি’।শঙ্কর ঘোষ বিবেকানন্দ রোডে পৌঁছানোর আগেই এরকম আরও ট্রাক তাঁর পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখেছিলেন। অর্থাৎ সারা রাত জেগে মুসলমানরা পরবর্তী দিনের দাঙ্গার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।আস্তে আস্তে ১৬ আগস্ট বা ১৮ রমজান,শুক্রবারের ভোরবেলা এগিয়ে এলো।এগিয়ে এলো সেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের শুভদিনের সকালবেলা।নবী মোহাম্মদ যেমন খুব ভোর বেলায় অসতর্ক অবস্থায় আক্রমণ করতেন,ঠিক তেমনভাবেই খুব ভোরবেলা মুসলিম হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘুমন্ত হিন্দুদের ওপর।এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন এলাকার মুসলিম মহল্লার ওপর।বেলগাছিয়ার মুসলমানদের বলা হয়েছিল বেলগাছিয়া অঞ্চলকে বিধ্বস্ত করার।রাজাবাজারের দায়িত্ব দেওয়া হয়ে ছিল মানিকতলা থেকে শিয়ালদহ- বৌবাজার- কলেজস্ট্রীট এলাকা কলাবাগান বস্তিকে দেওয়া হল হ্যারিসন রোড,বড়বাজার,নাখোদা মসজিদ,টেরিটি বাজার।ফিয়ার্স লেনের গুন্ডাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল লালবাজার থেকে চিৎপুর হয়ে ক্যানিং স্ট্রীট-এজরা স্ট্রীট অঞ্চল।ধর্মতলা,তালতলা-ওয়েলেসলি হয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে এগিয়ে গেল একদল।এন্টালি থেকে শুরু করে বেলেঘাটা সমেত সমগ্র পূর্ব কলকাতা ঘিরে বালিগঞ্জের কাছাকাছি পর্যন্ত আর এক দলের শিকার ক্ষেত্র নির্দিষ্ট হয়েছিল আর খিদিরপুর,ওয়াটগঞ্জ- মেটিয়াবুরুজ এর ভার পেল পোর্ট ও ওই এলাকার গুন্ডারা।১৬ আগস্ট সকাল থেকেই লালবাজার কন্ট্রোলরুমে বসে পড়লেন সুরাবর্দি, ওসমান,লালমিয়া, শেরিফ খান প্রভৃতি নেতারা।আর মুসলিম লীগ নেতারা ও মহল্লার গুন্ডারা দাঙ্গা পরিচালনা করতে থাকে।ফিয়ার্স লেনের গুন্ডাদের আক্রমণে টেরিটি বাজার এলাকার ভাটিয়া ও দোসাদ হিন্দুরা নির্বিচারে নিহত হলো লালবাজার থেকে ১০০ গজের মধ্যে হওয়াতেও পুলিশ জানতে পারেনি মৃতদেহের দুর্গন্ধে তাদের হুঁশ ফেরে- সৌজন্যে সুরাবর্দি অ্যান্ড কোং। তিন সপ্তাহ দাঙ্গা চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে এবার বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু হলো দাঙ্গা।
ভোর সাড়ে চারটের সময় প্রথম ছুরি মেরে খুন করার খবর পাওয়া গেল এরপর বিশাল এক সশস্ত্র মুসলিম জনতা ৬.৩০ নাগাদ মানিকতলা বাজার আক্রমণ করল।একজন হিন্দুলোক ছুরিকাঘাতে মারা যায়।দুজন হিন্দু মহিলা আক্রান্ত হয়। সকাল ৭.০০ টা।খবর এলো মানিক তলায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে।৭.৩০ তে সার্জেন্ট ই.উইলিয়ামস রিপোর্ট করলেন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ’এর পুলিশি ট্রাকের মধ্যে মহিলাদের তিনি এসকর্ট করছেন,ঠিক তেমনই এক পুলিশ ট্রাক নিয়ে মুসলিম যুবকরা বাধাদান করছে।৭.৩৫ মিনিটে খবর এলো বৌবাজার ও লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগ স্থলে বিরাট সংখ্যক মুসলমান লাঠি ও লোহার রড সহ জড় হয়েছে।