রোগী মরিয়াছে, কিন্তু নিজের নিদানের উপর কবিরাজের ভরসা টোল খায় নাই— নির্মলা সীতারামনের সাম্প্রতিক আর্থিক প্যাকেজকে এই মর্মে ব্যাখ্যা করা যাইত। কিন্তু, এই ব্যাখ্যাটিতে কবিরাজের মনের ছবিটি ধরা পড়িবে না। নির্মলা সীতারামন বা তাঁহার প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানিতেন যে, তাঁহারা যে দাওয়াই প্রয়োগ করিতেছেন, তাহাতে অর্থব্যবস্থার প্রাণরক্ষা হইবে না। অর্থশাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক তাহা বলিয়াছে; দুনিয়ার সকল অর্থশাস্ত্রী কার্যত এক বাক্যে সেই দাওয়াইয়ের বিপক্ষে মত দিয়াছেন; এবং গত বৎসরের আর্থিক প্যাকেজের অভিজ্ঞতা বলিয়াছে যে, চাহিদা যখন তলানিতে, তখন জোগান বাড়াইবার আর্থিক নীতি নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। তাহার পরও এই বৎসর অর্থমন্ত্রী ঢাক-ঢোল পিটাইয়া একই দাওয়াই প্রয়োগ করিয়াছেন— তাহা দাওয়াইয়ের কার্যকারিতায় বিশ্বাসের কারণে নহে, এই দাওয়াইটির ব্যবস্থা করাই সহজতম বলিয়া। অর্থমন্ত্রীর এই দফার আর্থিক প্যাকেজেও মূলত ঋণের ব্যবস্থা রহিয়াছে— তাহাও, বহু ক্ষেত্রে শুধু এই বৎসরের জন্য নহে, আগামী দুই-চার বৎসর মিলাইয়া। অর্থমন্ত্রী যত টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করিতেছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহার সামান্য অংশই রাজকোষ হইতে বাড়তি ব্যয় করিতে হইবে। অর্থাৎ, দেদার খরচ করিবার ভঙ্গিমাটুকু থাকিবে, আসলে খরচ করিতে হইবে না। এই দ্বিচারিতা, এই অন্তঃসারশূন্য দেখনদারিই মোদী জমানার অভিজ্ঞান। আশঙ্কা হয়, কর্তারা হয়তো ধরিয়া লইয়াছেন যে, দৃশ্য রচনা করাই তাঁহাদের একমাত্র কর্তব্য। তাহাতে যদি দেশের সর্বনাশ হয়, তাহাতেও আপত্তি নাই।
এই দফার প্যাকেজে অর্থমন্ত্রী যে ব্যবস্থাগুলি করিয়াছেন, তাহার সবই যে আপত্তিজনক, তাহা নহে। আটটি মহানগরের বাহিরে দেশের অন্য কোনও অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিবার জন্য সস্তায় ঋণ; অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য ঋণের বরাদ্দ বৃদ্ধি; ক্ষুদ্র ঋণের চড়া সুদ হইতে গরিব মানুষকে নিষ্কৃতি দিবার কিছু ব্যবস্থা ইত্যাদি লইয়া সাধারণ ভাবে আপত্তির কারণ নাই। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গঠনে ভর্তুকি দিবার বদলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তির উদ্যোগই কি কাম্য ছিল না? তাহাতেই কি অধিকতর মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আনিবার সুবিধা হইত না? প্রশ্নটি উড়াইয়া দিবার নহে। কিন্তু, ঘুরপথে বৃহৎ-অতিবৃহৎ পুঁজিকে আর্থিক সাহায্য করিবার পরিবর্তে যদি সত্যই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের জোগান বাড়ে, যদি সেই ব্যবসায় কার্যনির্বাহী পুঁজির সংস্থান হয়, তাহাতে আপত্তি করিবার প্রশ্ন নাই।
কিন্তু, প্রশ্নটি যেখানে অর্থব্যবস্থাকে ফের সচল করিয়া তুলিবার, সেখানে এই ব্যবস্থাগুলি নিতান্তই অকার্যকর। অর্থব্যবস্থার মূল সমস্যা চাহিদার ঘাটতি। শুধু অতিমারির কারণেই নহে, মোদী সরকারের হরেক ব্যর্থতার খেসারত গনিয়া ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় চাহিদা অতিমারি শুরু হইবার পূর্বেই নিম্নাভিমুখী হইয়াছিল। অর্থশাস্ত্রীরা এক বাক্যে জানাইয়াছেন, চাহিদা ফিরাইয়া আনিতে হইলে মানুষের হাতে নগদ টাকার সংস্থান করিতে হইবে— কর্মসংস্থান যোজনার মাধ্যমে তো বটেই, অন্য ভাবেও কাজের ব্যবস্থা করিয়া, প্রয়োজনে বিনা শর্তে মানুষের হাতে টাকা তুলিয়া দিয়া। কেন্স সাহেবের ভাষায় বলিলে, গর্ত খুঁড়িতে টাকা খরচ করিবার পর সেই গর্ত বুজাইতে ফের খরচ করিতে হইবে। মানুষের হাতে যদি টাকাই না থাকে, তাহার যদি ক্রয়ক্ষমতাই না থাকে, তবে ঋণ যত সস্তাই হউক, কোন ব্যবসায়ী ঋণ লইয়া ব্যবসার আয়তন বাড়াইতে চাহিবেন? নির্মলা সীতারামনরা গত বারও এই গোড়ার প্রশ্নটির উত্তর খোঁজেন নাই, এই বারও নহে। তাহাতেই সন্দেহ হয় যে, উত্তরটি তাঁহারা শুনিতে চাহেন না। অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যোদ্ধার অপেক্ষা খরচের বিভ্রম সৃষ্টিতেই তাঁহাদের আগ্রহ অধিক।