সুদর্শনে গোপাল-গোবিন্দ ।
কবি বলছেন “মানুষই দেবতা গড়ে/তাহারই কৃপার ‘পরে/করে দেব মহিমা নির্ভর।” জন্মাষ্টমীতে বংশীধারী কৃষ্ণকে প্রদর্শন করে আমরা শক্তি হারিয়েছি। বাঁশির-রূপে বাঙালিকে জারিত করেছে কে? মধ্যযুগীয় বিদেশি শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু প্রবুদ্ধজন, কবি ব্যক্তিত্ব। তারপর এল কথক ঠাকুরের কারুকাজ; পরিবর্তন এল পালাগান, কীর্তন, শিল্প সংস্কৃতিতে— ধীরে ধীরে জারিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থাপিত হলেন কেবলমাত্র রাধামাধব। কোথায় গেল তাঁর সুদর্শন চক্র? কোথায় হারাল তাঁর অমিত শক্তি, বিশ্বরূপ? বাঙালি একেবারেই ভুলে গেল ক্ষত্রিয় কৃষ্ণের কথা। বাঙালি-হিন্দু যতই তার যোদ্ধৃত্ব রূপের কথা ভুলেছে, ততই পালিয়েছে লুকিয়েছে দস্যুর ভয়ে। এবার পালাবে কোথায়? আর যে পালাবার পথ নেই! দেবতার পেলবতা কোমল থেকে কোমলতরো হল সংগীত-কবির হাত ধরে।
কিন্তু বলুন তো, যে দিনটিতে তাঁর জন্ম, জন্মাষ্টমীর সেই দিনে কী শ্রীকৃষ্ণের বাল্যরূপ পরিবেশনই কেবল উচিত নয়! যে কাজের ভার নিয়ে ধরায় অবতীর্ণ হলেন তিনি, যে কাজে বারবার শ্রীবিষ্ণুকে আবির্ভূত হতে হয়, তার অনুরণন কি জন্মাষ্টমীতে থাকতে নেই!
কবে কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র পরশুরাম তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন, কবে তিনি শক্তিশালী হবেন, তবে তাঁর যোদ্ধৃত্ব রূপ দেখতে হবে? এ নিষেধ মানেননি যে শিল্পী, তিনি প্রকৃতই বীরপূজক। বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় পলায়নপর জাতির অ্যাকোমোডেশন হতে পারে না!
ভগবান কৃষ্ণের অস্ত্র সামীপ্যের রূপ দেখতে চান যারা, বাংলায় তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অনন্তকালের সংগীতধ্বনির মধ্যেও কর্তব্য যে ডাক দেয়, অধর্মকে পুরোপুরি পরাজয় করার স্বপ্ন দেখে যে নতুন প্রজন্মের বাঙালি, তার রং-তুলি যখন প্রবাহিত হয়, তখন দেখা যায়, শিশু কৃষ্ণের পাশে রক্ষাকবচের মধ্যে সুদর্শন ঘুরপাক খায় না, কখনও কখনও বিরাট এক শিশুর তর্জনীর অনায়াস স্পর্শ পায় সুদর্শন!
বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ, “গা নষ্ট কানায়, পুকুর নষ্ট পানায়।” একটি পুকুরের মাছচাষ কীভাবে আগাছার দ্বারা ক্ষতি হয়, এ তারই নির্যাস। কিন্তু পুকুর কতখানি নষ্ট হল? যতখানি গ্রাম নষ্ট হয়েছে কানাই বা কৃষ্ণের দ্বারা। হিন্দুর আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণকে এখানে সরাসরি নষ্টলোক হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এখানেই আসল খেলাটা খেলে রেখেছে সেক্যুলার, বিধর্মীদের হাতযশ। পরে দীর্ঘদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক বিচারধারার প্রচেষ্টা তাতে আরও প্রবল ইন্ধন জুগিয়ে এসেছে। কারণ যত হিন্দুধর্মের যোদ্ধা-দেবতার চরিত্রকে কলুষিত করা যায়, ততই ধর্মান্তরণের কাজ হাসিল করাটা সহজতর হয়!
