পেট্রোলিয়াম অর্থনীতি

এই নিবন্ধ তিনটে ভাগে ভাগ করছি প্রথমভাগে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের দাম কেন বাড়িয়ে রাখে বিভিন্ন দেশ, দ্বিতীয়, আমাদের কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলি কেন পেট্রোপণ্যের উপর কর কমাতে রাজি নয়? এবং শেষে পেট্রল, ডিজেলের দাম বাড়লে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কতটা বাড়ে এবং তার অন্যায় সুযোগ কে নেয়?

প্রথমে বলি, সরকার চাইছে জনগণ তেলের ব্যবহার কমান l পেট্রোলিয়াম দ্রব্য মূলতঃ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় ডলার খরচ করে l আর প্রতি ব্যারেল তেল কেনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুদ্রার মূল্য ডলারের তুলনায় কমতে থাকে l আর ভারত সরকার আগামী দিনে টাকার দাম আর কমতে দিতে রাজি নয় l ভারতের কাছাকাছি যাদের জিডিপি ( ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান ) তাদের সবারই তেলের দাম ভারতের চেয়ে বেশী l ব্যতিক্রম, আমেরিকা ও চীন l আমেরিকার সুবিধা হল সারা পৃথিবীর তেল মার্কিন ডলারেই বিক্রি হয়, ফলে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ভয় তাদের নেই l লাভ একমাত্র তাঁদেরই l তবু ওরা নিজেদের তেল আমদানি কমিয়ে সোয়াবিন তেল থেকে তৈরি জ্বালানি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে l আর একনায়কতান্ত্রিক চীন তাদের দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষের উপর পেট্রল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে আছে শুধুমাত্র বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার ঠিক রাখতে l ওই দেশের বহু মানুষ ক্ষমতা থাকলেও সাইকেল চালাতে বাধ্য l এরা প্রত্যেকে বিকল্প শক্তির সন্ধানে আছে l কেউ সিএনজি, কেউ বৈদ্যুতিক গাড়ি l প্রত্যেকে লিথিয়াম থেকে বিভিন্ন রেয়ার আর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে l ভারত সরকারও চাইছে, জনগণ বিকল্প খুঁজুক l

আরও একটি আর্থিক কারণ আছে এবং সেটি রাজস্ব সম্পর্কিত l একদিকে গত কয়েকবছরে ভারত সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, পরিকাঠামো এবং গবেষণা খাতে বরাদ্দ বহুগুনে বৃদ্ধি l খরচ বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প তথা জীবনবীমা, বিভিন্ন সাধারণ বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, কৃষি বীমা ইত্যাদি খাতে, কিন্তু কোথা থেকে আসবে এই টাকা? সরকার কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর মানুষের উপর এই মুহূর্তে বসানো ঠিক বলে মনে করছেন না। তাছাড়া আমাদের মত দেশে চাকুরীজীবিদের বাইরে আয়কর জোগাড় করা বেশ কঠিন কাজ। আবার, কর্পোরেট কর বাড়ালে বিদেশী বিনিয়োগ সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যাবে l মার খাবে শিল্প ও বাণিজ্য l বাড়বে বেকারত্ব l জিএসটি বাড়ালে প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যে l সেক্ষেত্রে সরকারকে তার সীমিত বিকল্পগুলির মধ্যে অর্থের সংস্থান করতে হয়েছে l বাকী রাস্তাগুলি হল, এক, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আংশিক বা সম্পূর্ণ বিলগ্নিকরণ l দ্বিতীয়টি হল পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যের ওপরে শুল্ক বসানো l এক্ষেত্রে কর ফাঁকির কোন ব্যাপার নেই l বড় লোক বেশী খরচ করবে, করও বেশী দেবে l কোন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট এসে তাকে রক্ষা করতে পারবেন না l আর আছে, টাকা ছাপানোর রাস্তা l সরকার তৃতীয় রাস্তা সযত্নে পরিহার করেছেন l আজকে সবকটা রাজ্য এবং কেন্দ্র সবাই তাঁদের রাজস্ব আয়ের এই রাস্তা তাই বন্ধ করতে চায় না l

