১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ কেন্দ্রীয় বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সদস্যসংখ্যায় টইটম্বুর সংসদে দীর্ঘ ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিট ধরে ২০২০-২১ আর্থিক বছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করলেন। সংসদীয় ইতিহাসে এটা একটা রেকর্ড। উচ্চারিত প্রতিটি প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ। আমিও কাগজ-কলম নিয়ে বসে ছিলাম টিভির সামনে। কেউ আমাকে উঠে পড়বার জন্য তাড়াও দেয়নি। ভাষণে সীতারামনের সৌজন্যমূলক মন্তব্যগুলিও ছিল আকর্ষক। তবে একটানা পাঠ করতে করতে একসময় তিনি অসুস্থ বোধ করেন। বিরতি নেন। সংবাদসূত্রের খবর, ধারাবাহিকভাবে এই জটিল বিবৃতি ব্যাখ্যা সহকারে প্রদানকালে তার রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। পরে অবশ্য সুস্থ হয়ে ওঠেন। আর আমরা সাক্ষী হয়ে। থাকলাম এমন এক আর্থিক প্রস্তাব পেশের যার গুরুত্ব এই দেশের ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, আহারে পুষ্ট এবং অনাহারে অপুষ্ট সকলের নিকটই অপরিসীম। কোনো বাজেটই অবশ্য সকলের হৃদয় জয় করবার মতো দিশাদায়ক হয়ে উঠতে পারে না। তবে অধিকাংশ নাগরিকের সঙ্গে এই বাজেট প্রস্তাব কম-বেশি অ্যাটাচমেন্ট তৈরি করতে পেরেছে। অনেকে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত, আবার রাজনীতির গেরোয় আবদ্ধ থেকে তেড়ে গালিগালাজ করলেন, এ রকম লোকেরও দেখা মেলে বই কী। তবে নির্ভেজাল বিশ্লেষণে বসে অন্যদের মতামতকে শেয়ার করতে রাজি, এ জাতীয় লোকের দেখা মেলা ভার। গৌরচন্দ্রিকায় ইতি টানবার প্রাক্কালে যে সত্যিটা অনস্বীকার্য মনে হচ্ছে, তা হলো এই যে, আমাদের দেশটা কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে অতিকায়। বিভিন্ন পথ, দর্শন এবং সবার অলক্ষ্যে ব্যক্তিবিশেষের হিসেব-নিকেশ সমানে কাটাকুটির খেলা খেলেই চলেছে। এরইমধ্যে যাঁরা যথার্থ প্রতিধানযোগ্য, এখানে তাঁদেরই একের পর এক তুলে ধরবার চেষ্টা করছি। আতস কাচের নীচে। প্রথমেই ধরে নিচ্ছি সরকারের আয় হলো ১ টাকা অর্থাৎ ১০০ পয়সা। এই ১০০ পয়সা সরকারের কোষাগারে ঢুকছে নিন্মোক্ত উৎসগুলি থেকে :
উৎস পরিমাণ
ঋণ— ২০ পয়সা
জিএসটি, সমেত তাবৎ বাণিজ্য কর – ১৮ পয়সা
কর্পোরেশন কর – ১৮ পয়সা
আয়কর – ১৭ পয়সা
আবগারি শুল্ক = ৭ পয়সা
পুঁজির বিনিয়োগ থেকে আয় ৬ পয়সা
অন্য শুল্ক ৪ পয়সা
অন্যান্য রাজস্ব — ১০ পয়সা।
মোট ১০০ পয়সা (সারণি ১ দ্রষ্টব্য)
উপার্জন যদি অপর্যাপ্ত হয়, সরকারের পক্ষে ইত্যাকার দায় বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। (সারণি-১ দ্রষ্টব্য) ফলে আয়ের উপায় সরকারকে বের করতেই হবে, বিরোধীরা যতই দোষারোপের ঝড়কে সাঙ্গোপাঙ্গদের সাহায্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে যাক-না কেন। এর বিপরীতে একটি আর্থিক বছরে সরকার যদি নিছক জনমোহিনী বাজেট উপস্থাপিত করে সংসদে, তা যে প্রকারান্তরে দেশের বুনিয়াদকেই নড়বড়ে অবস্থায় টেনে আনে, তা বোঝাতে কোনো অর্থনীতির প্রফেসরকে