৮.২৫-খবর এলো টেরিটি বাজারে দাঙ্গা চলছে।৮.৩০ থেকে ৯.১৫ এর মধ্যে খবর এলো লোয়ার চিৎপুরে সিটি সিনেমার কাছে দাঙ্গা শুরু হয়েছে লোয়ার চিৎপুর রোডে দাঙ্গা চলছে শিয়ালদহ অঞ্চলে ভয়াবহ অবস্থা।রিপন স্ট্রীট,ওয়েলেসলি স্ট্রীট ও মল্লিক বাজারে মুসলমানরা যথেচ্ছ ছুরি মেরে চলেছে উত্তরে শ্যাম বাজার ও দক্ষিণে ওয়াটগঞ্জ- সব জায়গা থেকে দাঙ্গার খবর আসতে থাকল।৯.৩০ নাগাদ খবর এলো বড়তলা থানা মুসলমানরা আক্রমণ করেছে।থানা থেকে সশস্ত্র পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে লাল বাজারের কাছে।৯.৫৫ তে বড়তলা থানা আবারও লালবাজারের কাছে সাহায্য চাইল।১০.১২ এর খবর, গড়পার,যোগী পাড়া লেন বা ক্যানাল অঞ্চলে দাঙ্গা চলছে। ১০.৩০ এ খবর এলো,মানিকতলা ও নারকেলডাঙার মুসলমানরা বেশ কিছু হিন্দুকে ছুরি মেরেছে ও হিন্দুদের দোকান লুট করেছে একই সময়ে খবর এলো হ্যারিসন রোডে গোলমাল ও রিপন কলেজের সামনে দু’পক্ষে লড়াই চলছে।১১.৫০ – মুসলমান জনতার একটা বড় দল শিয়ালদহের দিক থেকে দোকানপাট লুট করতে করতে বৌ বাজারের দিকে আসছে । আর একটি মিছিল হিন্দু বিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে ও দোকানপাট লুট করতে করতে আপার সার্কুলার রোড ধরে ময়দানের দিকে এগিয়ে চলেছে।লাঠি ও খোলা তরবারি হাতে একটি মিছিল শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান পর্যন্ত চলে এসেছে।দুপুর1.30 তে খবর এলো মুসলমান এলাকার কাছাকাছি ষষ্ঠীতলায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ,নারকেলডাঙা মেইন রোডের কাছে পাঁচটি হিন্দুর মৃতদেহ।বিকেল ৩.০০।খবর এলো গড়পার এলাকায় ভয়ানক দাঙ্গা শুরু হয়েছে।খালের পশ্চিম পাড়ের হিন্দুদের পাইকারি হারে হত্যা করা হচ্ছে।ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ময়দানে মুসলিম লীগের মিটিং চলছে।মুসলিমদের বিশাল জমায়েত হয়েছে।বিরাট সংখ্যক মুসলিম গুন্ডা উপস্থিত হয়েছে।উপস্থিত আছেন জ্যোতি বসু ও যোগেন মন্ডল।এই উপস্থিত গুন্ডারা মিটিং ভাঙতে না ভাঙতেই মিটিং থেকে সরে পড়ে ও হিন্দুদের দোকান লুটপাট করতে থাকে।বিকেল ৪.০৫ এর খবর, লাইট হাউস সিনেমার পার্শ্ববর্তী সমস্ত দোকান ভাঙ্গা ও লুটপাট চলছে।৪.২০ থেকে ৫.১০ দশের মধ্যে খবর এলো, মুসলিম জনতা বেঙ্গল ক্লাব আক্রমণ করেছে।মেট্রো সিনেমার পাশে কে সি বিশ্বাসের বন্দুকের দোকান ভেঙে মুসলিমরা অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নিয়েছে সমগ্র ধর্মতলা এলাকাতেই ব্যাপক লুটতরাজের খবর।ধর্মতলা স্ট্রীটের বিখ্যাত ‘কমলালয় স্টোর্স’ লুটপাট হয়ে গেছে।আশপাশের রাস্তায় নৃশংস হত্যা ও লুন্ঠন চলছিল।ধর্মতলা স্ট্রীটে চাঁদনিচক বাজার মুসলমান গুন্ডারা লুঠ করে নিয়েছে।ইন্দ্র রায় রোডের বস্তি থেকে সশস্ত্র মুসলিম গুন্ডাদের দল বেরিয়ে আসছে বলে খবর।ওয়েলেসলী স্ট্রীটে বাটা সু কোম্পানি ও সেন অ্যান্ড ল’র দোকান লুন্ঠিত।