অনেক সময় কোনও কোনও বিষয় নিজগুণে নিজ কক্ষপথের বাইরেও প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে ওঠে। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটও সেইরকম। কেন্দ্রীয় বাজেট বরাবরই অর্থনীতি জগতের আলোচ্য ও বিচার্য। কিন্তু এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট প্রথম থেকেই অর্থনীতির চেয়ে বেশি রাজনীতি জগতের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে। স্বঘোষিত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য ছিল লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পূর্ণাঙ্গ বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। বাজেট পেশের পর তাই খতিয়ে দেখতে বড়ো ইচ্ছে করে সত্যিই এই বাজেট রাজনীতিমুখী হয়েছে, না নির্ভেজাল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভই এই বাজেটের অভিমুখ।
ভারতবর্ষ এক কল্যাণরাষ্ট্র। কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষের অন্যতম লক্ষ্য রাষ্ট্রের দরিদ্র এবং প্রান্তিকতম মানুষের কল্যাণ সাধন করা, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা। অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্যি যে এতদিন স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক পরেও দেশের দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। সরকারের বার্ষিক বাজেট তাদের কথাই মাথায় রাখতো যারা কোনও না কোনও ভাবে সংগঠিত এবং ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে আকর্ষণীয়। বর্তমান বাজেটে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য পেনশন যোজনা আনা হয়েছে। এই যোজনা অনেকটা প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিল (Contributory Provident Fund)-এর মতো। এই যোজনা অনুযায়ী যে কোনও শ্রমিক মাসে মাসে সামান্য কিছু অর্থ জমা করে গেলে সরকারও মাসে মাসে সেই ব্যক্তির নামে সমপরিমাণ অর্থ জমা করে যাবে। সেই ব্যক্তি ষাটোর্ধ্ব হওয়ার পর মাসে মাসে ৩০০০ টাকা করে পেনশন পাবেন। মাসে মাসে জমা করা অর্থের পরিমাণ ব্যক্তি যে বয়সে প্রকল্পে যোগ দিচ্ছেন সেই বয়সের ওপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ কম বয়সে প্রকল্পে যোগ দিলে যেহেতু ষাট বছর পর্যন্ত বেশিদিন ধরে টাকা জমা পড়ছে তাই মাসে মাসে জমা করা অর্থের পরিমাণও কম থাকছে। আর বেশি বয়সে প্রকল্পে যোগ দিলে মাসে মাসে জমা করা অর্থের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। এই নিয়ম অনুযায়ী ঊনত্রিশ বছর বয়সে কেউ যদি এই প্রকল্পে যোগ দেয় তাহলে মাসে মাসে মাত্র একশো টাকা করে জমা করলেই তিনি ষাটোর্ধ্ব অবস্থায় মাসিক ৩০০০ টাকা পেনশন পাবেন। বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন দুটি বিষয়ে, (১) নিয়মিত কাজের সুযোগ, (২) বৃদ্ধ বয়সের অর্থনৈতিক সুরক্ষা। গত পাঁচ বছরে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘মুদ্রাযোজনা’ ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সরকারের নানাবিধ প্রকল্পের জন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ কিছুটা হলেও বেড়েছে। এখন বর্তমান বাজেটে ঘোষিত পেনশন যোজনা তাদের বৃদ্ধ বয়সের অর্থনৈতিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করলো। অংসগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জীবনে যেন এতদিনে এই প্রথম সত্যিকারের ‘অচ্ছে দিন’ এল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পেনশন যোজনা কিন্তু তাৎক্ষণিক সুবিধাপ্রদানকারী নয়, অর্থাৎ এখনই হাতে কিছু পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা এতে নেই। বরং এখন থেকে জমা করে ভবিষ্যতে পেনশন পাওয়ার বন্দোবস্ত আছে এতে। ফলে ভোটের আগের বাজেটে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করে ভোট কেনার অভিযোগ এক্ষেত্রে অন্তত ধোপে টিকলো না।