ডেকে আনবার দরকার নেই। আমার অভিজ্ঞতা বলে, সচরাচর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন সরকার ওই রকম। জনমোহিনী বাজেট পেশ করে থাকে সাধারণ মানুষের আশু সমর্থন লাভের প্রত্যাশায়। বাজেটকে লালিপপ বানিয়ে নির্দোষ। নাগরিককে আকর্ষণ করবার চেষ্টায় সঠিক। অর্থনীতি বিলকুল বেঠিক হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বিত্তমন্ত্রীর সেই ফাইলটাও আর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থাকে না। দয়াদাক্ষিণ্যের সমারোহে ভারসাম্যহীনতার শ্রেণীবদ্ধ বিস্তার ঘটে। ২০২০-২১ আর্থিক বছরের বাজেটপ্রস্তাবটি যে ভোটে জেতার গণপ্রণাম মন্ত্র হয়ে ওঠেনি, তার জন্য নির্মলা সীতারামনকে ধন্যবাদ। প্রত্যাশার চাপ কিন্তু ছিল যথেষ্ট। এমন চাপ যে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা গণতান্ত্রিক দেশে বেশ কঠিন। প্রত্যাশা যাদের সর্বাধিক, তারা মুখ্যত মধ্যবিত্ত। ফস্টারহোমে লালিত যথার্থ দরিদ্ররা নন। আবার এ কথাও এ দেশের সকল রাজনীতিকই জানেন, ভারতবর্ষে মধ্যবিত্তের হৃদয় যদি ছোঁ মেরে না তোলা যায়, ভোটযুদ্ধে ভরাডুবি প্রায় অনিবার্য। তদনুযায়ী নেতা-নেত্রীদের এমনই ভাষণ-টাষন দেন, হরেক কিসিমের সোশ্যাল ওয়ার্কের ভনিতাও করেন। তবে এ কথা ভাবলে ভীষণ ভুল হবে যে মধ্যবিত্তরা বুঝি একাত্মবোধে বিভোর। বরং এর উলটো। প্রত্যাশার বহর নিয়ে সবচেয়ে বেশি বাদানুবাদ তাদেরই। এককাট্টা মধ্যবিত্তদের আমরা কদাচিৎও দেখতে পাই না।
আলোচ্য বাজেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল ছিল মধ্যবিত্তের। বাজেট পেশের আগে যখন যার সঙ্গে দেখা হয়েছে, শুনতে পেয়েছি সেই এক প্রশ্ন, “দাদা, কী মনে হচ্ছে? মোদী সরকার নিশ্চয় আয়করে বড়ো ছাড় দিতে চলেছে। এর বাইরে সহসা আর কোনও জিজ্ঞাসা আসেনি। এমনকী, যে নাগরিক পঞ্জীকরণ নিয়ে বিরোধীদের শরীর মন অসাড় করা চিলচিৎকার, তা নিয়েও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। মনে হবে, মোদীজী যেন মধ্যবিত্তকে কথা দিয়েছেন, আয়করে এবার বিশাল ছাড় আসছে। যদি আসে, মধ্যবিত্তদের একজনও অন্যমনস্ক থাকবেন না দু’হাত তুলে জয়ধ্বনি দিতে। সুতরাং বাজেটের বিশ্লেষণে বসলে প্রথমেই চলে আসে আয়করের প্রসঙ্গ। কিন্তু আমি হুটপাট করে আয়করের ব্যাপারটাকেই সর্বাগ্রে টেনে আনতে নারাজ। বরং এই প্রসঙ্গটাকে নিয়ে আসতে চাই শেষ পর্বে। আয়করের চেয়ে অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। আমাদের সামনে। নিজস্ব স্মৃতিচারণেও আমি এই চর্চাটাতে বরাবর আবেগশূন্য। যতই বিবৃতি দেওয়া হোক, বাস্তবে এ দেশের ক’টা মানুষের ওপর আয়কর ধার্য করা হয় ? শতাংশের হিসেবে অতি, অতি নগণ্য। এখানে আমি সেই বিষয়গুলিকে নিয়েই প্রথমে চর্চা করব, যেগুলি প্রায় সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক পরিস্থিতির আদত ছবিটাকে তুলে ধরে। কোনটা ইতিবাচক, কোনটা নেতিবাচক, কোনটা কোমল, কোনগুলি ক্রুর ভয়ংকর– সময়ানুক্রমে তাদের চিহ্নিত করাটাই মুখ্য কর্তব্য বলে মনে করছি :
