“তোমার জন্মভূমি উদ্ধারের তরে বহু বহু বর্ষ ধরি তব ভক্ত গণ
সীতারাম নাম সদা করে প্রেম ভরে সত্বর তাদের করো অভীষ্ট পূরণ।”
দেশবিদেশ জুড়ে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথের লক্ষ লক্ষ ভক্ত ত্রৈকালিক আরাধনায় রামজন্মভূমি উদ্ধারের জন্যে প্রার্থনা করে এসেছে বহু বহু বছর। এতদিন পরে । তাদের সেই আশা পূরণ হলো। আজ যে বড়ো উৎসবের দিন। প্রাণের ঠাকুরটি আজ স্থূলদেহে উপস্থিত থাকলে কী হতো সেটা ভেবে শিহরিত হই।
প্রতিটি শিষ্যের কাছে দীক্ষাদানের দক্ষিণা হিসেবে। চেয়ে নিতেন চার লক্ষ— না না ত্যাগী শীর্ণকায় যোগীবর মানুষটি টাকা পয়সা কিছুই নিতেন না। এমনকী দীক্ষাদানের দক্ষিণা বাবদ ফল হিসেবে একটি হরতুকী আর বস্ত্র হিসেবে একটি উপবীত দিতে হতো। চার লক্ষ রামনাম লেখা না দিলে দীক্ষা সমাপন হতো না। শিশুকাল থেকে মা ঠাকুমাকে রামনাম লিখতে দেখে বড়ো হওয়া ভক্ত পরিবারগুলিতে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অনায়াসে ঢুকে পড়েছিলেন। সেই সব কোটি কোটি চার লক্ষ রামনামের বুঝি আজ সমাপন হলো। ডুমুরদহ রামাশ্রম-সহ বিভিন্ন আশ্রমে আজও থরে থরে এই খাতাগুলি পাওয়া যাবে। মঠ থেকে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে খাতাগুলি। দেওয়া হতো শুধু রামনাম লেখার জন্য। কুঁড়েঘর থেকে হিথরো এয়ারপোর্ট অবধি এই রামনাম খাতার অবাধ যাতায়াত। ঠাকুর বলতেন তুমি যখন লিখছ তখন তোমার মনে শ্রীরামের স্মরণ, মুখে মৌন উচ্চারণ, হাতে নামের স্পর্শ— সমস্ত প্রধান ইন্দ্রিয়গুলি একমুখী হয়ে। উঠছে। স্মরণ মননের এর চেয়ে আর বড়ো উপায় কী আছে। এখন মনে। হয় তখনকার সাধারণ ঘরের আটপৌরে মায়েরা মেয়েরা হয়তো অক্ষর পরিচয়ও করে নিতেন এই রামনাম লেখার মধ্যে দিয়েই, কে বলতে পারে?
চুঁচুড়ার দুর্গাদেবীর মা, ‘ভুদেব ভবন’-এ ভাড়া থাকাকালীন প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন— এক জটাধারী সাধু গঙ্গার ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকছেন…। পরে ঘটনাক্রমে শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে এলে তাকেই স্বপ্নদৃষ্ট সাধু বলে চিনতে পারেন এবং বহু পরে তার দীক্ষা হয়…। চোখে গ্লুকোমার কারণে সে জন্মে আর গুরুদক্ষিণা স্বরূপ চার লক্ষ রাম নাম লিখে। শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিবেদন থেকে তিনি বঞ্চিত হন। তার মৃত্যুর পর বহু বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্গাদেবীর কন্যা চিত্রার এক কন্যা সন্তান হয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই সে সীতারামের ছবি নিয়ে খেলা করে। একদা চন্দননগরে সুশীল সামন্তের বাড়ি দুর্গাদেবী নাতনীকে নিয়ে এসেছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শনে। সেখানে অত ভিড়ের মধ্যে সীতারাম হঠাৎ ডাকলেন সেই বালিকাকে। নিজের বিছানার তলা থেকে একটি হরিতকী তার হাতে দিয়ে বলে উঠলেন, “চার লক্ষ রাম নাম লিখে ফেরত দিবি”। সামনে দণ্ডায়মান দিদিমা প্রতিবাদ করে বললেন— “ও তো আপনার শিষ্যা নয়, ও কেন চার লক্ষ রামনাম লিখবে?” ঠাকুরের উত্তর। এল, “তোদের সে চোখ আছে যে তোরা দেখতে পাবি? ওর আগের জন্মের দক্ষিণা বাকি আছে, সেটাও এ জন্মে শোধ করবে।