8নং তাঁরাচাঁদ দত্ত স্ট্রীটে গমের কলে হিন্দুদের খুন করা হয়েছে ১৫২ নং লোয়ার সার্কুলার রোডে লক্ষ্মীকান্ত দাসের সাইকেল দোকান লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত।রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটের হিন্দুদের প্রায় সমস্ত বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এত কিছু হত্যালীলার মধ্যেও কিছু ভাল খবর ছিল।হাওড়া থেকে কলকাতায় আসার সময় একদল মুসলিম জনতা কেরোসিন, লাঠি,ছোরা, বল্লম নিয়ে আসছিল।অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ অফিসার রুখে দিয়ে সমস্ত অস্ত্র ও দাহ্য পদার্থ কেড়ে নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়।
ক্যানিং স্ট্রীটে ব্যাপক হত্যা ও লুটপাট চলছে বলে খবর পাওয়া গেল।একটা অ্যালুমিনিয়ামের দোকান লুট হলো সেখান থেকে ৬ টা হিন্দু মৃতদেহ ও ৭ টা মারাত্মক জখম হিন্দুকে পাওয়া গেল সরকার ও কর্পোরেশন থেকে দাঙ্গায় দরাজ হাতে সহায়তা করা চলতে থাকল ১৫ থেকে ১৮ অক্টোবর কাজ করার জন্য কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র মহম্মদ ওসমান তথা মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম লীগ গুন্ডাদের জন্য স্পেশাল কুপন দেন ১৬ তারিখ ও পরবর্তীতে কাজ করানোর জন্য একটা বড় সংখ্যক ট্রাক ও প্রাইভেট গাড়ি মুসলিমদের সার্ভিস দেওয়ার জন্য আনয়ন করা হয়।১৬ আগস্ট মনুমেন্ট ময়দানে সুরাবর্দি তাঁর স্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন,’২৪ ঘন্টা সময় দিলাম:যা করতে পারিস কর’।ওই একই মঞ্চে ইস্পাহানিও বেশ গরম গরম বক্তৃতা রাখলেন।
নারকেলডাঙ্গা গড়পার এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো।২১ নং নারকেল ডাঙ্গা মেইন রোডে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার রায়বাহাদুর এস এন মুখার্জির বাড়ি আক্রান্ত হলো রাজাবাজার এলাকায় বীভৎস হত্যালীলাচলল। ২৫ নং বুধু ওস্তাগর লেনে হিন্দু হত্যার নরমেধযজ্ঞ । বেশ কিছু মুসলিম গুন্ডা ধরা পড়ল সুরাবর্দি নিঃশর্তে ওইসব গুন্ডাদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিলেন।১৬ এবং ১৭ তারিখ বিখ্যাত গণিতজ্ঞ, যিনি আবার আলিগড়ে মুসলিমদের পড়াতেন-৮৫ নং আপার সার্কুলার রোডে যাঁর বাড়ি,সেই যাদব
চক্রবর্তীর বাড়ি আক্রান্ত হলো। ১৬ তারিখ খুব সকাল থেকেই তাঁর বাড়িতে আক্রমণ শুরু হয়।বেশ কিছু মানুষ,যাঁরা শ্রী চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে থানায় আশ্রয় নিয়ে ছিল।পাঁচশো থেকে ছ’শো মুসলমান ওই বাড়িটা আক্রমণ করেছিল।একজন মহিলাকেও ধর্ষণ করা হয়েছিল।প্রসঙ্গত শ্রী চক্রবর্তীর এক পূত্র সন্তান নিহত হন।ঠেলাগাড়িতে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় কালী সোম স্ট্রীট ও কেশব সেন স্ট্রীটের সংযোগ স্থলে এক মৃতপ্রায় মহিলা বলে উঠলেন ‘আমার নাম শেফালী’। বাগমারী এলাকায় হিন্দুদের বেশ কিছু বন্দুক ছিল। সুরাবর্দি প্রথমে বন্দুকগুলি আটক করল। তারপর মুসলমানরা বিধ্বস্ত করল বাগমারী এলাকার হিন্দুদের।