পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি : কতটা অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক ?

বিগত কয়েকদিন ধরে দেশের কিছু লোক সমস্বরে গেল গেল রব তুলছে । কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধি কতটা অস্বাভাবিক সে বিষয়ে কিছুটা পর্যালোচনা করার দরকার আছে বৈকি। বস্তুত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো তেলের বর্তমান দরের সাথে ২০০৮ সালের তেলের দরের তুলনা করছে। কারণ সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের গড় দর ছিল ১২৫ টাকার মতো। আর পেট্রোলের গড় দর ছিল ৫২ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্চ করছেনা তা হলো মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে টাকার তৎকালীন দর। সেই সময় এক ডলারের মূল্য ছিল গড়ে ৪০টাকার মতো। সেই হিসেবে এক ব্যারেল অপিরিশোধিত তেলের দাম ছিল প্রায় ১২৫ × ৪০ = ৫০০০ টাকার মতন। বর্তমানে এক ব্যারেল অপিরিশোধিত তেলের দাম ৬৪ ডলার। একই সাথে এক ডলারের মূল্য ৭৪ টাকা। অর্থাৎ এক ব্যারেল অপিরিশোধিত তেলের জন্য ভারতীয় মুদ্রায় খরচ প্রায় ৬৪ × ৭৪ = ৪৭৩৬ টাকা। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় তেল কিনতে খরচ কম হচ্ছে মাত্রই ২৬৪টাকার মতন। এক ব্যরেলে তেল থাকে প্রায় ১৫৯ লিটার। অর্থাৎ প্রতি লিটার তেল কিনতে ভারতীয় মুদ্রায় কম খরচ হচ্ছে ১.৬৬ টাকার মতন।
অর্থাৎ বিরোধীরা বলতেই পারে যে তেল কিনতে যেহেতু হরে দরে প্রায় কাছাকাছি একই টাকা খরচা হচ্ছে তাহলে সেই সময়ের দামই নেওয়া হোক। কিন্তু এর সাথে ভুলে গেলে চলবেনা মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবের কথা। ২০০৮ থেকে আজ পর্যন্ত টাকার মূল্য হ্রাস হয়েছে ১৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০০৮ সালে ১০০টাকা দিয়ে যে সামগ্রী ক্রয় করা যেত তার খরচ বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ২৫৬ টাকা। অর্থাৎ ৫২ টাকার বর্তমান বাজার দর ১৩৩টাকা। সুতরাং টাকার মূল্যে তেলের ক্রয়মূল্য ২০০৮ সালের কাছাকাছি হলেও উৎপাদন খরচ বা অন্যান্য আনুসাঙ্গিক খরচ এবং এর সাথে সরকারের বিভিন্ন করের যোগফল ২০০৮ সালে পেট্রোপণ্যের সাপেক্ষে আনুপাতিক হিসেবে অস্বাভাবিক মোটেই নয়, বরং বেশ কিছুটা নিচেই আছে।

মনে রাখতে হবে যে তেলের মূল্যের সাথে কেন্দ্র সরকারের সাথে সাথে রাজ্য সরকারের করের অংশও কিন্তু প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তাছাড়া এই কর বসানোর প্রবণতা যে বিজেপি সরকার এসেই চালু করেছে তা কিন্তু নয়। কংগ্রেস বা ইউপিএ সরকারের সময়ও বিভিন্ন কর চাপানো হত। গত এক বছরে সরকারকে করোনার মতো মহামারীর সম্মুখীন হযে হয়েছে যখন সরকারকে অকাতরে ফ্রী রেশন, গ্যাস ও অন্যান্য সুবিধা বন্টন করতে হয়েছে। সরকারের কাছে উপায় কি ছিল এই অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ? সরকার যদি জোর করে নোট ছাপাতে যায় তাহলে টাকার অবমূল্যায়ন হবে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার মূল্য আরো হ্রাস পাবে। তাতে তেল কিনতে আরো বেশি খরচ হবে । যার ফলে তেলের দামও তখন স্বাভাবিক ভাবেই বাড়বে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে ভারতীয় অর্থনীতি কিন্তু চীনের মতন রপ্তানি নির্ভরশীল নয় যে টাকার মূল্যকে অবাধে পড়তে দেওয়া যায়, সমগ্র অর্থনীতিই তাহলে ভেঙে পড়বে। চীনের মতো অসদুপায়ে টাকার মূল্য স্থির করাও এদেশে সম্ভব নয়। এই সরকার যদিও সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে আমদানিতে রাশ টেনে দেশকে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নতুন করে গড়ে তুলতে, কিন্তু এত বড় দেশের জন্য তা স্বাভাবিক ভাবেই সময় সাপেক্ষ। অতএব সরকারের হাতে এই মুহূর্তে বিকল্প কি?

