স্বাস্থ্যে খরচ বৃদ্ধির প্রস্তাব, ৭৫-এর উর্দ্ধে সম্পূর্ণ কর ছাড় : অর্থমন্ত্রী

স্বাধীনতার পরে কোনও বাজেটকেই হয়তো এত সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি, যা ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেটকে করতে হয়েছে। চ্যালেঞ্জ অনেক ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ভারতীয় অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা এবং ৫ লক্ষ কোটি ডলার অর্থনীতিতে পৌঁছনোর রাস্তায় ফেরা। সোমবার বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন, ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে -রাজস্বে ঘাটতি হয়েছে ডিডিপির ৯.৫ শতাংশ। আগামী অর্থবর্ষে আর্থিক ঘাটতি ডিডিপি-র ৬.৮ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি কোভিডের প্রতিষেধকের জন্য ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সবমিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে ১৩৭ শতাংশ খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট ২ লক্ষ ৮৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করছে সরকার। ৭৫ বছরের বেশি বয়সিদের সম্পূর্ণ কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে, সব শ্রমিকের জন্যই ইএসআই-এর প্রস্তাব করা হয়েছে।
চিরাচরিত ‘বই খাতা’ নয়, এবার ‘বাজেট ট্যাব’ নিয়ে সংসদে আসেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এ বারই প্রথম ‘পেপারলেস বাজেট’ পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। কোভিড সংক্রমণের কারণে দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার বাজেটের কোনও নথি ছাপানো হয়নি। এদিন বেলা এগারোটা নাগাদ বাজেট পেশ করার শুরুতেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে এই বাজেট তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালের মে মাসে আত্মনির্ভর ভারত প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল সরকার, পুনরুদ্ধার চালিয়ে যেতে আমরা আরও দু’টি আত্মনির্ভর প্যাকেজ এনেছি। অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে এই বাজেট। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতে এই মুহূর্তে দু’টি ভ্যাকসিন রয়েছে, নিজেদের দেশকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি অন্যান্য দেশকেও সাহায্য করা হচ্ছে। আরও দু’টি প্রতিষেধক আসছে।’ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘দরিদ্রদের সাহায্য করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা, তিনটি আত্মনির্ভর ভারত প্যাকেজ এবং পরবর্তী ঘোষণাগুলি মিনি-বাজেটের মতোই ছিল। ৪০ কোটি কৃষক ও প্রবীণ টাকা পেয়েছেন। ৮০ কোটি মানুষ নিখরচায় রেশন পেয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই বাজেট নতুন দশকের প্রথম বাজেট এবং এই বাজেট ডিজিটাল। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেট ছ’টি পিলারের উপর ভিত্তি করে। স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা, শারীরিক ও আর্থিক মূলধন ও অবকাঠামো, অনুপ্রেরণামূলক ভারতের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশ, মানব পুঁজির পুনঃব্যবস্থাপনা, উদ্ভাবন ও গবেষণা ও উন্নয়ন, ন্যূনতম সরকার ও সর্বোচ্চ পরিচালনা। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করতে ৬৪ হাজার ১৮০ কোটির প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। ৬ বছরে এই টাকা খরচ হবে। অর্থমন্ত্রী জানান, সরকার যে আত্মনির্ভর প্রকল্প ঘোষণা করেছে, তা জিডিপি-র ১৩ শতাংশ। ধারাবাহিক বৃদ্ধির চেষ্টা থাকবে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী আরও জানান, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে বদ্ধপরিকর সরকার।অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সমস্ত জেলায় স্বাস্থ্য ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হবে। শিশুদের পুষ্টিকরণে বিশেষ গুরুত্ব, গ্রামাঞ্চলে ১৭ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। নির্মলার বাজেটে পরিবেশ রক্ষায় ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ১ লক্ষ ৪১ হাজার কোটি বরাদ্দ স্বচ্ছ ভারত অভিযানে। কোভিড প্রতিষেধকের জন্য বরাদ্দ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে খরচ ১৩৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব। মোট ২ লক্ষ ৮৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করছে সরকার। উন্নত মানের জামাকাপড় তৈরি করতে টেক্সটাইল পার্ক তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে খরচ আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী জানান, ২০টি বড় শহরে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে।জাতীয় সড়ক নির্মাণের কাজ বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কলকাতা-শিলিগুড়ি রাস্তা সংস্কার, পশ্চিমবঙ্গের রাস্তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। ৬৭৫ কিলোমিটার সড়ক তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। খড়্গপুর থেকে বিজয়ওয়াড়া ফ্রেট করিডর নির্মাণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে একাধিক বেসরকারি সংস্থাকে। সৌরশক্তি খাতে আরও ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। জাপান থেকে জাহাজ এনে পুনর্নিমাণ করা হবে, তাতে দেড় লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সেবি আইনে পরিবর্তন করা হবে, পরিবর্তন আনা হবে বিমা আইনেও। বিমা সংস্থায় ৭৪ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ, আগে যা ছিল ৪৯ শতাংশ। বিমা রাশি ১ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে করা হল ৫ লক্ষ। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ছোট কোম্পানি এবং স্টার্ট আপ সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কোম্পিনজ অ্যাক্টে সংশোধন আনা হবে। সরকারি ব্যাঙ্কে পুনরুজ্জীবন খাতে ২০ হাজার কোটি বরাদ্দ করা হচ্ছে। এলআইসি-র শেয়ার খোলা বাজারে কেনা যাবে।১.১০,০৫৫ কোটি রেল খাতে বরাদ্দ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এয়ার ইন্ডিয়ার বিলগ্নিকরণ হবে ২০২২ সালে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কৃষক কল্যাণে বদ্ধপরিকর সরকার। কৃষিক্ষেত্রে ২০২২-এর মধ্যে কৃষকদের ঋণ বরাদ্দ বেড়ে ধার্য ১৬.৫ লক্ষ কোটি। ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কৃষকদের জন্য। গমের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হিসেবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কৃষকদের জন্য, ৪৩.৬ লক্ষ কৃষক উপকৃত হবেন। তুলো, গম এবং ডালজাতীয় শষ্যে বাড়ানো হয়েছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের লেহ্-তে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ৩৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তফসিলি জাতি ও উপজাতি পড়ুয়াদের জন্য। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় ১৫ হাজার স্কুলের উন্নয়ন করা হবে। আদিবাসী এলাকায় ৭৫০ নয়া একলব্য মডেল স্কুল খোলা হবে। সরকারি নথি সব প্রাদেশিক ভাষায় তৈরির জন্য জাতীয় অনুবাদ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন নির্মলা। অর্থাৎ জাতীয় অনুবাদ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। যাতে সরকারি নথি সব প্রাদেশিক ভাষায় পড়া যায়। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সৈনিক স্কুল হবে পিপিপি মডেলে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বেসরকারি স্কুল এবং রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে ১০০টি নতুন সৈনিক স্কুল খোলা হবে।চা শ্রমিকদের কল্যাণে ১ হাজার কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের চা শ্রমিকরা উপকৃত হবেন, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে -রাজস্বে ঘাটকতি হয়েছে ডিডিপির ৯.৫ শতাংশ। আগামী অর্থবর্ষে আর্থিক ঘাটতি ডিডিপি-র ৬.৮ শতাংশ করার পরিকল্পনা। ৭৫ বা তার বেশি বয়স হলে আয়করে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ৭৫ বা তার বেশি বয়সি যাঁরা পেনশন পান ও ব্যাঙ্কের সুদের উপর নির্ভর করেন, তাঁদের আইটি রিটার্ন করতে হবে না। শেয়ার ডিভিডেন্ট থেকে কাটা হবে না টিডিএস। পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বল্প ভাড়ায় ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। জিএসটি খাতে রেকর্ড টাকা সংগ্রহ হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত গৃহঋণের সুদে ১.৫ পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্টার্ট আপগুলিকে আরও একবছর কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.