বলা হয়, প্রবাদ লোকসমাজের সৃষ্টি। অনেক সময়ই সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পাওয়া যায় না; যদিও প্রবাদ তৈরির প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা এবং প্রগল্পের ইতিহাসে তার উৎস ধরার চেষ্টা দেখা যায়। অনেক সময় অনেক সাহিত্যিকের উল্লেখযোগ্য কথা প্রবাদপ্রতিম বাক্য বলে স্বীকৃত হয় এবং প্রচলিত হতে থাকে, যেমন “সে কহে অধিক মিছে/যে কহে বিস্তর।” অনেক সময় অনেক লোককবির কবিতা/ছড়ার উল্লেখযোগ্য বাক্য প্রবাদ রূপে আখ্যা পায়; সেখানে লোকসমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তির বিশেষ প্রবণতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা কাজ করে। “গা নষ্ট কানায়, পুকুর নষ্ট পানায়।”— এমনই একটি বাক্য, যা সমাজের মাথা বলে পরিচিত মানুষের দ্বারা কৃষ্ণ-বিদ্বেষের বিষ হিসাবে থরে-বিথরে প্রকাশিত হতে পারে। এখন এ কাজ কারা করলেন? এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে বরং বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থ থেকে কিছু উপযুক্ত উদ্ধৃতি দেওয়া যাক।
কৃষ্ণদ্বেষীদের কাছে যে কথা কৃষ্ণচরিত্রের প্রধান কলঙ্ক রূপে প্রচলিত, তা হল কৃষ্ণের সঙ্গে ব্রজগোপীদের সম্বন্ধের কথা। বঙ্কিম লিখছেন, “মহাভারতে ব্রজগোপীদিগের কথা কিছুই নাই। সভাপর্বে শিশুপালবধ-পর্বাধ্যায়ে শিশুপালকৃত সবিস্তার কৃষ্ণনিন্দা আছে। যদি মহাভারতপ্রণয়নকালে ব্রজগোপীগণঘটিত কৃষ্ণের এই কলঙ্ক থাকিত, তাহা হইলে, শিশুপাল অথবা যিনি শিশুপালবধ-বৃত্তান্ত প্রণীত করিয়াছেন, তিনি কখনই কৃষ্ণনিন্দাকালে তাহা পরিত্যাগ করিতেন না। অতএব নিশ্চিত যে, আদিম মহাভারত প্রণয়নকালে এ কথা চলিত ছিল না— তাহার পরে গঠিত হইয়াছে।”
এখন দেখা যাক কৃষ্ণচরিত্রের প্রামাণ্য দিকটি কোথায় কোথায় আছে? ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এই সব পুরাণগুলিই মহাভারতের পর লেখা এবং এর অনেকগুলিই অধুনাতন বা অর্বাচীন বলে স্বীকৃত।
এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ প্রচলিত আছে, তা নতুন গ্রন্থ, প্রাচীন পুরাণ নয়। আর এই ব্রহ্মবৈবত্তপুরাণেই রাধাকৃষ্ণের আদিরসাত্মক স্রোত যেন টগবগিয়ে ফুটছে। বঙ্কিমচন্দ্র রাধাকৃষ্ণের প্রেমরস প্রচার বিষয়ে লিখছেন, “মহাভারতের পর বিষ্ণুপুরাণ দেখিতে হয়, এবং পূর্বে যেমন দেখিয়াছি, এখনও তেমনই দেখিব যে, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ এবং ভাগবত পুরাণে উপন্যাসের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। এই ব্রজগোপীতত্ত্ব মহাভারতে নাই, বিষ্ণুপুরাণে পবিত্রভাবে আছে, হরিবংশে প্রথম কিঞ্চিৎ বিলাসিতা প্রবেশ করিয়াছে, তাহার পর ভাগবতে আদিরসের অপেক্ষাকৃত বিস্তার হইয়াছে, শেষে ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে তাহার স্রোত বহিয়াছে।”
এখন দেখা যাক কোন পুরাণ কখন রচিত। উইলসন সাহেবের মতে, কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়। পুরাণের প্রণয়নকাল তিনি যেভাবে নিরূপণ করেছেন, তার সহায়তা যদি নিই, সেই মতানুসারে বিষ্ণুপুরাণ দশম শতাব্দীতে লিখিত; ভাগবত পুরাণ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লিখিত; পদ্মপুরাণ ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে লেখা; বামনপুরাণ বঙ্কিম যুগ থেকে ধরলে ৩/৪ শত বৎসরের গ্রন্থ; কূর্মপুরাণও প্রাচীন নয়; বায়ুপুরাণের সময় নিরূপিত না হলেও প্রাচীন বলে লিখিত আছে। এখন ভারতবর্ষে এই সময় কারা শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার সুলুকসন্ধান জরুরি হয়ে পড়বে। আরও সুলুকসন্ধান জরুরি এর মধ্যেও কালে কালে নানান প্রক্ষেপণ এসেছে কিনা, কোন শাসনামলে এবং কার দ্বারা।
এ দিকে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণ সম্পর্কে যত নষ্টামির কথা লেখা হচ্ছে তা সবই ভারতবর্ষে মধ্যযুগে সংগঠিত হয়েছে। বিদেশি শাসক, যারা বিধর্মীদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মপ্রচারও চেয়েছিল, তারা হিন্দু সভাসদ পণ্ডিত ব্যক্তিকে কী ততখানিই পৃষ্ঠপোষণ করবেন না, যতটা তাদের ধর্মপ্রচার ও নিয়ন্ত্রণের সুবিধা হয়? কানাইকে নষ্টচরিত্র করে তুলতে গল্পগাছা বানিয়ে রাজানুগ্রহ পাওয়ার ইতিহাস কি একেবারেই কষ্টকল্পনা? মধ্যযুগে বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারায় যে সমস্ত কবি বিকশিত হয়েছেন তাদের সম্পর্কে তন্বিষ্ঠ পাঠ এক্ষেত্রে জরুরি বলে মনে হয়। তার সঙ্গে রিলেট করাতে হবে তখনকার সত্যিকারের ইতিহাস। তারপর মিলিয়ে নেওয়া উচিত “গা নষ্ট কানায়, পুকুর নষ্ট পানায়”— এই প্রবাদ কবে কোথায় কীভাবে পরিপুষ্টি লাভ করল! বুঝে নেবার দরকার আছে, কৃষ্ণ সত্যিই লম্পট কিনা। মহাভারতে যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থাপিত, তার সঙ্গে বৃন্দাবন লীলার অতি নষ্টামি মিলিয়ে দেওয়ায় চেষ্টায় গুরুচণ্ডালী দোষ হয়ে যাচ্ছে কিনা!