ভারত মিহির প্রেসে হত্যা ও ধর্ষণ চলল নির্বিচারে।এই ভারত মিহির প্রেস ছিল আপার সার্কুলার রোডে রাজাবাজারের কাছে।রাজা বাজারের কাছে এক কসাইয়ের দোকানে দুই হিন্দু মহিলাকে হত্যা করার পর উলঙ্গ করে মাংস ঝোলানোর লোহার হুকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।একথা বলেছেন বর্তমানে প্রয়াত পুলিশ অফিসার গোলক বিহারী মজুমদার।তিনি বলেন জীবনে প্রথম উলঙ্গিনী মৃতদেহ সেই প্রথম দেখলাম মল্লিক বাজার ও পার্ক সার্কাস অঞ্চলে হিন্দুগৃহে চলল লুটপাট,অগ্নি সংযোগ ও বলাৎকার।এত কিছু চলছে,অথচ মিলিটারী ডাকা হল না।উল্টে সুরাবর্দি মধ্যরাতে গুন্ডাদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করতে বেরোলেন।হেস্টিংস থানার এস আই নূরুল হুদা ভূঁইয়া গুন্ডাভর্তি বাস নিয়ে বেলেঘাটায় হাজির হয়েছিলেন হিন্দু হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে।কলাবাগান বস্তি থেকে যথেচ্ছ ছুরি, লাঠি ও লোহার রড ব্যবহার করা হয় হিন্দুদের ওপর। ছবি বিশ্বাসের দিলখুশা রোডের বাড়ি আক্রান্ত হয়ে লুটপাট হয়ে গেল।গঙ্গার ভাসমান জাহাজের মুসলিম সারেংরা হিন্দু মাঝিদের নৌকা ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দিল।
সবচাইতে অবাক হওয়ার পালা ছিল স্বনামধন্য বি কে রায়ের হত্যাকাণ্ডে।শ্রী রায়ের বাড়ি ছিল ৮১,মৃগেন্দ্রলাল মিত্র রোডে ঠিক মুসলিম লীগ নেতা মৌলানা আক্রাম খানের বাড়ির উল্টো দিকে। বি কে রায় ও মৌলানা আক্রাম খান ছিলেন উভয় উভয়ের বন্ধু।বেঙ্গল প্রুভেন্সিয়াল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট মৌলানা আক্রাম খান শ্রী রায়কে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন তাঁরা নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে এখানে বসবাস করতে পারবেন।তবে উক্ত দিনে বার বার শ্রীরায়ের বাড়ি আক্রান্ত হয়। বিকেল ৪.০০ এর সময় ৫০০ মুসলমান ওই বাড়ি আক্রমণ করে এবং বি কে রায়কে হত্যা করে যখন আক্রাম খান তাঁর নিজের বাড়িতে ছিলেন।তিনি বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এসে উন্মত্ত মুসলিম জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। দুটি বাড়ির বারান্দার দূরত্ব ছিল মাত্রই ২৫-৩০ ফুট। যখন আক্রাম খান বুঝলেন যে হত্যাকাণ্ড হয়ে গিয়েছে, তখন তিনি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। হায়রে রায় পরিবার তোমরা আক্রাম খানকে বিশ্বাস করেছিলে, মৌলানার ‘তাকিয়া’ বুঝতে পারোনি।ওই বাড়িতেই ছুরিকাহত হয়েছিলেন বসন্ত কুমার রায়,যিনি একজন অবসর প্রাপ্ত সাব জজ । সার্জেন্ট পি. ফ্লাইন ওই বাড়িতে আহতদের হাসপাতালে পাঠান ও পাঁচজন মুসলিম দুর্বৃত্তকে গ্রফতার করেন।সুরাবর্দি সব মুসলমানকে মুক্তিদান করেন।
