কলকাতার গোলিশ্রী সংস্কৃত বিদ্যালয়: উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এবং ম্যাকাউলে’র অনীহার শিকার

কলকাতার গোলিশ্রী সংস্কৃত বিদ্যালয়ের করুণ কাহিনী যা উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এবং ম্যাকিউলে’র শিক্ষানীতি দ্বারা চিরকালের জন্য ধ্বংস করা হয়েছিল….

সন্দীপ বালাকৃষ্ণা
প্রকাশিত হয়েছে: ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:২৬ পিএম

টমাস বাবিংটন ম্যাকিউলে’র পক্ষে ভারতের অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাগত ঐতিহ্যের এমন ব্যাপক ক্ষতি করা সম্ভব হতো না যদি না তিনি অবিচ্ছিন্ন সরকারী সহায়তার জন্য তিনি ব্রিটিশ-অধিকৃত ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছ থেকে সাহায্য পেতেন। যে কোনও মানদণ্ডে, বেন্টিঙ্ক মহাকাব‍্যিক আদর্শ পুরুষ হয়ে রয়েছে গেছেন। ভারতের শতাব্দী প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার যে অপূরণীয় ক্ষতি বেন্টিং করে দিয়ে গেছেন তা হয়তো আমরা আর কোনোদিন পুনঃরুদ্ধার করতে পারবোনা।

প্রকৃতপক্ষে, যখন তিনি মাত্র তিরিশ বছর বয়সী একজন যুবক ছিলেন ঠিক তখন থেকেই তার চরিত্রের খারাপ দিকগুলো প্রকাশ পেয়েছিল। ১৮০৪ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির একজন তরুণ গভর্নর হিসাবে বেন্টিং লর্ড ক্যাসেলারিগকে লিখেছিলেন যে, “আমরা দেশটিতে​ খুব কষ্টকর ভাবে আসতে পেরেছি এবং দুঃখের বিষয় হলো গোটা দেশটাই দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে রয়েছে”। বিলাপ নয় বরং একটি উপলব্ধি হিসেবে দেখতে গেলে বলা যায় যে “বেয়নেটের” মাধ্যমে ভারতকে রক্তাক্ত করলে তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভাল প্রভাব ফেলবে না। আরও কার্যকর এবং ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্ৰহন করা প্রয়োজন।

মোট কথা, এই ব্যবস্থাগুলিতে প্রচলিত হিন্দু প্রতিষ্ঠানগুলির একটি নিয়মতান্ত্রিক ভাঙ্গন অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এই প্রচেষ্টায় তাকে সহায়তা করার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম ছিল শিক্ষা। এগুলোকে মোটামুটিভাবে​ ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা উৎস বলা যেতে পারে আর মজার ব্যাপার হলো আমরা আজ অবধি অন্ধের মতো সেইসবই অনুসরণ করে চলেছি। এই পচা অন্তঃসারশূন্য ব‍্যবস্থা কিন্তু এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। সময়ে সময়ে শুধুমাত্র বাহ্যিক রংটাই পরিবর্তন করা হয়েছে এই যা। বেন্টিঙ্কের এই জঘন্য প্রকল্পটি যেটা আসলে বর্ণবৈষম্যে সৃষ্টির চাতুরী বলা যায়, সেই কাজের প্রত‍্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন: টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকোলে, চার্লস ট্র্যাভেলিয়ান, চার্লস মেটকাল্ফ এবং মাউন্টসেটুয়ার্ট এলফিনস্টোন। বেন্টিঙ্কের এই প্রকল্প সম্পর্কে কোয়ার্টেট কী বলেছিলেন​ এবং কী করেছিলেন তার বিশদ অনুসন্ধান করা অপ্রয়োজনীয়, তবে তাদের এই কাজটি সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে ছিল ১৮৩৫ সালে, ইংরেজি শিক্ষা আইনের​ মাধ্যমে।

ইংরেজি ভারতের সরকারী ভাষা হয়ে ওঠে এবং তা আজও এটি সরকারী বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করে চলেছে। ঔপনিবেশিকরন তখন ই সাফল্য লাভ করে যখন তা আর রাজনৈতিক কৌতুক উপভোগ করে না।

চিন্তা করুন, ভারত “স্বাধীনতা অর্জনের পরেও দীর্ঘকাল ধরে” ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস এবং ভারতীয় শহরগুলির গ্রন্থাগারগুলি ভারতীয়দের “উন্নত জীবনের” জন্য একটি শক্তিশালী, বেসরকারী ভিসা হিসাবে রয়ে গেছে। আপনি কি সংস্কৃত বা কোনও ভারতীয় ভাষার কোনও কাজ ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে পেয়েছেন? বাস্তবে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো সংস্থাগুলি হ’ল ব্রিটিশ সরকারের সফ্টকোর বিদেশ নীতি, তাদের পূর্বের উপনিবেশগুলিতে ঔপনিবেশিক অনুভূতি নিশ্চিত করার একটি পদ্ধতি। এখনও পর্যন্ত সমস্ত বিদেশ ভ্রমণে, আমি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এই ধরণের দূরদর্শিতা এবং সুদূরপ্রসারী ভিত্তিগুলির একটি ফোঁটাও দেখতে পাইনি। এককথায় বলতে গেলে বিদেশে আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক​ দূতাবাসগুলি হাস‍্যকরের​ থেকে কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে। দীর্ঘ সময়ের জন্য, তারা আমাদের আইএফএস এবং অন্যান্য বাবুদের ব্যক্তিগত সুবিধার্থের ছোট ছোট জায়গাগুলোকে অনুশীলন করার জন্য এবং তাদের সন্তানের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার একটি টোপ হিসেবে দিয়েছিল। হয়তো এখন এটা পরিবর্তিত হচ্ছে বা হয়তো হচ্ছে না। এটি পরবর্তিদিনে চর্চার​ জন্য একটি বিষয় হয়ে থেকে যাবে।

উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক যে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োগ করেছিলেন, তার আরও একটি মুখ‍্য সত্য রয়েছে যা কয়েকজনই পরীক্ষা করে দেখেছে: এটি কেবল একটি ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি শিক্ষা ছিল না, এটি ছিল চার্চ কেন্দ্রিকও। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন ভারতে নিয়ে আসার সাধারণ “সুবিধা”গুলি নীচে তালিকাবদ্ধ করা হলো: রেলপথ, ডাক পরিষেবা, গণস্বাস্থ্য এবং গণশিক্ষা।

চার্চ আত্মার​ বিশ্লেষণের​ সাথে সাথে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ দিয়েছিল। আজও আপনার চারপাশে তাকান। খ্রিস্টান পরিচালিত এমন একটি হাসপাতাল বা শিক্ষা কেন্দ্র নেই যা কোনও চার্চের সাথে অনুমোদিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই তথাকথিত শিক্ষা ভারতে এমন দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেত না।
বেন্টিঙ্কের এই সাংঘাতিক প্রকল্পটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলেও​ কঠোর বিরোধিতারও মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বিরোধীদের প্রথম আঘাত এসেছিল প্রাকৃতিকভাবে। ভারতে ব্রিটিশ বিজয় এবং ক্ষমতার মূল কেন্দ্রস্থল বাংলা থেকে। উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ের মধ্যে বাঙালি হিন্দুরা প্রকাশ্যে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাদের অবজ্ঞার প্রকাশ করতে শুরু করে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত স্কুল-কলেজগুলিকে গোলাম-খানাস (দাস তৈরীর কারখানা) হিসাবে ডাকা শুরু করে।

অন্যদিকে, বেন্টিঙ্কের এই নিষ্ঠুর নীতিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থরা হলেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃত স্কুল ও কলেজগুলি (পাঠশালা) যেগুলি বহু শতাব্দী ধরে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গড়ে উঠেছিল এবং যা বারাণসীর সর্বোত্তম শিক্ষা​কেন্দ্রের সাথে সহজেই পাল্লা দিতে পারতো। কিন্তু এক ধাক্কায় শত শত সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র বিলুপ্ত হয়ে গেল।

গোলিশ্রী- সংস্কৃত-পাঠশালা

এরকমই​ একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছিল কলকাতার গোলিশ্রী- সংস্কৃত-পাঠশালা (গোলিশ্রী সংস্কৃত বিদ্যালয়)। বেন্টিঙ্ক তাঁর সাংস্কৃতিক করাত নিয়ে আসার আগে পর্যন্ত এই স্কুলটি ছিল সংস্কৃত শিক্ষাযর শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান যা তৎকালীন ইউরোপীয় ইন্ডোলজিস্ট এবং সংস্কৃতবিদদের দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্বীকৃত লাভ করেছিল। ব্রিটিশ সংস্কৃত পণ্ডিত এইচ.জি. উইলসন ছিলেন এমনই একজন পৃষ্ঠপোষক। তিনি এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বিদ্বানদের​ নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন।

গোলিশ্রী- সংস্কৃত-পাঠশালার প্রধান প্রেমাচন্দ্র-বগিশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল যখন তিনি শোনেন যে বেন্টিঙ্ক এটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উইলসন ইংল্যান্ডে​ থাকাকালীন তিনি তাকে অনেক উদ্বেগজনক চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিগুলি ছিল শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং যা সবচেয়ে কঠিন পাথর গলানোর পক্ষেও যথেষ্ট।
সেই রচনার একটি গদ্য ইংরেজী অনুবাদ নীচে দেওয়া হল…