সীতারামদাস ওঙ্কারনাথের ইষ্টমন্ত্র ছিল রাম। তাই স্বাভাবিক ভাবে তিনি ছিলেন। রামবাহক, রামধারক, শ্রীরাম সারথি। তার লেখা ত্ৰৈকালিক স্তবমালায় রামগান। ভক্তদের নিত্যদিনের গান ছিল। তিলক কামোদ রাগে নিজেই সুরারোপ করেছিলেন। বড়ো মধুর সে রামায়ণী গান। সব কথার যে মানে বুঝেছি তা নয়, তবে গাইতে গাইতে কখন সে গান শিরা উপশিরায় বইতে শুরু করেছে তা অজানা। কঠিন সংস্কৃত তৎসম শব্দগুলি শিশুমনে দাগ কেটেছিল ‘প্রণবান্তর্গত সীতারাম’ অর্থাৎ ওঙ্কারচিহ্নের মধ্যে যে শ্রীরাম-সীতা অবস্থান করতেন তাকে প্রতি শিষ্যের । প্রাণের মানুষ করে তুলেছিলেন ঠাকুর।
ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ তখন এক বছরের শিশু। দিব্য শিশুকে কোলে নিয়ে তার দিদিমা অষ্টপ্রহর হরিনামে বসেছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল— শিশু অজ্ঞান! সকলের আশঙ্কা দূর করে অভিজ্ঞ মূল গায়েন বললেন—“তোমার ছেলের তড়কা হয়নি মা, নাম শুনতে শুনতে সমাধি হয়েছে। এ সমাধি লক্ষণ। ছেলেকে আর কেউ ছুঁয়ো না। আমাকে একটু গঙ্গাজল দাও। গঙ্গাজল ছিটিয়ে কয়েকবার ‘রাম’ নাম করতেই শিশু তার পদ্মপলাশ। নয়ন মেলে সকলকে আশ্বস্ত করল! মূল গায়েন পুনরায় বললেন—“যখন ঠাকুর দেবতার কথা হবে, তখনই এরূপ হতে পারে। এ ছেলে সামান্য নয়! যখনই এইরূপ হবে, তখনি কেউ না ছুঁয়ে কাছে বসে রাম রাম করবে। তাহলেই ভালো হয়ে যাবে।” এই প্রসঙ্গে মাধব ঠাকুর বলেছেন—“তার পরবর্তী যুগ সেই মূল গায়েনের কথার সত্যতা ঘোষণা করেছে।” অর্থাৎ অবতারলীলার বৈশিষ্ট্যরূপ ‘মুহুর্মুহু সমাধি’ সীতারামের লীলায় বিশেষ ভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেবের কাছে একবার প্রবোধ মিত্র নামক জনৈক ভক্ত কৃপা যাচনা করলে শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে বললেন—“যদি দীক্ষা নাও, রোজ জপ করতে পারবে?” প্রবোধ মিত্র বলল— “না না না! তামার পাত্রটা দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে। আমি জপ করতে পারব না।” ঠাকুর বললেন— “তাহলে এখানে এসেছ কেন? তুমিই বল তুমি কী করতে পারবে?” প্রবোধ মিত্র। বলল—“আমি রাম নাম লিখতে পারব”। ঠাকুর বললেন- “বেশ বেশ! তাতেই হবে। এই কথা মতো তুমি নাম লিখবে।” এর পর থেকে এই প্রবোধ মিত্র প্রত্যহ ৯ ঘণ্টা ধরে ‘শ্রীরাম রাম রাম’ লিখতে লাগল। ক্রমে তার সব আলস্য ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সে অন্তর থেকে পরিবর্তিত হলো, শুধুমাত্র রামনাম লিখেই নাদ। জ্যোতি লাভ করল। তার দিব্য অনুভূতির কথা শুনে ঠাকুর তাকে খুব প্রসন্ন হয়ে। আশীর্বাদ করে বলতেন—“সাবাস বেটা ! চালিয়ে যা!” শ্রীশ্রী ঠাকুর বলেছেন— “যাঁহারা সর্বদা ‘শ্রীরাম রাম রাম’ বলেন, তাহাদের ভোগ ও মোক্ষ লাভ হয়, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। নিত্য