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আয় সংক্রান্ত বৃদ্ধি সবসময় কপালে ভাঁজ ফেলে মালিক পক্ষের। কারণ অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক ভাবে সমৃদ্ধতর হয়ে অসংগঠিত শ্রমিকরা মজুরি সংক্রান্ত দর কষাকষিতে মজবুত হয়। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ছোটো কৃষকরা কৃষি-মজুরদের বর্ধিত মজুরি দিতে গিয়ে নিজেরা বিপন্ন হয়। এবারের বাজেটে কৃষকদের এই সমস্যাটির সমাধানের জন্যও প্রচেষ্টা হয়েছে। ২ হেক্টর বা ৫ একর বা ১৫ বিঘার কম জমির মালিক যে সমস্ত কৃষক তাদের জন্য বছরে ৬০০০ টাকা করে দেওয়া হবে, যাতে তারা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে পারেন। বর্তমানে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ কৃষকদের আত্মহত্যার মিছিলের মধ্যে এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৃষিঋণ মকুব করে দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের সমস্যার সমাধান করার কথা গত কয়েকমাস ধরে বিরোধীরা ক্রমাগত বলে আসছেন। নির্বাচনী বৈতরণী পেরোবার পক্ষে সেই সমাধান যথেষ্ট হলেও কৃষক ও কৃষির সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ কৃষিঋণ সেইসব চাষিরাই পান যাদের অনেক জমি আছে। কিন্তু তুলনায় ছোটো জমির মালিক যে সমস্ত কৃষকরা তারা খুব কম ক্ষেত্রেই কৃষিঋণ পান। অথচ চাষ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যায় সবচেয়ে বেশি তারাই পড়েন। কৃষিঋণ মকুবের সুবিধা পেয়ে যায় বড়ো চাষিরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান নীতির ফলে ছোটো চাষিরাই (অর্থাৎ যাদের ১৫ বিঘার কম জমি আছে) লাভবান হবেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ছোটো চাষিদের সংখ্যাই বেশি। ১৫ বিঘার বেশি জমির মালিকের সংখ্যা শতাংশের হিসেবেও আসে না। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব কৃষকই এই প্রকল্পের আওতায় সুবিধা পাবেন। এই প্রকল্পে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কৃষকরা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার, বীজ ও কীটনাশক কিনতে পারবেন, ক্ষেতে উপযুক্ত সেচের বন্দোবস্তও করতে পারবেন। তাদের আর কৃষিঋণের প্রয়োজন হবে না। অনুদানে প্রদত্ত টাকার পরিমাণ নিয়ে এই প্রকল্পকে অনেকেই কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, প্রকল্পে প্রদত্ত অর্থ আপাতদৃষ্টিতে কম বলে মনে হলেও চাষের সময় ছোটো কৃষকদের কাছে এই পরিমাণ অর্থই ভীষণ প্রয়োজনীয়।
দরিদ্র এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তর কথা ভেবে পদক্ষেপ করলেও এবারের বাজেট মধ্যবিত্তের কথাও মাথায় রেখেছে। এবারের বাজেটে আয়করে প্রচুর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর আগে করমুক্ত আয়ের পরিমাণ ছিল বছরে আড়াই লক্ষ টাকা। এবারে বাজেটে তার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা। যদিও এই ব্যাপারটিকে নিয়ে নানারকম অপপ্রচার চলছে। কোনও কোনও সর্বাধিক বিকৃত দৈনিকের পাতায় এই কর ছাড়ের সম্বন্ধে রিবেট নির্ভর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে এতে পাঁচ লক্ষ টাকা বেশি আয়ের ব্যক্তিদের কোনও সুবিধা হবে না। বিশ্লেষণে একথাও বলা হয়েছে যে, এর আগে রিবেটের পরিমাণ ছিল ২৫০০ টাকা বর্তমানে রিবেটের পরিমাণ হয়েছে ১২৫০০ টাকা এটুকুই তফাত। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি তা নয়। রিবেট নির্ভর ব্যাখ্যাতেই দেখা যাক, এতদিন করমুক্ত আয় ছিল আড়াই লক্ষ টাকা, আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ট্যাক্সের পরিমাণ ছিল ৫ শতাংশ হারে মোট ১২৫০০ টাকা এর ওপর রিবেট ছিল ২৫০০ টাকা। অর্থাৎ এতদিন বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা আয় করা ব্যক্তি ট্যাক্স দিতেন বছরে ১০০০০ টাকা আর বছরে ছয় লক্ষ টাকা আয় করা ব্যক্তি ট্যাক্স দিতেন বছরে ৩০০০০ টাকা [{(৬০০০০০-৫০০০০০) X ২০/১০০}+ ১০০০০]। বর্তমান নিয়মে রিবেট নির্ভর ব্যাখ্যাতে করমুক্ত আয় রইল আড়াই লক্ষ টাকা, আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ট্যাক্সের পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে মোট ১২৫০০ টাকা এর ওপর রিবেট হলো ১২৫০০ টাকা। অর্থাৎ বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ট্যাক্সের পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে মোট ১২,৫০০ টাকা। এর ওপর রিবেট হলো ১২,৫০০ টাকা। অর্থাৎ বছরে ৫ লক্ষ টাকা আয় করা ব্যক্তি ট্যাক্স দেবেন বছরে ০ টাকা (অর্থাৎ ট্যাক্স দেবেন না) আর বছরে ছয় লক্ষ টাকা আয় করা ব্যক্তি ট্যাক্স দেবেন। বছরে ২০০০০ টাকা {(৬০০০০০৫০০০০০) X ২০/১০০}। অর্থাৎ বছরে পাঁচ লক্ষ টাকার কম এবং বেশি আয় করা উভয় প্রকার ব্যক্তিই এর ফলে উপকৃত হবেন। অর্থবরাদ্দের দিক দিয়ে তুলনায় ন্যূন হলেও এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে ঘোষিত আরেকটি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো কামধেনু যোজনা। এই যোজনার ফলে দেশের মোট দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বাজারের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্য হাস পাবে। অর্থাৎ দুধের দাম কমবে ফলে গরিষ্ঠসংখ্যক দেশবাসী পর্যাপ্ত পরিমাণে দুগ্ধসেবনে সক্ষম হবে। ফলস্বরূপ আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে শিশুরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি (স্বাধীনতার সাত দশক পরেও যা পর্যাপ্ত নয়) পাবে। ফলে মানবসম্পদের উন্নতি ঘটবে এবং দেশবাসীর শারীরিক ও বৌদ্ধিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নতি তো ঘটবেই, তার সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ও সাধিত হবে।
এতক্ষণ ধরে বাজেটের একটি দিক অর্থাৎ ব্যয়ের দিক নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল, আলোচনার প্রতি মুহূর্তেই পাঠক সাধারণের মনে এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঁকি মেরেছে যে সরকার ব্যয়ের ব্যাপারে এত উদার হচ্ছে কী করে? প্রশ্নটির উত্তর দিতে হলে আমাদের তাকাতে হবে বাজেটের অপর দিক অর্থাৎ আয়ের দিকে, দেখতে হবে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার আয় বৃদ্ধি করলো কী করে? আর দেখতে গিয়ে আমরা এ প্রশ্নের উত্তর পাবো অতীতের পাতায়। বিমুদ্রীকরণের সময় বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে হিসেব-বহির্ভূত যে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা পড়েছিল, আয়কর দপ্তরের চিরুনি তল্লাশিতে যে টাকার ওপর ধার্য আয়কর দেশের মোট আদায়ীকৃত আয়করের পরিমাণ অর্থাৎ বাজেটের খাতায় সরকারের আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে ও সরকারি আয়-ব্যয় ঘাটতি সামলে জনস্বার্থে এত খরচ করার সুযোগ দিয়েছে।
বাজেট কথাটার আক্ষরিক অর্থ হলো শুধুমাত্র আয়-ব্যয়ের হিসেব কিন্তু এবারের বাজেট তার মৌলিক বিশেষত্বের কারণে শুধুমাত্র শুষ্ক হিসেবের কচকচির বদলে হয়ে উঠেছে জাতীয় অর্থনীতির দিনবদলের দিকনির্দেশক।
অম্লানকুসুম ঘোষ