(১) আজও এদেশের শতকরা ৭০ ভাগ পরিবার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। সুতরাং দেশে যথার্থ উন্নয়নের পরিবেশ উদ্ভূত হবে তখন, যখন দেখা যাবে যে সরকার সাদরে কৃষকদের অবস্থা ফেরাতে টাকা ঢালছে। এই উপলব্ধির দৃঢ় ও তৎপর অবস্থান প্রত্যক্ষ করা গেল নির্মলা সীতারামনের বাজেট প্রস্তাবে। প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা চাষিদের কল্যাণে বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ অবধি দেশের কোনও সরকার কৃষকদের জন্য এত টাকা বরাদ্দ করেনি। বিপুল অঙ্কের এই অর্থের সঠিক ব্যবহারের স্বার্থে ১৬টি বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চলেছে সরকার। ২.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়িত হবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত গ্রামোন্নয়নেও। আস্থা রাখছি, ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলির উপার্জন দ্বিগুণ হবে।
(২) জিএসটি রিটার্নের জটিলতা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আমরা গত কয়েকবছর ধরে শুনে আসছি। আমার অন্তরঙ্গ একাধিক ব্যবসায়ীও অনুরূপ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এবার সেইসব জটিলতা এপ্রিল মাসের মধ্যেই মুছে যাবে বলে নির্মলাদেবী তার বাজেট প্রস্তাবে জানালেন। জিএসটির বিরুদ্ধে যে যতই গলাবাজি করুক, এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশে জিএসটি চালু হওয়াতেই লালশালুর ওপর দাঁড়ানো সন্দেহজনক ও দুর্গন্ধময় ‘ইন্সপেক্টর রাজ’ দেশ থেকে একরকম মুছেই গিয়েছে।
(৩) গৃহী পুরুষ মহিলা শিশু সকলেরই অন্যতম প্রাত্যহিক সমস্যা হলো পরিবহণ। রাজ্য ও কেন্দ্র- উভয় স্তরেই সাধারণ। মানুষের যুগপৎ সরব ও নীরব প্রতিবাদ ও অনুনয় পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবিতে। প্রস্তাবিত বাজেটে জল স্থল ও আকাশ। পরিবহণে নবযুগ আনয়নের প্রতিশ্রুতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা লক্ষণীয়। বাজেটীয় প্রতিশ্রুতি মোতাবেক দেশে নির্মিত হবে ১০০টি নতুন বিমানবন্দর। ছুটবে ১০০টি নতুন দূরপাল্লার ট্রেন। গঙ্গা সমেত অধিকাংশ বড়ো বড়ো নদীতে ও বন্দরে জলযানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে অনেক পরিবহণের দাবি মেটাতে। ২৫ হাজার নতুন সড়কপথ নির্মাণের রূপরেখা রচিত হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ২৭ হাজার কিলোমিটার রেলপথের বৈদ্যুতিকরণ সমাপ্ত হবে ২০২৪ সালের মধ্যে। সৌরশক্তির ব্যাপক প্রয়োগও ঘটবে ওই প্রকৃত উন্নয়নয়নে। দেশের প্রধান। প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলিকে যেন এক সুতোয় বেঁধে রাখবে তেজস এক্সপ্রেসের সমকক্ষ বেশ কতগুলি সেমি-হাইস্পিড যাত্রীবাহী ট্রেন। দিল্লি-মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়ে যবে বছর তিনেকের মধ্যেই।
(8) মুক্ত ও স্বচ্ছ আবহে ক্ৰমে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা জম্মু ও কাশ্মীরের সার্বিক উন্নয়নকে বাস্তবায়িত করবার পথে চলতি আর্থিক বছরে সরকার ব্যয় করবে বিপুল পরিমাণ অর্থ— ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প যেমন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, তেমনি কাশ্মীরের নিজস্ব শিল্প উলেনগুডস, আপেল, মুখরোচক খোবানি ইত্যাদির চাহিদা হয়ে উঠবে সর্বভারতীয়; রপ্তানি হবে দেশের বাইরেও।
