ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্তিম পর্বে দ্রষ্টাঋষির উদ্ঘোষণা, ‘তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো’, মানবজীবনে আহরণীয় সমস্ত জ্ঞান যে ঘোষণায় সমাহিত,…’হে মানব, তুমিই সেই’ । তুমিই ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’, তুমিই ভারতীয় দর্শনের অনুকণা, তুমিই মহতী শক্তি, তুমিই যুগে – যুগে ফিরছো নব – নব রূপে, তুমিই বিলীন হয়ে আছো সর্বচরাচরে; তুমিই জীব, ব্রহ্মও তুমিই । তুমিই সেই ‘পরমাত্মনে’, *’অণোরনীয়ান মহতো মহীয়ান্’ — তুমিই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তুমিই বৃহৎ হতেও বৃহৎ । মানব তুমি উপলব্ধি কর ।

(আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবংশীয় হিন্দুদের এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যে সৃষ্টি তত্ত্বের এই সূক্ষ্মাতীসূক্ষ্ম ও গুঢ় রহস্য, জগতে ক্ষুদ্রতমের যেমন শেষ সীমানা নির্দিষ্ট নেই, তেমনই বিশালেরও কোনো নির্দিষ্ট পরিসীমা বা পরিমাপ নেই, সনাতন সভ্যতার ঊষালগ্নেই ভারতীয় ঋষি – মুনিরা সেই তথ্য অবগত হয়েছিলেন ।)

পৃথিবীর অন্ধকার ভেদ করে সূর্যের প্রাণোময় রশ্মি নবতরঙ্গে প্রাণসঞ্চার করে জগতকে করে তোলে নবপল্লবিত । তাই তো সূর্য পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকেই আদি দেবতা হিসাবে পূজিত ।

মকরসংক্রান্তি সেই শাশ্বত সত্যেরই দ্যোতক । মকরসংক্রান্তি সূর্য উপাসনার মহাপর্ব । ভগবান সূর্য, নবীন স্ফূর্তি, চৈতন্য, উৎসাহ ও উদ্দীপনার প্রতীক । সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে যাওয়াকে বলা হয় সংক্রান্তি । কিন্তু মকরসংক্রান্তি বৎসরে একবারই হয় । দক্ষিণায়ণের পরিসমাপ্তির সূচকস্বরূপ সূর্য ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগর পার করে উত্তরের (উত্তর গোলার্ধ) দিকে, অর্থাৎ মকর রাশির অবস্থানের দিকে, এগোতে শুরু করে ।

ধর্মশাস্ত্রে এ’সম্পর্কে একটি সুন্দর ব্যাখ্যান রয়েছে । পিতা সূর্য তাঁর প্রিয় পুত্র, মকর রাশির অধিকারী শনির বাড়ি যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করেন । সূর্যের এই দক্ষিণায়ণ থেকে উত্তরায়ণে যাওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী উদ্দিপ্ত হয়ে ওঠেন । গায়ত্রী মহামন্ত্রে অর্চিত হয়ে সূর্য তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির সঞ্চার করেন সম্পূর্ণ জগতে ।

_মহাভারতে এই উত্তরায়ণ অত্যন্ত বীরোচিত মহিমায় বর্ণিত হয়েছে । ভীষ্ম পর্বের শেষে মহামতি ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত । যশস্বী পিতা মহারাজ শান্তনু তাঁর পুত্র দেবব্রতের সেবা ও অবিচল নিষ্ঠায় তৃপ্ত হয়ে তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর আশীর্বাদ দেন ।…

….আবাল্য ব্রহ্মচারী অকৃতদার পিতামহ ভীষ্ম যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে তাঁর প্রিয়তম প্রপৌত্র অর্জুনের শরাঘাতে স্বেচ্ছায় শরশয্যাশায়ী, গগনদেব সূর্য তখনও রয়েছেন দক্ষিণায়ণে । অন্ধকারাচ্ছন্ন, যুদ্ধ ও জ্বরাগ্রস্থ সেই ঋণাত্মক সময়ে ভীষ্ম প্রাণত্যাগ করতে চাননি কারণ তিনি জানতেন আমৃত্যু সত্য ও ন্যায়ের সাধনা করার পর অসময়ে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক তৃষ্ণা নিবারণ সম্ভব হবে না, তাই তিনি দীর্ঘ ৫৮ দিন শরাবৃত শরীরে অসীম ধৈর্যের সাথে উত্তরায়ণের প্রতীক্ষায় রত হলেন ।