এইমত জীবন ঝুঁকির সময় চারিদিক থেকে হিন্দুরা সাহায্য ও জীবন বাঁচানোর জন্য লাল বাজারে এস ও এস করতে থাকলো।এই ফোনের জবাবে নির্বিকার চিত্তে পুলিশ জানাল ‘এই বিষয়ে কিছু করার জন্য নির্দেশ নেই,তারা কিছুই করতে পারছে না।’ উল্টে আরও বলা হল ‘কংগ্রেস দল তোমাদের প্রোটেক্শন দেবে, মা কালী তোমাদের রক্ষা করবে।’ প্রসঙ্গত ওই সময়ে সমস্ত হিন্দু পুলিশ অফিসারকে ছুটিতে পাঠান হয়েছিল অথবা ক্লোজ করা হয়েছিল।লালবাজারের দখল ছিল সম্পূর্ণ রূপে মুসলমানদের হাতে।
মেটিয়াবুরুজে মুসলমানরা উড়িয়াদের নির্বিচারে হত্যা করল।সকাল ৮.০০ টাতেই খবর ছিল মেটিয়াবুরুজে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বিকেল ৪.০০ ঘটিকায় সমস্ত ঘটনা কলকাতা পুলিশের হাতের বাইরে চলে যায়। ওখানে একটা ওড়িয়াদের বস্তি ছিল।ওই ওড়িয়ারা ভীত হয়ে বাঁচার জন্য কেশোরাম কটন মিলে অন্য একটা গেট দিয়ে আসতে চাইল।আর সেই গেট দিয়ে ঢোকার পরই ঘটে গেল বিপর্যয়।৩৫ জনকে খুন করা হয়। পোর্ট পুলিশের ঠাসা মুসলিম এলাকার মধ্যে একটা ছোট জায়গায় শ’তিনেক ওড়িয়াদের আরও একটা বস্তি ছিল।১৫ মিনিটের মধ্যেই এই তিনশো মানুষকে হত্যা করা হয়। রতু সরকার লেনের নিস্তারিণী ছাত্রাবাসে গণহত্যা চালানো হল।১৮-১৯ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র একজনকে বাঁচিয়ে রেখে অন্য সবাইকে হত্যা করা হয়।২৪ নং হ্যারিসন রোডের রিপন হস্টেলে ছাত্রদের গণহারে হত্যা করা হয়।সায়েন্স কলেজের হস্টেলেও চলল ছাত্র হত্যা।শুধু হিন্দুদের ওপরই আক্রমণে থেমে রইল না মুসলিম জনতা পুলিশ ইন্সপেক্টর মি.এ.এফ. কিনচিন, যিনি মোটর ভেহিকেলস’এ কর্মরত ছিলেন,তার কথানুযায়ী যেটা জানা যায়, সেটা এইমত।১৬ আগস্ট ১৯৪৬-দুপুর ২.৩০ মিনিট নাগাদ খবর পেয়ে ৬৬/১এ, বৈঠকখানা রোডে হাজির হয়ে দেখলেন ৩০০’র মত মুসলমান ৬৬/১এ,বৈঠকখানা রোডে সৈয়দ নৌশের আলির বাড়ি ঘিরে রেখেছে।তখন তিনি একটা গ্যাসের শেল ফাটালেন। উনি দেখলেন বাড়ির সমস্ত দরজা জানালা ভাঙা। বাড়ির সমস্ত সদস্যরা একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সৈয়দ নৌশের আলি বললেন,মুসলমানরা কংগ্রেসি পতাকা নামিয়ে মুসলিম লিগের পতাকা ওড়াতে চাইছিল।নৌশের আলি ও পরিবারের মহিলা সদস্যরা বলেন যে তারা এখানে থাকলে হত্যা করা হতে পারে।তখন মি. কিনচিন তাদের সবাইকে আমহার্স্ট স্ট্রীট থানায় নিয়ে আসেন।প্রসঙ্গত সৈয়দ নৌসের আলি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে এক জন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও কংগ্রেস নেতা।
রেডক্রশের ঝান্ডা লাগিয়ে,পুলিশের গাড়ি নিয়ে মুসলমানরা দাঙ্গা চালাতে থাকল।গাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র ভরতি করে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় খুন তথা অস্ত্র সরবরাহ বজায় রাখা হয়েছিল।এদিকে জাতীয়তা বাদী ও অসাম্প্রদায়িক বলে কথিত মৌলানা আজাদ কলকাতা ছেড়ে দিল্লি গেলেন প্রসন্ন চিত্তে।মহিষাদল রাজবাড়ি ও মল্লিক বাজার লুন্ঠনের প্রত্যক্ষদর্শী ফজলুল হক বললেন,’কলকাতায় যেন নাদির শাহ্’এর আবির্ভাব ঘটেছে।’