(৫) সংসদে বিত্তমন্ত্রী শোনালেন এমন। এক প্রস্তাব, যার সমর্থনে জয়ধ্বনিতে। মুখরিত হবে দেশের দলিত ও তপশিলিরা। তাদের কল্যাণে এক বছর সময়সীমায় এই সরকার ব্যয় করবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মলাভ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এই শোষিতদের জীবনযাত্রায় সূচিত হবে বৈপ্লবিক শুভ অগ্রগমন।
(৬) ইন্টারনেট পরিষেবার প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম প্রথমাবধি। এবারের বাজেটে তাই ওই পরিষেবার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীরই মানসমূর্তিটি যেন প্রতিফলিত। এক লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েতে আসছে অপটিক্যাল ফাইবার। বরাদ্দ হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। গ্রামের সঙ্গে শহর ও নগরের যোগাযোগ নিজস্ব প্রসারণশীলতার মাধ্যমে গড়ে ওঠার কথা বলেছেন বিত্তমন্ত্রী। নব ভারত গঠনের যে কথা বহু বছর ধরে আমরা শুনে আসছি, এবার শুরু হলো তার আধুনিকপর্ব।
(৭) অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মধ্যম মাপের শিল্পসংস্থাগুলির বর্তমান পরিস্থিতি যে যথার্থ সুখকর নয়, অধিকাংশ পূর্ণদৈর্ঘ্যের সংবাদপত্র ও ট্যাবলয়েডে তা প্রায়শ আলোচিত হচ্ছে। নব্য প্রযুক্তির প্রয়োগও তার যথার্থ আধুনিক অবয়ব দেখাতে পারছে না। নির্মলা সীতারামন এমত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকারের যে জানকবুল, তা ঘোষণা করলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। সত্যি যদি অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মধ্যমমাপের শিল্প প্রসারতা লাভ করে, কর্মসংস্থানেরও পরিধি বাড়বে এবং দেশের যুবশক্তিকে প্রকৃতই শামিল করা যাবে শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবার আরতিতে। অবশ্য এই ব্যাপারে ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকার পর্যালোচনা কাম্য ছিল। শুধু পকেটে একাধিক কার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ালেই চলবে না। শিহরণ সৃষ্টিকারী নজরদারি দরকার শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে। বিত্তমন্ত্রী কথা দিয়েছেন, আগামী ১ এপ্রিল থেকে জিএসটি রিটার্নকে সরল করা হবে। এই রিটার্ন সাবমিট করতে গিয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের আর বিচলিত হতে হবে না।
(৮) কৃষিতে সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈবশক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দিতে সীতারামন কৃষকদের আহ্বান ও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
(৯) বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম নির্মাণে দেশীয় প্রযুক্তির ওপর জোর দিয়েছে বাজেট প্রস্তাব। চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, মোবাইল, ল্যাপটপইত্যাদি অতঃপর যাতে সম্পূর্ণভাবে দেশেই তৈরি হয়, তার জন্য সরকারি সহায়তা আসবে নানা পথ ধরে।