এটা হল আপনার প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজ এবং একটি পদ্ম-ভরা পুকুরের অনুরূপ। কিন্তু এখন, সমস্ত পণ্ডিত-স্বরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে চলে গেছে। শিকারীরা এর তীরে ধৈর্য ধরে শুয়ে থেকে অপেক্ষা করছে, তাদের তীরগুলি আমাদের লক্ষ্য করেছে। তারা কেবল শিকারের জন্য সঠিক মুহুর্তের অপেক্ষা করছে। আপনি যদি সেগুলি থেকে আমাদের রক্ষা করেন তবে আপনার খ্যাতি অমর হয়ে থাকবে।

উইলসনের উত্তরও একইরকমভাবে​ কাব‍্যিক ছিল। তিনি আধো-আশ্বাস বানী পাঠিয়েছিলেন এবং “দেবতাদের ভাষা” সংস্কৃতের​ গৌরব, মাহাত্ম্য এবং অমরত্বের প্রশংসা করেছিলে তবে তিনি কোনও সঠিট সমাধান সূত্র দেননি। এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি নিজেই প্রমাণ করে দেন যে কীভাবে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নির্মম শক্তির সামনে খ্যাতিমান পণ্ডিতরাও মূলত শক্তিহীন হয়ে পড়েন। তবে প্রেমাচন্দ্র-বগিশাও ছিলেন ভীষণ জেদি । তিনি আবারও শ্লোকের মাধ্যমে তাঁর আবেদনের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।

এই সংস্কৃত কলেজটি গলিশ্রী হ্রদের ধারে কলকাতা শহরে বনানীর​ সবুজের মাঝে অবস্থিত। এটি এখন একটি সাহসী এবং নির্দোষ হরিণের মতো। ভাগ্য তাকে নিষ্ঠুর আঘাতের মুখোমুখি করে চলেছে। ম্যাকাউলে নামের নির্দয় শিকারী তার তীরগুলো তৈরী রেখেছে শিকারের জন্য। হে উইলসন! এই নিরীহ, ভয়ার্ত হরিণ অশ্রুসজল নেত্রে আপনার কাছে আন্তরিক আবেদন জানাচ্ছে, আপনার নামে সাহায্য প্রার্থনা করছে।

উইলসনের এইবারের উত্তরটি আগের লাইনের সাথে ছিল। উইলসন সত্যই গোলিশ্রী- সংস্কৃত-পাঠশালাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন কিনা তা আমরা সঠিকভাবে​ বলতে পারি না, তবে আমরা যেটা নিশ্চিতভাবে জানি তা হ’ল এই সংস্কৃত বিদ্যালয়টি নির্মমভাবে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল।

উপরিউক্ত এইসব কারণেই ম্যাকাউলে এবং তাঁর বর্ণবাদী ব্রিটিশ মাফিয়ারা তাদের সমস্ত উদ্ধত্য বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে “ভাল ইউরোপীয় সাহিত্যের একক সমগ্র ভারতের স্থানীয় সাহিত্যের জন্য মূল্যবান ছিল,” এবং “সমস্ত বই থেকে সংগ্রহ করা সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য … ইংল্যান্ডের স্কুলগুলিতে যে নিম্নমানের সীমাবদ্ধ শিক্ষা প্রদান করা হয় সেই সবের থেকেও সংস্কৃত ভাষা কম মূল্যবান”।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয়টি হ’ল ম্যাকাউলে এই রায় দানের পর স্বীকার করে ছিলেন যে “সংস্কৃত বা আরবী সম্পর্কে আমার কোনও জ্ঞান নেই”। নিশ্চিতভাবেই। তবে তার যে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে প্রবল জ্ঞান ছিল সেটা দলদাস এবং সুবিধাভোগী কাজকর্ম থেকেই প্রমাণিত হয়। পুরোপুরি জ্ঞান ছিল।

পুনশ্চ

এগুলোই ছিল ভারতের উপর বারংবার নেমে আসা ট্র্যাজেডির আসল গল্প যাকে আমরা ইতিহাস বলি। যখন আমাদের বাচ্চাদের এগুলি শেখানো হবে, তখন স্থান এবং সময়রেখার এই বিস্তারিত বিবরণগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে একপাশে মূল‍্যহীনভাবে পড়ে থাকবে। আমরা হয়তোবা​ এইভাবেই সমস্ত আশা আকাঙ্খার মৃত্যু দেখার জন্যই​ অপেক্ষা করে চলেছি।

গোলিশ্রী- সংস্কৃত-পাঠশালার হৃদয় বিদারক ট্র্যাজেডির বিবরণ জানতে পারার জন্য আমরা ঋনী থাকবো শতবধানী ডঃ গণেশের সূক্ষ্ম সংকলন, কবিতাগোন্ডু ক্যাথ বা কবিতার পিছনে গল্প, এগুলো অ‍্যামাজন থেকে কিনতে পাওয়া যাবে।

https://www.dharmadispatch.in/culture/the-golisri-sanskrit-school-of-calcutta-the-unmourned-victim-of-william-bentinck-and-macaulay

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.