এবার জ্যোতি বসুকে নিয়ে কিছু বলতে হয়।এই নাটকবাজ পার্টি নেতা বলেছেন, ‘আমাদের পার্টি নেতৃত্ব আশঙ্কা করছিলেন,১৬ আগস্ট অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে।’ সেই দিন জ্যোতি বসু সন্ধ্যে বেলা নারকেলডাঙ্গা ছেড়ে যখন শিয়ালদহ হয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে এগোতে থাকলেন, দেখলেন রাস্তার দু’পাশে মৃতদেহ পড়ে আছে, হত্যাকারীরা ফুটপাতে ঘোরাফেরা করছে।সুতরাং রাস্তার মাঝখান দিয়েই জ্যোতি বসুরা হাঁটতে থাকলেন।১২১ নং লোয়ার সার্কুলার রোডে পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির অফিসে বহু কষ্টে পৌঁছান কমরেড জ্যোতি বসু।পার্টি অফিস এলাকাও নিরাপদ ছিল না।জ্যোতি বসুরাও সব সময় আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন। এই জ্যোতি বসু আবার ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬-এ পুলিশ প্রহরায় লিগের সভামঞ্চে হাজির ছিলেন।মঞ্চের পেছনে থেকে তিনি দেখতে পান হিন্দুদের দোকান গুলি লুটপাট চলছে,আগুন ধরানো হচ্ছে। এরপর পুলিশ প্রহরায় দ্রুত বউবাজারের পার্টি অফিসে ফিরে যান।একথা লিখেছেন প্রয়াত সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত। সুতরাং ওইদিন জ্যোতিবসুর নারকেলডাঙ্গার রেল কলোনিতে কাটানোর তথ্য মিথ্যে বলেই মনে হয়। এই জ্যোতি বসুর পার্টির কম্যুনিস্ট নেতা সৈয়দ আব্দুল্লা ফারুকি মেটিয়াবুরুজের লিচুবাগানে আটকে পড়া ওড়িয়াদের হত্যায় সরাসরি ভূমিকা নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে এই ফারুকি সি পি আই টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হন।
মুসলমানী অমানুষিক হিন্দু হত্যালীলার সাথে ধ্বংস করণ ও বিশ্বাসঘাতকতার ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ তারিখের একটা ছোট্ট ধারা বিবরণী জানানো হলো।এইমত একতরফা হিন্দু নিধনের পর যখন হিন্দুরা একটু সামলে নিয়ে গোপাল মুখার্জির নেতৃত্বে প্রতি আক্রমণে নেমে পড়ে,তখন লালবাজারে চেয়ারে বসে সুরাবর্দি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন,আর আওড়াচ্ছেন, ‘আমার বেচারা নির্দোষ মুসলিমরা’- বলেছেন ইম্পিরিয়াল পুলিশের এক কর্তা।দেশ ভাগ হওয়ার পর সেই নরখাদক সুরাবর্দিকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাঁদের দেশে থাকতে আশ্রয় দেয়নি।
শেষ পর্বে বর্তমান ভারতের সংখ্যালঘু প্রেমী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কাছে প্রশ্ন রইল,’আপনারা কি এই ধারা বিবরণীর কিছুই জানেন না? না কি জেনেও বিস্মৃত হয়ে থাকেন?’ আবারও কি বলতে হবে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই? মমতা বন্দোপাধ্যায় এই দিনটিকেই ‘খেলা হবে দিবস’ ঘোষণা করায় হিন্দুরা সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে বলেই মনে হয়।