কিন্তু, পেট্রল ডিজেলের দামের প্রভাব অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে কতটা? পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আলু পটলের মূল্যবৃদ্ধির সম্পর্ক খুবই কম l পেট্রোলের দাম 100 টাকা থেকে বেড়ে 200 টাকা হয়ে গেলেও, আলু পটলের দাম খুব বেশী হলে 20% বাড়তে পরে l কিন্তু এই দামের যখন তিনগুন চারগুন বৃদ্ধি হয়েছে অর্থাৎ 200% থেকে 300% বেড়েছে, তখন তার কারণ আলাদাভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন l এর কারণ মূলতঃ দুটি l এক, অতিবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি দুই, ফোঁড়ে রাজ l ফোঁড়ে রাজ এই রাজ্যের এমন রোগ তৈরি করেছে যে জেলার পর জেলায় জমির মালিকরা জমি চাষ না করে ফেলে রাখছে এবং কৃষকরা অন্যরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে l কারণ দাম পাচ্ছেন না চাষীরা l অথচ বাজার দর অগ্নিমূল্য l কারণ, বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বড়বাজারের কিছু অসৎ ব্যবসায়ী l

রাজ্যকে এখনই কেন্দ্রীয় কৃষিনীতি অনুসরণ করে চাষীদের হিমঘর খোলা, বিদেশী রিটেল কম্পানিকে আমন্ত্রণ করা এবং আমুলের মত সমবায় বানিয়ে কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করা উচিৎ l অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন থেকে উদ্ভুত দুর্নীতির ফলে, হিমঘর শিল্পে কোন সৎ ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করতে রাজি নয় l কৃষি জমি ফেলে রাখার প্রবণতা আরও বাড়ছে l আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহার গত 15 বছরে রফতানি বাড়িয়েছে 800 গুন l হ্যাঁ আটশ গুন l

পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে একটা তথ্য আমাদের জানা দরকার , আমাদের দেশে 2013 তে মুদ্রাস্ফীতি ছিল প্রায় 11%, আর এখন 5%,!! 2004 থেকে 2014, পেট্রোলের দাম 105% বেড়েছে, আর গত সাত বছরে 50% l গত সাত বছরে ফ্ল্যাট বাড়ির দাম বেড়েছে সামান্য l গাড়ির দাম ২০১৪ আর ২০২১ এ প্রায় একই l খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের মুদ্রাস্ফীতি ন্যূনতম রেখে পেট্রোলের দাম বাড়িয়ে যদি দেশের ভালো করা যায় ক্ষতি কি? যে সাংবাদিকরা বার্ষিক 10% পেট্রল ডিজেল মূল্যবৃদ্ধিকে 300% খাদ্যদ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কারণ বলে সংবাদ পরিবেশন করছেন, তাদের একটা হিসেব দি l পেঁয়াজের দাম যখন 20 টাকা, তখন পরিবহনের খরচ মেরে কেটে 3 টাকা l আর এই তিন টাকার মধ্যে চালকের মাইনে ইত্যাদি বাদ দিয়ে তেলের খরচ দাঁড়ায় 90 পয়সা l এর সঙ্গে যদি ট্র্যাক্টর এবং সেচে ব্যবহৃত পাম্পের ডিজেল খরচ যোগ করি, মেরে কেটে তিন টাকা l যদি এক লিটার ডিজেলের দাম 100 থেকেবেড়ে 200 টাকাও হয়ে যায়, পেঁয়াজের দাম বাড়বে আরও তিন টাকা মাত্র l অর্থাৎ পেঁয়াজের দাম হবে 23 টাকা l কিন্তু সেই পেঁয়াজ যদি বাজারে 40 টাকায় বিক্রি করা হয়, তবে 17 টাকা কার পকেটে গেলো!! ফোঁড়ে, নেতা, কৃষি বিপণন দপ্তরের বাবু এবং এবং অনুপ্রাণিত সংবাদপত্রের মালিকদের পকেটে না তো?

মোদীজি শিক্ষা, গবেষণা ও স্বাস্থ্যে উত্তরোত্তর বরাদ্দ বাড়াচ্ছেন l মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু গবেষণার পেটেন্ট থেকে যে টাকা আয় করে তা ভারতের জিডিপির চেয়ে বেশী l এই প্রবণতার পরিবর্তন করতে গেলে কিছু খরচা জনগণকে করতে হবে l ভারতে ন্যাচারাল রিসোর্স অপর্যাপ্ত এবং মানব সম্পদই আমাদের সম্পদ l খরচা বাড়াতে হবে এবং তার জন্য রাজস্ব বাড়াতে হবে l তেল এমন একটা জায়গা, যেখানে একদিকে রাজস্ব ফাঁকি অসম্ভব, অন্যদিকে তেলের ব্যবহার কমালে মজবুত হবে দেশের মুদ্রা l আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে প্রভাব সামান্য l ফলে, এব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবার কিছু নেই l বৈদ্যুতিক গাড়িই আগামী দিনে আমাদের এই সংকট থেকে মুক্ত করবে l ততদিন দেশ গড়ার কাজে একটু অতিরিক্ত রাজস্ব দিতে হবে l

সুদীপ্ত গুহ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.