নিয়মিত ‘শ্রীরাম রাম রাম’ নাম যত্নপূর্বক শুদ্ধভাবে লিখিলে রোগী রোগমুক্ত হইবে, ভোগী। তার অভিলাষিত ভোগ লাভ করবেই করিবে।” “শ্রীরাম-রাম-রামেতি যে বদন্ত্যপি সৰ্ব্বদা। স্তেযাং ভুক্তি মুক্তিশ্চ ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ । লিখেছেন “ওরে আমার স্বরূপহারা জীব! তুমিই তো রাম। তোমার ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী সীতাকে ইন্দ্রিয়রূপ দশমুখবিশিষ্ট রাবণ হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। বিনা শক্তিসাধনায় কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্যরূপ। রাক্ষসগণ ধ্বংস হইবে না… মন-রাবণ মরিবে না। মন-রাবণ না মরিলে ‘সা। ব্রহ্মবিদ্যা’ সেই ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী সীতাকে লাভ করিতে পারিবে না। মায়াসমুদ্রে ‘সবৃত্তি’ বানরগণের সাহায্যে নামের সেতুবন্ধন কর, ‘প্রণবধনু’ হস্তে রাবণকে আক্রমণ কর…”
শ্রীরামকে সাহিত্যে নিয়ে এসেছিলেন ঠাকুর। কথারামায়ণ, বিজনে বিজয়া, মিলন যজ্ঞ, জগদগুরু রামানন্দ, নাম রসায়ন, শ্রীশ্রী রামনাম মহিমা, মাতাপুত্র ইত্যাদি নানা গ্রন্থে রামকে এত নানারকম দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ আলোচনা করেছেন কিনা সন্দেহ। নাটক, গান কবিতা গীতিকাব্য। অথচ তা অলকানন্দার স্বচ্ছশীতল জলের মতো নির্ভার নিঝর-সরল সহজ। সীতারামকে একালের তুলসীদাস বললে। অত্যুক্তি করা হয় না। অহল্যা পাষাণী হোক বা শবরী তাদের আকুল আবেগের ভাষা প্রিয়তম রামের জন্য প্রতীক্ষায় মরম ছুঁয়ে যায়। সীতা ও রামের দাম্পত্যজীবনের প্রতিচ্ছবিতে দাস্য ও মধুর দুই ভাবই ফুটিয়েছেন অনায়াস সাবলীল লেখনীতে।
আজ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ঠাকুরের স্মৃতিচারণা করা দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। যিনি বলেছিলেন। শ্রীরামনামাখিল্মন্ত্র- বীজংসঞ্জীবনঞ্চেদ হৃদয়ে প্রবিষ্টম/হলাহলং বা প্রলয়ানলং বা মৃত্যোমূখং বা বিশতাং কুতো ভীঃ। শ্রীরামনাম অখিল মন্ত্রের বীজ ও জীবনদানকারী, যদি কোনো রূপে কারুর হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয় তাহলে হলাহল বিষ প্রলয়ের আগুন মৃত্যুর মুখে প্রবেশ করতে ভয় কী? আজ তিনি মিশে গেছেন। সপ্তর্ষিমণ্ডলে ধ্রুবতারায়। ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, ত্রিকালদর্শী সবই দেখছেন নিশ্চয়ই। আজ তার ভক্তদের অভীষ্ট পূরণ হয়েছে, আমাদের জীবনকালেই। এ বড়ো কম কথা নয়। তিনি সব রকম রাজনীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি আজীবন শুধু ‘সীতারামদাস’, তাই আজকের এই দিন। শুধু প্রার্থনা পূরণেরই দিন। তারই লেখা একটি গানের কয়েকটি আখর দিয়ে শেষ করি।
‘সুধাপারাবার করিয়া মন্থন, উঠিয়াছে নাম মহারসায়ন, হেলায় শ্রদ্ধায় করিলে । সেবন, লভয়ে অনন্দধাম। গাওরে রসনা গাও উচ্চস্বরে,স্থাবর জঙ্গম নামে যাক। ভরে, হউক ধ্বনিত বিশ্ব চরাচরে সুধামাখা রাম নাম।”
সারদা সরকার
2019-11-22