বিদ্যাপতি লিখছেন —
যব- গোধূলি সময় বেলি ।
ধনি- মন্দির বাহির ভেলি ।।
নব জলধর বিজুরি রেহা
দ্বদ্ন্ব পসারি গেলি ।।
ধনি- অল্প বয়েসী বালা ।
জনু- গাঁথনি পুহপ-মালা ।।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের মন্দিরগুলি , অর্থাৎ দক্ষিণাত্যের বিশালাকার দ্রাবিড় শৈলীর মন্দির বা উড়িষ্যার সুবিশাল মন্দিররাজি, মধ্য ও উত্তর ভারতের নাগর ও বেশির শৈলীর মন্দির বা পশ্চিম ভারতের গুহাগুলির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য যেভাবে ইউরোপীয় এবং ভভারতীয় ঐতিহাসিক , নৃবিজ্ঞানী , গবেষকদের এবং পর্যটকদের তেমনভাবে আনুকূল্য লাভ করেনি। অথচ পোড়ামাটি বা টেরাকোটার মন্দিরের মূল সম্পদ হল ভাস্কর্যে।
এই অপরূপা বঙ্গের পোড়ামাটির মন্দিরচর্চার সূত্রপাত মোটামুটি ভাবে বলা যায় ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে জোসেফ ডি বেগলার এবং জেমস ফারগুসনের হাত ধরে।পরবর্তী সময়ে হাত ধরে। পরবর্তী সময়কালে বিংশ শতকের তিরিশের দশকে শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত বাংলার টেরাকোটার মন্দির ভাস্কর্য শৈলীর প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর রচনার মাধ্যমে মন্দিরের উৎকর্ষতা কিছুটা প্রচারের আলোকে আসে।
এর বহু পরে অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে বঙ্গের পোড়া মাটির স্থাপত্য ভাস্কর্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন পঞ্চানন রায় এবং পরবর্তী সময়ে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ষাটের দশকের সময়কালে শ্ৰী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ” বাঁকুড়ার মন্দির ” এর এক উল্লেখযোগ্য দলিল।এরপর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমন করে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় , ডেভিড ম্যাককাচ্চন, হিতেশ রঞ্জন স্যানাল , তারাপদ সাঁতরা বাংলার পোড়ামাটির মন্দির সংক্রান্ত যে বিপুল তথ্যভান্ডার সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছিলেন আজও বাংলার মন্দির চর্চায় সেগুলি আকর গ্রন্থ হয়ে আছে। এই সময় থেকেই সূচিত হয় বাংলার জেলাভিত্তিক পুরাকীর্তিগুলির লিপিবদ্ধকরণের কাজ।
পরবর্তীকালে বহু গবেষক উল্লেখযোগ্য কাজ করে গেছেন বাংলার মন্দির নিয়ে। প্রণব রায়, শম্ভুনাথ মিত্র প্রমুখ সহ আরো অন্যান্য গবেষকদের হাত ধরে বাংলার পোড়ামাটির মন্দির বেশ কয়েক দশক ধরে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এমনকি বর্তমান যুগেও বঙ্গের টেরাকোটা বা পোড়ামাটির মন্দির স্থাপত্য ভাস্কর্য ইত্যাদি নিয়ে যেটুকু আলোচনা হয় তা গত শতকে দিয়ে যাওয়া বিদ্বজ্জনদের করে যাওয়া সুকর্মেরই পুনরাবৃত্তি। এনারা সকলেই যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন সেখানে বারবার নতুন আঙ্গিক বা সূত্রের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন – পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু সেই বিষয়কে ধারাবাহিক ভাবে বহন করতে পারেন নি। আজও মন্দির চর্চার ক্ষেত্রে বহু বহু অনাবিষ্কৃত জিনিস আছে। কিন্তু কারুর মনে তা নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না।