কুরু-পাণ্ডবের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে মহাভারতের অনুশাসন পর্বে, যুগস্রষ্টা শ্রীকৃষ্ণ এসে দাঁড়ালেন মৃত্যুপথযাত্রী ভীষ্মের কাছে । এসেছেন কুরু-নরেশ ধৃতরাষ্ট্র, ধর্মপুত্র বিদুর, সাত্যকী, স্বয়ং মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেব এবং অন্যান্য তেজস্বী মুনি – ঋষিরা; — উত্তরায়ণ শুরু হয়েছে, ভীষ্মের স্বর্গারোহণ সমাসন্ন । সূর্য ধনুরাশি থেকে মকররাশিতে প্রবেশ করছেন, রাত্রির অন্ধকার তমিস্রা ভেদ করে গৈরিক দ্যুতিময় প্রকাশ ছড়িয়ে পড়ছে নীলাকাশে, পৃথিবীতে ।

পুনরাবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর, শীত থেকে উষ্ণতার দিকে, শিথিলতা থেকে স্ফূর্তির দিকে, আলস্য থেকে চৈতন্যের দিকে, হীনতা থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে, অকর্মন্যতা থেকে কর্মঠতার দিকে, শুদ্রতা থেকে গুরুতার দিকে, অজ্ঞান থেকে জ্ঞানের দিকে, অবগুণ থেকে গুণের দিকে, বিপন্নতা থেকে সমপন্নতার দিকে ।

পবিত্র মকরসংক্রান্তি সমাগত । কৃষ্ণ ভীষ্মকে প্রণতি জানিয়ে প্রশ্ন করলেন, — “হে পিতামহ, শেষযাত্রায় আপনি আমার কাছ থেকে কি চান ?”

ভীষ্ম যথাবৎ বিগতস্পৃহ, — “আমি তো কিছুই চাই না ।”
— “আপনার সম্পূর্ণ জীবন ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত পিতামহ, দানের ঔদার্যে পূণ্যময়, তাই আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই । আপনি তো জানেন আমার অদেয় কিছুই নেই, আপনি কিছু গ্রহন করুন,” কৃষ্ণ যাচনা করলেন । মকরসংক্রান্তির পরম পবিত্র লগ্নে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু বরণ করবেন, একজন সনাতনী হিসাবে মোক্ষ লাভ, অর্থাৎ ঈশ্বরে লীন হয়ে যাওয়াই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি । তার চেয়ে বেশী কি চাইতে পারেন ভীষ্ম । তিনি কৃষ্ণকে জানালেন, তাঁর কিছুই চাওয়ার নেই । তবুও কৃষ্ণ পুনরায় আগ্রহ করলেন ।

শেষে মুমুক্ষু ভীষ্ম স্মিত হেসে বললেন, — “হে জনার্দন, হে সর্বজ্ঞ, হে আর্তের উদ্ধারক শ্রীহরি, আজ আমিই আপনাকে কিছু দিয়ে যেতে চাই ।” জগ‌ৎস্রষ্টা শ্রীমধুসূদন চমৎকৃত, সাগ্রহে জানতে চাইলেন কি দিতে চান ভীষ্ম । ভীষ্ম করজোড়ে জানালেন, — “হে কৃষ্ণ, আপনি আমার আজীবনের অর্জিত জ্ঞান নিন, আমার স্মৃতি ও মতি আপনার শ্রীচরণে সমর্পণ করলাম ।”

_কৃষ্ণ কিন্তু ‘কৃষ্ণ’, অর্থাৎ ‘কালো’, কালো মানে অন্ধকার । জ্ঞানের আলো সমর্পিত হলো অন্ধকারে । ভারতীয় দর্শন ও আধ্যাত্মিকতায় দক্ষিণায়ণ ও উত্তরায়ণের এই পারস্পরিকতা লক্ষনীয় ।9

_মকরসংক্রান্তির দিন জপ – তপ – দান – স্নান, শ্রাদ্ধ, তর্পণ ইত্যাদি ধার্মিক ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠানাদি করলে তার ফল শতগুণ বৃদ্ধি পেয়ে অনুষ্ঠান কর্তা ও সমাজের কল্যাণ প্রাপ্তি হয় ।

