নকশা বদলের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে বদলি হতে হয়েছিল আমলাকে

মেট্রোর নকশা বদলের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোপে পড়েছিলেন কলকাতা মেট্রো রেল নিগমের (কেএমআরসিএল) ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুব্রত গুপ্ত। তিনি তৎকালীন মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন নকশা বদল করলে বড় ক্ষতি হবে। প্রায় ১১ বছর বাদে সত্যি হল সুব্রতবাবুর আশঙ্কা।

বৌবাজারে একের পর এক বাড়িতে ফাটল ধরায় বড় সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিরোধীরাও এই নিয়ে খোঁচা দিতে শুরু করেছে রাজ্যের শাসক শিবিরকে। একাংশের অভিযোগ, রুট বদলের জন্যই বিপর্যয়।মুখ্যমন্ত্রীকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। আর এক বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “রাজনৈতিক স্বার্থে মেট্রোর রুট ঘোরানোর জেরে এই বিপত্তি ঘটেছে। কাদের বাঁচাতে মেট্রো রেলের রুট বদল করাল সরকার? উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কেন হল রুট বদল? কিছু মানুষের স্বার্থ দেখতেই মেট্রোর রুট বদলে বাধ্য করা হয়েছিল।” আবার পাল্টা যুক্তি শাসকদলের। তাদের সাফ কথা, কেউ বললেই রুট বদলে গেল বিষয়টা তো এমন নয়। তাদের দাবি, প্রযুক্তিগত কারণেই রুটবদল, রাজনৈতিক কারণে নয়। নতুন রুট নিয়ে সার্ভে করে রিপোর্ট দেয় বিশেষজ্ঞ সংস্থা। রেল ইন্ডিয়া টেকনিক্যাল সার্ভিসেস অর্থাৎ ‘রাইটস’-এর সেই রিপোর্ট মেনে নিয়েই নতুন রুটে সম্মতি মিলেছে। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, চৌরঙ্গীর বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, স্থানীয় কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে সকলেই ফাটল নিয়ে দুষছেন প্রকল্পের নির্মাণ সংস্থা কেএমআরসিএল-কে।”

কিন্তু নেপথ্যের ঘটনাটি ঠিক কী? ২০১২-র ২৫ এপ্রিল মুখ্যসচিবকে পাঠানো কেএমআরসিএল-এর এমডি-র পাঁচ পাতার নোটে রয়েছে তার বিস্তারিত কাহিনী। ২০০৮-এর ৩০ জুলাই রেলমন্ত্রক মেট্রোর এই রেলপথের ছাড়পত্র দেয়। সল্ট লেক থেকে হাওড়ার প্রস্তাবিত মেট্রো-র সমীক্ষার কাজ তখন শেষ। ঠিক কোথা দিয়ে এই মেট্রো যাবে, এরকম চারটি সম্ভাব্য পথের একটিকে চূড়ান্তভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। বিদেশী অভিজ্ঞ বাস্তুকারদের পরামর্শ মেনে দফায় দফায় বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নির্মাণকাজের প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলো শুরু হয়। এ রকম একটা অবস্থায় ২০১১-র মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে বড় রাজনৈতিক পালাবদল হল। ক্ষমতায় এল তৃণমূল। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কেএমআরসিএল-এর এমডি-র দায়িত্ব নিলেন তরুন উদ্যমী, মেধাবী আইএএস সুব্রত গুপ্ত।

কথা ছিল ভূগর্ভের রেলপথ শিয়ালদার পর যাবে বৌবাজার বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট হয়ে মহাকরণের পাশ দিয়ে। নকশা মেনে মেট্রোর রেলপথ করার জন্য বৌবাজারে কিছুটা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। বৌবাজারের ব্যবসায়ী এবং বাসিন্দাদের একটা অংশ মেট্রোর প্রস্তাবিত পথে অখুশি ছিলেন। তাঁরা আন্দোলন শুরু করলেন। সুব্রতবাবু তাঁদের সঙ্গে চার বার বৈঠকে বসেন। আশ্বাস দেন, প্রত্যেককে পুনর্বাসন অথবা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অদূরে পোদ্দার কোর্টের পাশে মেট্রো-র টাকায় তৈরি হয় একটি ছতলা ভবন।

সে সময় সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বোঝালেন বৌবাজারের প্রতিবাদীরা। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দিলেন নকশা বদল করে দেওয়া হবে। নির্দেশও দিলেন কেএমআরসিএল-কে। শিয়ালদার পর ভূগর্ভে দক্ষিণ পশ্চিম দিক দিক ধরে সুড়ঙ্গ এল এসপ্লানেডে। শুরু হল জটিলতা। আপত্তি জানাল কেএমআরসিএল এবং প্রকল্পের লগ্নিকারী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (‘জাইকা‘)। কেএমআরসিএল-এর এমডি মুখ্যসচিবকে লেখা নোটে জানালেন আপত্তির বিস্তারিত কারণ।

নোটে বলা হয়, নকশা বদল করতে বাড়তি কয়েকশো কোটি টাকা এবং অনেকটা বেশি সময় লাগবে। প্রযুক্তিগত দিকগুলোও বিচার্য বিষয়। মহাকরণ ছাড়াও এই নোট গেল দিল্লিতে। এদিকে জাইকা-ও মুখ্যমন্ত্রীর নকশা বদলে রাজি নয়। ২০১২-র গোড়ার দিকে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব সুধীর কৃষ্ণ নকশা বদলের প্রস্তাবে আপত্তি জানালেন। নকশা বদল হলে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা উঠল। রাজ্য তখন তড়িঘড়ি করে ‘রাইটস’-কে দিয়ে একটা সমীক্ষারিপোর্ট দাখিল করল। টানাপড়েনে প্রকল্পের কিছু কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক এই প্রতিবেদককে বলেন, “সেই সময় ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর একদিনের কাজ বন্ধ হলে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ টাকার মত। এই অবস্থায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে মহাকরণে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন মুখ্যসচিব। তাতে পরিবহণসচিব, পুলিশ কমিশনার প্রমুখ সব মিলিয়ে ১৮ জন ছিলেন। বৈঠকে কেন্দ্র, জাইকা এবং কেএমআরসিএল নকশা বদলের তীব্র আপত্তি জানায়। কিন্তু রাজ্যের তরফে জানানো হয় প্রকল্পটি হবে পরিবর্তিত নকশা মেনেই। আগের নকশায় হবে না।

এর কিছুদিন বাদেই সুব্রতবাবুকে রাজ্য থেকে চলে যেতে হয় কেন্দ্রীয় পরিষেবায়। আর, সেই সময় নকশাবদলে সবচেয়ে অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলেন রাজ্যের তৎকালীন পরিবহণসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা। এখন তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.