নিষিদ্ধ হলেও কলকাতার পানশালায় চলছে নাচ, দেদার টাকা ওড়ানো! কত দূর পৌঁছয় টাকার ভাগ?

ঘড়িতে তখন রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। ফাঁকা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের এক জায়গায় মোটরবাইক ও গাড়ির জটলা। হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেই খোলামেলা পোশাকে গাড়ির কাচের দিকে ঝুঁকে কথাবার্তা চালাচ্ছেন কয়েক জন তরুণী। মাঝেমধ্যে রাস্তার ধারের একটি পানশালার দরজা খুলে গেলে শোনা যাচ্ছে ভিতরে তারস্বরে বাজতে থাকা সাউন্ডবক্সের আওয়াজ।

সাধারণত রাত ১২টার মধ্যে পানশালা বন্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু আদৌ সে সব নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতেই শনিবার রাতে বেরোনো হয়েছিল কলকাতার রাজপথে। শহরের নানা এলাকা ঘুরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ওই পানশালায় প্রবেশ করতেই দেখা গেল বিধিভঙ্গের একাধিক ছবি। কলকাতায় পানশালায় লাইসেন্স নেওয়া থাকলে গান নিষিদ্ধ না হলেও নাচ বারণ। অথচ সেখানে তখন পুরোদমে চলছে ‘ডান্স বার’। উঁচু মঞ্চে কয়েক জন তরুণীর কেউ খোলামেলা, কেউ আঁটোসাঁটো পোশাক পরে নাচছেন। আর সামনের সারিতে বসে থাকা কেউ কেউ সটান উঠে যাচ্ছেন মঞ্চে। কিন্তু এই দৃশ্যের যাতে কোনও ছবি বা ভিডিয়ো না করা হয়, সে দিকে কড়া নজর রয়েছে পানশালার কর্মীদের।

এর মধ্যেই এক তরুণী মঞ্চ থেকে নেমে শৌচালয়ের দিকে যেতে গেলে তাঁকে আটকালেন এক ব্যক্তি। দ্রুত তরুণীকে ফের মঞ্চে ওঠার নির্দেশ দিলেন তিনি। কারণ বোঝা গেল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। সামনের সারিতে বসে থাকা মাঝবয়সি এক ব্যক্তি ৫০০ টাকার কয়েকটি নোট বার করে দিলেন এক যুবকের হাতে। তিনি সেই নোট ওড়াতে থাকলেন ওই তরুণীর দিকে লক্ষ্য করে। এ জিনিসও তো নিষিদ্ধ! একই ছবি ধরা পড়ল উত্তর এবং মধ্য কলকাতার একাধিক পানশালাতেও। দক্ষিণ শহরতলি এবং সংযুক্ত এলাকার পরিস্থিতিও কিছু আলাদা নয়। তবে ব্যতিক্রম বাগুইআটি, কেষ্টপুর বা চিনার পার্কের পানশালাগুলি। নাচ তো নয়ই, রাত সাড়ে ১১টার মধ্যেই সেগুলির প্রায় সব ক’টি ফাঁকা।

রাতের পানশালার এই পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর করতে জানা গেল, নিয়মকানুন রয়ে গিয়েছে খাতায়কলমেই। বরং বাস্তবে চলতে থাকে বেপরোয়া রাতযাপনের ‘সেটিং ব্যবসা’। কয়েক বছর আগে একাধিক অপরাধমূলক কাজকর্মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট এলাকায় শুরু হয়েছিল ‘অপারেশন ডান্স বার’। তাতে নাজেহাল অবস্থা হয় পানশালার মালিকদের। বড় ধাক্কাও খায় এলাকার সিন্ডিকেট ব্যবসা। অনেকের দাবি, তার রেশ এখনও রয়েছে।

কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি কলকাতা পুলিশ এলাকায়। এ বিষয়ে সেখানে সে ভাবে কড়াকড়িই করা হয়নি। কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, আগে গানের আসর বসাতে পানশালাকে আবগারি দফতর থেকে ‘ক্রুনার লাইসেন্স’ নিতে হত। এখন তা বাধ্যতামূলক না হলেও পানশালার গায়কদের যাবতীয় পরিচয়পত্র-সহ নথি স্থানীয় থানা ও পাস সেকশনে জমা রাখতে হয়। তার পরেও একাধিক নিয়ম রয়েছে। যেমন, পানশালার গায়কের থেকে অতিথিদের বসার জায়গার মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব রাখতে হবে, যৌন উদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি করা ও টাকা ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গান ভাল লাগলে বখশিস দিতে হবে পানশালার কোনও কর্মীর মাধ্যমে।

‘হোটেল অ্যান্ড রেস্তরাঁ অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’-র অনারারি সেক্রেটারি প্রণব সিংহ বললেন, ‘‘গানের আসরের নামেই অনেক জায়গায় নাচ চলছে। তবে নাচের আড়ালে অনেক কিছু চলতে থাকে। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মহারাষ্ট্রের পানশালায় নাচ নিষিদ্ধ হলে এ শহরেও কয়েক দিন তা নিয়ে শোরগোল চলেছিল। কিন্তু তার পরে যে-কে-সেই!’’ স্পেশাল এক্সাইজ় কমিশনার (এনফোর্সমেন্ট) সুব্রত বিশ্বাস আবার বললেন, ‘‘আবগারি দফতর থেকে অনুমতি নেওয়া হলেও তাতে গান বা নাচ নিয়ে আলাদা ভাগের ব্যাপার থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই এর সুযোগ নেওয়া হয়। এখন কোথাও নাচ চলে বলে শোনা যায় না। তবে কোথাও কোথাও গোপনে হতে পারে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আসলে নাচ-গানের পিছনে অন্য অঙ্ক রয়েছে। পানশালার জায়গা ভাড়া নেন ব্যান্ড মাস্টার, তিনিই গান বা নাচের লোক ঠিক করেন। খাবার ও পানীয়ের খরচ বাদে পানশালায় যে প্রচুর পরিমাণ নগদ টাকা ওড়ে, তা ভাগাভাগি হয় গায়ক-গায়িকা আর নাচের লোকের মধ্যে।’’

এই টাকার ভাগ কত দূর পৌঁছয়? এ জন্যই কি এ নিয়ে কড়াকড়ি হয় না? স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। লালবাজারের যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্তা শুধু বলেন, ‘‘থানা স্তরে এ নিয়ে কড়া নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। নতুন করে কোথাও হচ্ছে কি না, খোঁজ করছি। কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.