বর্তমানে সরকার যেভাবে এই অভূতপূর্ব অতিমারীর বিরুদ্ধে জেতার জন্য বুক চিতিয়ে এক অসম লড়াই করছে তাতে কিছু অসুবিধে একেবারেই কি অস্বাভাবিক ? সমস্ত দায়িত্ব কি সরকারের কি একার ? দেশবাসী হিসেবে আমাদের কি কিছু কষ্ট সহ্য করার দায়িত্ব নেই ? অথচ এত প্রতিকূলতার মধ্যেও মোদি সরকার পেট্রোপন্য গুলোকে জিএসটির আওতায় এনে তেলের মূল্য কমাতে সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু সেখানে বাঁধ সেধেছে বিরোধী রাজ্য সরকার গুলোই। সুতরাং তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে গেল গেল রব গেল তা অর্থনৈতিক দিক দিক দিয়ে কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে বৈকি। রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও একই ভাবে অনিবার্য ছিলই। মূল্যবৃদ্ধির সূচকের হিসেবে গ্যাসের দামও ২০০৮ সালের তুলনায় বহু নীচে আছে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে গত ১৩ বছরে প্রত্যেক দেশবাসীর গড় আয়ও তিন গুণ এর অধিক করে বেড়েছে।
প্রসঙ্গত আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিন দুয়েক আগে ইলেক্ট্রিক স্কুটিতে চেপে নবান্ন যাওয়ার যে কুম্ভীরাশ্রু প্রদর্শন করলেন তার থেকে যদি উনি রাজ্যের সেস কমিয়ে দাম কমাতে সচেষ্ট হতেন তাহলেই সেটা কাজের কাজ হতো। আজকে পেট্রোপন্য গুলোকে জিএসটির আওতায় আনতে গেলে সবচেয়ে বেশি যিনি বিরুদ্ধে গলা ফাটাবেন তিনি নিশ্চিন্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার একই সাথে এই কথার উল্লেখ করাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুতের দর সারা ভারতের মধ্যে সর্বাধিক। অথচ এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চুপ। কেন রাজ্যে সিইএসসি একচেটিয়া ভাবে অস্বাভাবিক মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, কেন অন্য কোনো বিনিয়োগকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়না সে ব্যাপারে পর্যালোচনা বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই সরকারের তেলের ব্যবহারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি। দিন কয়েক আগে পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গডকরী স্পষ্টই বলেছেন যে দেশকে আমদানিকৃত তেল নির্ভরতা থেকে বার করতেই হবে এবং পরিবেশ বান্ধব বৈদ্যুতিক পরিবহন ব্যবস্থাই একমাত্র বিকল্প দেশের সামনে। কর ছাড় সহ বিবিধ উৎসাহ এই সরকার প্রদান করছে যাতে দেশ সুনির্দিষ্টভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। সরকারি উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচুর বিনিয়োগও হচ্ছে এই ক্ষেত্রে। তবে এই মুহূর্তে তেলের দাম কিছুটা কমানো গেলে সাধারণ মানুষের অবশ্যই কিছুটা সুবিধে হয়। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেট্রোপন্যগুলোকে জিএসটির আওতায় আনা হবে তত তাড়াতাড়ি সাধারণ মানুষের সুরাহা হয় বিশেষত যেখানে দেশ এখনও করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে পুরোপুরিভাবে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.