বাংলায় মধ্যযুগে দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত মরাশত্রুর আক্রমণে এবং তাদের ধ্বংশলীলার কারনে কোনো পোড়ামাটির মন্দির তৈরি হতে পারে নি। তবু ধ্বংসের হাত থেকে কিছু আদি মধ্যযুগীয় মন্দির টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। আর বহন করে সেই সেই আদি মধ্যযুগীয় নান্দনিক শিল্প ভাস্কর্যকে।
প্রায় চারশত বৎসরের অন্ধকারময় যুগ পর হয়ে পুনশ্চঃ যখন বাংলার মন্দির নির্মাণ শুরু হয় , তখন দেখা যাচ্ছে মন্দির নির্মাণের শাস্ত্রীয় নির্দেশ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে না এবং শৈলীও হারিয়ে যায় নাই।
টেরাকোটা বা পোড়ামাটির মন্দির নির্মানের জন্য মৃত্তিকা প্রস্তুতির পদ্ধতি , মন্দিরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য শৈলীর নিদর্শন ইত্যাদি অষ্টাদশ শতক অবধিও বাংলায় শাস্ত্র নির্দিষ্ট ছিল। যদিও আজকাল বিদেশি রাজনৈতিক প্ররোচনায় অনেকেই এই কথা মানতে চান না।
উক্ত দৃষ্টি ভঙ্গি বিক্ষিপ্ত হলেও আলোচনা করে গেছেন তারাপদ সাঁতরা, মানিকলাল সিংহ প্রমুখের ন্যায় গুণী ব্যক্তিগন। মল্ল রাজবংশের দ্বারা স্থাপিত মন্দিরগুলির স্থপতি সম্পর্কে আলোচনায় শ্ৰী মানিকলাল সিংহ লিখে গেছেন …” স্থপতি বিদ্যা সংক্রান্ত দুই চারখানি পুঁথি যে এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল তাহা নানা সূত্রে জানা যায়। এই সকল পুঁথিগুলি স্থপতি গন বংশ পরম্পরায় সযত্নে রক্ষা করিতেন ।”
এটা সত্য ভাবনা যে প্রায় চারশত বৎসরের অন্ধকার যুগকে অতিক্রান্ত করেও এই বঙ্গে যখন পূনশ্চঃ টেরাকোটা বা পোড়ামাটির মন্দির স্থাপনা যখন পুনরায় শুরু হল, তখন তার স্থাপত্য শৈলী ভাস্কর্য ইত্যাদি দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়।
তারাপদ সাঁতরা মন্দির নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে গেছেন। কেবল বিষ্ণুপুরের মন্দিররাজি নয়, বিষ্ণুপুর ঘরানার পূর্ববর্তীকালে ঘুড়িষার রঘুনাথ মন্দিরের ভাস্কর্য শৈলী দেখলে চমৎকৃত হতে হয়। ষোড়শ শতক থেকে সপ্তদশ শতক হয়ে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলার পোড়ামাটির মন্দির গাত্রে ভাস্কর্যের বির্বতন এক শাস্ত্রীয় গাঁথা , ঊনবিংশ শতকে যা পাশ্চাত্য প্রভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনাদের মনে প্রশ্ন আসে যে এত কথা কেন বলছি? এত কথা বলছি কারণ আজ আমি আলোচনা করব ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির নিয়ে। আসলে বিশেষ কিছু উপাদান বা বৈশিষ্ট্য না থাকলে কোনো একটি মন্দির আলোচনা কখনোই জনমানসে দাগ কাটে না বা আগ্রহের সঞ্চার করে না। ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির যাঁরা দর্শন করেছেন তাঁরা হয়ত এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেতে পারেন। হুগলী মোটামুটি রাঢ় অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। তাই সুবিশাল রাঢ় অঞ্চলের বহু পোড়ামাটির মন্দির থাকা সত্বেও কেন যে ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির নিয়ে আলোচনা করছি সেই ব্যাখ্যাও দেব পরের পর্বে। সঙ্গে থাকবে অবশ্যই করে মন্দিরটির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ,দিক নির্দেশ ইত্যাদি।
ভাঙা দেউলের দেবতা,
তব বন্দনা রচিতে, ছিন্না
বীণার তন্ত্রী বিরতা।
সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ
তোমার আরতি-বারতা।
তব মন্দির স্থির গম্ভীর,
ভাঙা দেউলের দেবতা!
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির : একটি রচনা