বঙ্কিমচন্দ্র আরও লিখছেন, “মহাভারতে কেবল ঐ সভাপর্বে দ্রৌপদীবস্ত্রহরণকালে, দ্রৌপদীকৃত কৃষ্ণস্তবে ‘গোপীজনপ্রিয়’ শব্দটা আছে… বৃন্দাবনে গোপীদিগের বাস। গোপ থাকিলেই গোপী থাকিবে। কৃষ্ণ অতিশয় সুন্দর, মাধুর্য্যময় এবং ক্রীড়াশীল বালক ছিলেন, এজন্য তিনি গোপ গোপী সকলেরই প্রিয় ছিলেন। হরিবংশে আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ বালিকা যুবতী বৃদ্ধা সকলেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন। এবং যমলার্জ্জুনভঙ্গ প্রভৃতি উৎপাতকালে শিশু কৃষ্ণকে বিপন্ন দেখিয়া গোপরমণীগণ রোদন করিত এরূপ লেখা আছে। অতএব এই ‘গোপীজনপ্রিয়’ শব্দে সুন্দর শিশুর প্রতি স্ত্রীজনসুলভ স্নেহ ভিন্ন কিছুই বোঝায় না।”
১৮৮৪ সাল থেকে ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ লেখা শুরু করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তখন তাঁর বয়স ৪৬ বৎসর, এরপর আর মাত্র ১০ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি (তাঁর মৃত্যু ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল)। এরই মধ্যে তাঁর অধিকাংশ কালজয়ী সাহিত্যকর্ম রচনা শেষ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে ‘আনন্দ মঠ’, ‘রাজসিংহ’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রভৃতি উপন্যাস। সম্পাদক বঙ্কিম হিসাবেও কাজ সেরে ফেলেছেন (১৮৭২ সালে তিনি সম্পাদনা করেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা); সেখানে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘সাম্য’-এর মতো লেখাও শেষ। এই বয়সে এসে তিনি হিন্দুধর্মের আলোচনার দিকে মনোনিবেশ করলেন। এই ১৮৮৪ সালেই তিনি ধর্মতত্ত্বের প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যে ১৮৮৫ সালে তিনি নির্বাচত হয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য। সে বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা। এমনই সময়কালের মধ্যে ১৮৮৬ সালে তিনি কৃষ্ণচরিত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ করছেন। ‘প্রচার’ পত্রিকায় লেখা শুরু করছেন শ্রীমদ্ভাগবত গীতার বাংলা টীকা লেখার কাজ।
কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিম শ্রীকৃষ্ণকে এক আদর্শ ভারতীয় নায়ক রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তে হিন্দুদের দেবতা ভগবান কৃষ্ণকে এক কামুক, বহুগামী পুরুষ হিসাবে প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে হিন্দুরা তখন বিভ্রান্ত। পুরুষোত্তম কৃষ্ণের যোদ্ধৃত্বরূপ, সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা ভুলে গেছে বাঙালি তথা ভারতবাসী। ঐশী মহিমা নয়, এমতাবস্থায় সংগঠক শ্রীকৃষ্ণের উপস্থাপনের প্রয়োজনের কথা ভাবলেন বঙ্কিম, পদানত ভারতবাসীকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে মাঠে নামলেন তিনি। ‘শ্রীকৃষ্ণচরিত্র’ তার অনবদ্য ফলশ্রুতি।
১২৯১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা (১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ‘প্রচার’ পত্রিকায় কৃষ্ণচরিত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকল। ১২৯৩ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় অবধি প্রকাশিত হল। এরপর ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট ‘কৃষ্ণচরিত্র প্রথম ভাগ’ শিরোনামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত আকারে কৃষ্ণচরিত্র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী