হাম্পি একটি সুপ্রাচীন, শিক্ষিত , রুচিশীল এবং আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন ঐতিহাসিক মন্দির স্থাপত্যের নগর। হাম্পি ভারতের কর্ণাটক এর উত্তরে অবস্থিত একটি গ্রাম। হাম্পির স্মারকসমূহ হল উত্তর কৰ্ণাটকের মনোরম বিলাসবহুল হাম্পি নগরের স্মারকসমষ্টি। হাম্পিতে বিজয়নগর সাম্ৰাজ্যের অধুনালুপ্ত রাজধানী বিজয়নগরের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। এই নগরের চারদিকে দ্ৰাবিড় স্থাপত্য মন্দির এবং প্ৰাসাদের ধ্বংসাবশেষে দেখা যায়। চতুৰ্দশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবৰ্তী সময়ে যেসকল পৰ্যটক ভারতে এসেছিলেন,তারা সকলেই এই মন্দিরসমূহের ভূয়সী প্ৰশংসা করে গেছেন । হাম্পিতে অনেক গুরুত্বপূৰ্ণ হিন্দু মন্দির আছে। এখানে বিরুপাক্ষ মন্দিরসহ একাধিক স্মারক অবস্থিত। তাছাড়া ও রয়েছে অনেক অভিজাত বাসগৃহ, হাতী বন্ধা ঘর, রাণীর আভিজাত স্নানাগার, লোটাস মহল ইত্যাদি।
তুঙ্গভদ্রার তীরে চোদ্দোশো থেকে ষোলোশো শতাব্দীর বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাম্পি৷ পুরাণমতে দক্ষ যজ্ঞের পরে সতী দেহত্যাগ করে আবার জন্মগ্রহণ করেন ব্রহ্মার কন্যা রূপে -নাম হয় পম্পা৷ পম্পার নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই হাম্পির নামের ইতিহাস৷ কাহিনি অনুযায়ী পম্পা যৌবনে পৌঁছে ঘোর তপস্যার পর শিবকে পতি রূপে লাভ করেন এবং তাদের বিবাহ হয় যেখানে তার নাম হয় পম্পাক্ষেত্র৷ সংস্কৃত পম্পে শব্দই কন্নড়ে রূপান্তরিত হয়ে হাম্পে শব্দ তৈরি হয়৷ যারই আজকের নাম হাম্পি৷ রামায়ণে উল্লেখিত ঋষ্যমুখ , হেমকুট , অঞ্জনাদ্রী এবং গন্ধমাদন পর্বতে দিয়ে ঘেরা এই জায়গাকেই আমরা চিনি বালি ও সুগ্রীবের রাজধানী কিস্কিন্ধ্যা নামে৷ তবে ইতিহাসের পাশাপাশি বর্তমান হাম্পির আকর্ষণও কম কিছু নয়৷ আর সেই সব কারণ মিলিয়েই ক্রমশ দেশের এবং বিদেশের পর্যটকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাম্পি এবং ইউনেস্কোর বিবেচনায় এটি একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থাপত্যে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় ভাষায় হাম্পিকে পাম্পা-ক্ষেত্র ,কৃষকৃন্দ ক্ষেত্ৰ অথবা ভাষ্করা ক্ষেত্ৰ বলে জানা যায়, ভাষ্কর নামটি পাম্পার থেকে উৎপত্তি হয়েছে, যা তুঙ্গভদ্ৰা নদীর প্ৰাচীন নাম। হাম্পি নামটি হাম্পের থেকে উৎপত্তি হয়েছে ।
হাম্পির বিজয় ভিট্টল পরিসরে পাঁচ-স্তরযুক্ত গোপুরমে প্রবেশ করলে আপনি পৌঁছে যাবেন এক অদ্ভুত রাজকীয় নস্টালজিকতায়। আপনি দেখতে পাবেন অজস্র রাজকীয় নারী মূর্তি আপনার দুই পার্শ্বের নির্মাণ গাত্রে খোদিত হয়েছেন। সংগীত মণ্ডপমে প্রবেশ করলে স্তম্ভ গাত্রে দেখা পাবেন অজস্র অপরূপা চিত্রিত নারীদের , তাঁরা সারি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের কথা বলছেন।
বিজয় ভিট্টল মন্দিরের থেকে অনতিদূরেই অবস্থিত মহানবমী দিব্বা। এই স্থানে সেই বহু বহু বহু বছর আগে, রাজবংশ , রাজ পরিবার, রাজসৈন্য , রাজ যোদ্ধারা তাঁদের নানা সামাজিক , সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান , প্রদর্শন ইত্যাদি নানা কারণে একত্রিত হতেন। এই মহানবমী দিব্বার প্রাচীর গাত্রে খোদাই করা বীরাঙ্গনার বন্য অশ্বকে বশ্যতা স্বীকার করানো , যোদ্ধানারী, বর্শা চালিত নারী, শিকারী-নারী এবং রাজকীয় নারীদের অবয়ব চিত্রিত করা হয়েছে।
হাম্পি মন্দির নগরী জুড়ে প্রায় প্রতিটি মন্দির গাত্রে নারী ভাস্কর্য খোদিত এবং শোভিত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখনও এই গৌরবময় নগরীর ধ্বংসাবশেষের ইতিহাস উন্মোচনের জন্য কাজ করে চলেছেন। এখানে একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়- প্রাচীন এই শহরের নিত্যদিনের কার্যক্রমে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। আইনী শৃঙ্খলা, সাহিত্য, বাণিজ্য এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে পর্যন্ত তাদের ভূমিকা পরিমাণ অনেক বেশি । নারী অর্থে কেবল গৃহিণীই ছিলেন না এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যোদ্ধা, দেহরক্ষী , লেখিকা, হিসাবরক্ষক এবং জ্যোতির্বিদ ইত্যাদি। এই সকল চিত্র তৎকালীন সমাজের নারী স্বাধীনতা এবং স্বতন্ত্রতার ইতিহাসকে গর্বিত হয়ে প্রচার করে।
এই স্থলে একটি প্রাচীন শিলালেখ পাওয়া যায়। যেখানে উল্লিখিত হয়েছে কোনো এক জনৈক প্রধানমন্ত্রীর ভোগীনি জলাধার নির্মানের নিমিত্ত ভূমি দান করেছিলেন। অর্থাৎ , নারী জাতি কেবলমাত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কর্মে সক্রিয় ভাবে অংশই নিতেন না , সমাজ বা রাজত্ব যাঁদের নিয়ে গড়ে ওঠে অর্থাৎ জনগনের কল্যাণের কথাও সমান ভাবে চিন্তা করতেন। অপর একটি শিলালিপিতে কুপায়নি নাম্নী এক জনৈক আভিজাত নারীর সম্পর্কে বলা হয়েছে, যিনি তিরুমালায় সেচ নালা নির্মাণে অবদান রেখেছিলেন।
আরও একটি শিলালিপিতে মহিলাদের দ্বারা শাসিত পুরো অঞ্চলগুলির উল্লেখ রয়েছে। অচ্যুত রায় যখন রাজা ছিলেন, মহামন্ডলেশ্বর সংগীতপুরাধিস্বর চেমনাদেবীম্মা হাদুওয়াল্লির রাজ্যপাল নিযুক্ত হন। প্রতাপ এল্লামারসার কন্যা চিন্মান ভেনকিয়ালপট্টু গ্রামকে তিরুমাল অভিজাত গ্রাম হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। রায়রা তাদের প্রশাসনিক কার্য, রাজনৈতিক কার্য ইত্যাদি পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীদের উপর অধিক বিশ্বাস রাখতেন এবং স্বাভাবিকবভাবেই মহিলারা বিভিন্ন এলাকায় কার্যকরভাবে শাসনভার গ্রহণ করতেন।
১৬ শতাব্দীর পর্তুগিজ ভ্রমণকারী ডোমিংগো পেস হাম্পির সমৃদ্ধিতে প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন। তিনি কীভাবে সৌজন্যবোধের মাধ্যমে সম্মানিত হয়েছিলেন এবং সাধারণ জনগণ থেকে নারী যোদ্ধা, নারী শিল্পী , নারী রক্ষীবাহিনী এবং রানীর একমাত্র সঙ্গে অবাধে কথা বলার অনুমতি পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে তিনি আকর্ষণীয় বহু তথ্য নথিভুক্ত করেছিলেন। সেখানে যেমন পুরুষ চিকিৎসক নির্দ্বিধায় কোনো স্ত্রী রোগীর চিকিৎসা করতে পারতেন , ঠিক সমান ভাবে একজন নারী চিকিৎসক কোনো পুরুষ রোগীর চিকিৎসা করতে পারতেন।
মহিলা রক্ষী , মহিলা সৈনিক ,মহিলা কুস্তিগীর এবং মহিলা সংগীতজ্ঞরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় প্রচুর সংখ্যায় উপস্থিত হতেন। প্রত্যেক রানীর নিজস্ব মহিলা রক্ষী ছিল এবং তাঁরা ই রানীদের বার্তাবাহকও ছিলেন বটে।
বিজয়নগরে রায়দের রাজত্বের সময় যেভাবে মন্ত্রী এবং আধিকারিক পদগুলি নারীরা গর্বের সঙ্গে এবং অহংকারের সঙ্গে অলংকৃত করতেন, তা কেবল ভারতীয় রাজনীতিই নয় বরং বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দৃষ্টান্তমূলক অধ্যায় হিসাবে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে মহিলা কবি, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে ক্রীড়াবিদ , যোদ্ধা এবং কলাকার প্রমুখদের বিভিন্ন সম্মেলনে যোগদান করার জন্য প্রহোৎসাহিত করা হত। কৃষ্ণদেব রায় প্রায় সমগ্র ভারতের সুবিখ্যাত মহিলা কবি এবং সাহিত্যিকদের সংরক্ষণ প্রদান করতেন।তাঁর স্ত্রী তিরুমালম্বা দেবী বিজয়নগর রায়দের বিবাহের একটি বিবরণ লিখেছিলেন। তিনি তাঁর স্বামীকে কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্পর্কিত একটি কবিতা উৎসর্গ করেন এবং তা যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল।গঙ্গাদেবী দ্বারা রচিত মধুরা বিজয়ম্ (মাদুরাইয়ের বিজয়) ছিল মাদুরাইতে তাঁর স্বামীর সামরিক বিজয়ের একটি শ্লোকের আখ্যান। যুগে যুগে হাম্পি তথা বিজয়নগর তথা দক্ষিণভারতে মহিলা সাহিত্যিকদের বিকাশ ঘটেছে। তাঁদের লেখনি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের জন্য মহত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল সমাজ। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে হাম্পি দেবী পার্বতীর নিকট থেকে নামটি গ্রহণ করেছিল। এই প্রাচীন শহরের কাঠামো একটি টাইম মেশিন হিসাবে কাজ করে এবং খোদাই করা ভাস্কর্যগুলি যা এই পাথরের দেয়ালগুলিকে সজ্জিত হয়েছে প্রাচীন হাম্পির মহিলাদের গুরুত্বের এক অমর ইতিহাসকে আজও স্মরণ করিয়ে চলেছে।
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ The Women of Ancient Hampi