(১০) দেশে দূষণের মাত্রা কমাতে বিত্তমন্ত্রী নাগরিকদের আরও বেশি সচেতন ও সামাজিক হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রত্যাশা করেন, দলমত নির্বিশেষে সকলেই এই সচেতনতার শামিল হয়ে উঠবেন। বায়ুদূষণকে নিষ্ক্রিয় করতে তাঁর বিশেষ প্রতিশ্রুতির নাম ‘ক্লিন এয়ার পলিসি। সেই পলিসিকে সফল করতে বাজেটে তিনি রেখেছেন প্রচুর পরিমাণ অর্থ— ৪ হাজার ৪ শো কোটি টাকা। ভারতের পূর্ববর্তী বিত্তমন্ত্রীগণতাঁদের বাজেট ভাষণে বিস্তর কাগজের গোছা নিয়ে এলেও এই বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামিয়েছেন বলে। আমার অন্তত জানা নেই।
(১১) দেশের আর্থিক বুনিয়াদকে পোক্ত করবার অন্যতম উপায় রপ্তানির পরিমাণে বৃদ্ধি আনয়ন। এর জন্য যদি শিল্পমহলকে ঋণ সমেত বিবিধ সহায়তা না দেওয়া যায়, লক্ষ্যভেদ কার্যত অসম্ভব। কোনো সংস্থার কী বস্তু নির্মাণে খ্যাতি, তা খুঁটিয়ে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে। এই কাজে সাফল্য আনতে নির্মলা সীতারামন তাঁর বাজেট প্রস্তাবে নিয়ে এলেন এক নতুন দিশা, নাম যার ‘নির্ভীক’। বক্তৃতার সময় ইমোশনালি তিনি কয়েকবার ‘নির্ভীক’শব্দটিকে জোরের সঙ্গে উচ্চারণও করেন। এ যেন শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে প্রকৃত রোগটিকে খুঁজে বের করা। এই প্রকল্পে অতঃপর বলীয়ান হয়ে ক্ষুদ্র রপ্তানীকারীরা অনেক কম প্রিমিয়াম দিয়ে যথেষ্ট বৃহৎ বিমার সুবিধা পাবেন। ইত্যাকার সিস্টেমে ক্লেম’লাভের প্রক্রিয়াকেও করা হবে সরলতর। দেশের সর্বত্র রপ্তানিকারক সংস্থাগুলিকে পণ্যপরিবহণের সুবাদে যে জ্বালানি মূল্য ও বিদ্যুৎবিল মেটাতে হয়, এবার সরকারই সচেষ্ট হবে ওই ব্যয়ভারকে অনেকটাই লাঘব করতে। আদতে “নির্ভীক’-এর নির্ভীকতায় সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন দেশের ছোটো ছোটো রপ্তানিকারীরা।
(১২) এবারের বাজেটকে নারী ও শিশুদের প্রতি কেবলমাত্র উদার ও দয়াবান বললে বিশ্লেষণ খামতি থেকে যাবে। পরিবর্তে নারী ও শিশুদের বাস্তবসম্মত উন্নয়নে সরকার যে একরকম নাছোড়বান্দা, সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে নিম্নোক্ত তিনটি প্রতিশ্রুত প্রকল্পে :
(ক) পোষণ অভিযান। (খ) ধনলক্ষ্মী (স্বনির্ভর গোষ্ঠী)। (গ) কল্যাণদায়ী শক্তিমহড়া (টাস্ক ফোর্স)।
‘পোষণ অভিযান’-এর মূল লক্ষ্য, একদিন থেকে আরম্ভ করে ৬ বছর বয়স অবধি শিশুদের শারীরিক পুষ্টি ও মানসিক বিকাশের অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত রাখা। এই দেশের অধিকাংশ শিশুই যে অপুষ্টির শিকার, এটা গত ৭৩ বছরের এক মহা ব্লেমিশ, কলঙ্ক। এই প্রথম দেশের বাজেট প্রস্তাবে তা স্বীকার করা হলো এবং পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকারি সহায়তার কথা বলা হলো। বিত্তমন্ত্রীর শপথ, ২০২২ সালের মধ্যে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২৫ শতাংশে আনতেই হবে। এর জন্য প্রতি বছর সরকার ব্যয় করবে ৩০০ কোটি টাকা।
মহিলাদের সন্তান ধারণের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণের জন্য অবিলম্বে গঠিত হবে একটি টাস্কফোর্স। ৬ মাসের মধ্যে উক্ত টাক্সফোর্স তাদের রিপোর্ট জমা দেবে। শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে যে হারে মহিলাদের মৃত্যু ঘটছে এদেশে, সরকার তা হ্রাস করতে বদ্ধপরিকর। আর ‘ধনলক্ষ্মী’ হলো মহিলাদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত “স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির দ্বারা নির্মিত দ্রব্যাদি বাজারজাত করতে সরকার সাধ্যানুসারে সাহায্য করবে।
(১৩) অতঃপর আসছি আয়কর প্রসঙ্গে, যে বিষয়টির দিকে সচরাচর তাকিয়ে থাকেন চাকুরিজীবী সমেত মধ্যবিত্তরা। বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা ছিল, নির্মলাদেবীর প্রস্তাবিত বাজেটে আচমকাই মিলে যাবে যেন একরাশ মণিমুক্তা এবং তারা খুব জাঁক করেই উপভোগ করবেন সেই প্রাপ্তিযোগকে। কিন্তু বাস্তবে লক্ষ্য করলাম, বহু পরিচিত করদাতার চোখেমুখে বিভ্রান্তি ও হতাশা। অনেকে আবার এই সুযোগে বিজেপি সরকারকে দুয়োও দিলেন।
আদতে এই বিষয়টা আমাদের গভীর মনোযোগও দাবি করে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় বার্ষিক ১৫ লক্ষ টাকা অবধি উপার্জনের ওপর করের হার সর্বাধিক ১০ শতাংশ কমাবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই সুবিধা যদি আপনি নিতে চান, তাহলে আপনাকে সঞ্চয় তথা বিনিয়োগের মাধ্যমে এতদিন যে কর ছাড়ের সুবিধা পাচ্ছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আয়করের বিভিন্ন ধারামোতাবেক যথা, পিপিএফ-এ টাকা রাখা, গৃহঋণের আসল পরিশোধ বাবদ ব্যয়, জীবন বিমার প্রিমিয়াম প্রদান বাবদ ব্যয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ন্যূনতম ৫ বছরের ফিক্সড ডিপোজিট করা ইত্যাদি যোগে সর্বাধিক ১.৫ লক্ষ টাকা অবধি যে করছাড় পেতেন, তা আর থাকবে না। স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম বাবদ সর্বাধিক ২৫ হাজার টাকার ছাড়ের কথাও আপনাকে ভুলে যেতে হবে। এবার হিসেব কষে দেখুন, অত সমস্ত সুবিধা ছেড়ে দেবার পরও আপনি লাভবান হচ্ছেন কিনা? যদি হয়ে থাকেন, নতুন নিয়মকে মেনে নিন। অন্যথায় আঁকড়ে ধরে থাকুন, অন্তত একটি আর্থিক বছরের জন্য, বর্তমান আয়কর বিধানকেই। চলমান এবং আগুয়ান— এই দুইটির মধ্যকার প্রভেদ বুঝতে গিয়ে আমি পরে দেখলাম, অনেক মানুষই ছোটাছুটি, ঠেলাঠেলি করছেন প্রস্তাবের তাৎপর্য বুঝতে। স্বস্তিতে আত্মহারা হবার বদলে কপালে গভীর কুঞ্চন। এই প্রজন্মের করদাতাদের কাছে আয়করের এমন দ্বিবিধ ফর্মুলা যুগপৎ অভিনব এবং বিভ্রান্তিকর। (সারণি-২ দ্রষ্টব্য)।
নতুন প্রস্তাবিত করকাঠামোয় এই ছাড়গুলির একটিও থাকছে না। অর্থাৎ প্রত্যাশার হাউইবাজি প্রত্যাশিত উচ্চতায় আদৌ পৌঁছাল না। বলতে আমার সঙ্কোচবোধ নেই, আয়করের নতুন নিয়ম পুরোদমে চালু হয়ে গেলে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়প্রবণতা কিন্তু হ্রাস পাবে। আরও একটি বিষয় কিন্তু অনভিপ্রেত। তাহলো এই যে, করদাতারা কে কোন নিয়মে কর দেবেন, সেই বিষয়ে সার্বিক স্বাধীনতা থাকছে না। অতি সম্প্রতি আরও বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অবহিত হলাম যে, একমাত্র যাঁরা চাকরিজীবী, তাঁরাই করকাঠামোর ওই দুটি নিয়মের যে কোনও একটিকে বেছে নিতে পারছেন। যাঁরা বাণিজ্যে রত, তাঁরা। ইচ্ছা মতো আয়কর জমা দেবার পদ্ধতি বদলাতে পারবেন না। যে পদ্ধতি তারা একবার বেছে নেবেন, সেটাকেই মান্যতা
‘মার্চেন্টস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মি: অরবিন্দ আগরওয়াল জানালেন, “আয়করদাতাদের মধ্যে ব্যবসায়ী এবং পেশাদারদের সরকার একই পংক্তিতে রেখেছে। তাই যে নিয়মে ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স দিচ্ছেন, সেই একই নিয়মে বন্দি থাকছেন। ডাক্তার, চারটার্ড অ্যাকাউন্টেট প্রমুখ পেশদারও। মোটের ওপর এবারের বাজেট প্রস্তাবে আয়কর ধার্যের ও আদায়ের যে বিন্যাস করা হয়েছে, তা বহু করদাতারই না পছন্দ। কিছু মানুষকে খুব’ বিচলিত অবস্থাতেই দেখলাম।
(১৪) বিতর্ক জমিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সমেত আরও কিছু ব্যক্তিত্ব এল আই সি-র শেয়ার বিক্রির প্রস্তাবটিকে নিয়ে। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে আমার মনে হচ্ছে, এই প্রস্তাবের বিরদ্ধে ঝড় তোলার কোনও কারণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এক সময় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্কেরও কিছু শেয়ার খোলা বাজারে ছাড়া হয়েছিল। আমি । নিজেও কয়েকটি শেয়ার কিনে লাভবান হই। কিন্তু ওই ব্যবস্থায় স্টেট ব্যাঙ্কের সরকারি অধিকারে সামান্যতম আঁচড়ও লাগেনি। এল। আই সি-র খোদ চেয়ারম্যান মি. এম আর কুমার সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, এলআইসি-র বেসরকারিকরণ আদৌ হচ্ছে না। সমস্ত Policy-তেই Sovereign Guarantee অটুট থাকছে। সরকার তার শেয়ারের সামান্য একটি অংশকে বিলগ্নীকরণের কথা ভাবছে। এটা নতুন কিছু নয়। এর বহু আগে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমার ক্ষেত্রেও এই রকম অল্পস্বল্প শেয়ার বিক্রি করেছে সরকার। অপপ্রচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। সব মিলিয়ে বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দীর্ঘ বাজেট প্রস্তাব অনন্য। বিস্তারিত বিশ্লেষণের হকদার। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মি: মায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালেন এই ভাবে—
‘…এই অতি দীর্ঘ বাজেট প্রস্তাবটি প্রকৃতই ঐতিহাসিক গুরুত্বের দাবি রাখে। বিত্তমন্ত্রীর জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ, অনুধাবন, বাস্তববোধ ও সহমর্মিতা আমাদের আপ্লুত করেছে। তিনি দেশের বর্তমানকে যথাসাধ্য। চাঙ্গা করে তোলার দাওয়াই বাতলালেন ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে। বিশ্ব এখন হরেক সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই বাজেটটি সত্যি ব্যতিক্রমী। আমরা প্রত্যয় রাখতেই পারি।
শেখর সেনগুপ্ত
2020-02-29