মহামতি পিতামহ ভীষ্মের শরশয্যা প্রকরণ এই মহাজনগতপন্থাই আমাদের প্রদর্শন করায় যে মকরসংক্রান্তির পূণ্য দিনে দেহত্যাগ করলে মানুষের আত্মা মোক্ষপ্রাপ্ত হয়ে পরমাত্মায় লীন হয়ে যায় । শাস্ত্রমতে উত্তরায়ণ সাকারত্মতা ও দক্ষিণায়ণ নাকারত্মকতার প্রতীক ।

এই দিনটি আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণের জন্যও পরম পবিত্র ।
মকরসংক্রান্তি আক্ষরিক অর্থেই সর্বভারতীয় ধার্মিক উৎসব । এই দিনটি শীতের সমাপ্তি ও বসন্তের সমাগমের প্রতীক । সারা ভারতে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে হিন্দুজন মাত্রেই মকরসংক্রান্তি পালনে মেতে ওঠেন । এই দিনে গো-পূজনের বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে । পাঞ্জাব, হরিয়ানা, জম্মু – কাশ্মীরে এই দিন মহা ধূমধামের সাথে ‘লোহ্ড়ী’ উৎসব পালিত হয় । তামিলনাড়ুর অধিবাসীরা ‘পোঙ্গল’ পালন করেন, তো অন্ধ্রপ্রদেশে ‘উগাদী’ উৎসব পালিত হয় । কর্ণাটকে এই দিন গায় – বলদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বার হয় । ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় গরুর একটি বিশেষ মহত্ত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে । গো-সংরক্ষণের গুরুত্ব এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে সমাজে পরিলক্ষিত হয় । গুজরাটে মকরসংক্রান্তির দিন ‘পতংগ’ উৎসবে (ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব) মেতে ওঠেন মানুষ । রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি সমেত দেশের বিস্তীর্ন অঞ্চলে মকরসংক্রান্তির দিন ‘খিচড়ি’ উৎসব পালন করা হয় । এক কথায় আসমুদ্রহিমালয় দেবভূমি ভারতবর্ষ প্রতি বছর এই দিন আধ্যাত্মিকতার আলোকে উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়ে ওঠে । অন্ধ্রপ্রদেশে হিন্দু মাত্রেরই ঘরে ঘরে, প্রত্যেকটি বারান্দা, উঠোন, ঘরের চৌহদ্দি অপরূপ আলপনার রঙ্গোলীতে সুশোভিত হয়ে ওঠে । অঙ্গনে ছোট – ছোট গোবরের টীকায় ঘাসের তিনকা লাগানো হয় । গৃহস্থ মহিলারা একে অপরকে হলুদ – সিঁদুর – কুমকুম – চন্দনে সাজিয়ে তোলেন । একে অপরের আঁচলে তিল – গুড় ঢেলে দেন । একে অপরের ঘরে চাল, ডাল (মুগের ডাল), বেগুন, কুল ইত্যাদি উপহার পাঠান । মহারাষ্ট্রে প্রতিটি নববিবাহিতা মহিলা, ধনী – দরিদ্র নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে তুলো, তেল, লবন প্রভৃতি সামগ্রী অন্য সধবা মহিলাকে দান করেন । তিল – গুড়ের হালুয়া বানিয়ে প্রতিবেশী, আত্মীয় ও পরিচিত জনের মধ্যে বিলি করেন । স্মরণাতীত কাল ধরে সমগ্র ভারতে প্রত্যেক বছর এই দিনটি এক অনন্য সামাজিক উৎসব রূপে পালিত হয়ে থাকে ।

মকরসংক্রান্তির দিনটি আরও একটি বিশেষ কারণে স্মরণীয় । এই মকরসংক্রান্তির পূণ্য দিনেই মহান তপস্বী রাজা ভগীরথ পতিতপাবনী মা গঙ্গাকে মর্ত্যধামে অবতীর্ণ করিয়ে পূণ্যতীর্থ গঙ্গাসাগরে ভগবন কপিলমুনির আশ্রমে রক্ষিত সগর রাজার ষাট হাজার পথভ্রষ্ট পুত্রের ভস্মীভূত অস্থিতে মা গঙ্গার পবিত্র স্পর্শে তাঁদের আত্মার মোক্ষপ্রাপ্তি ও স্বর্গারোহণের পথ খুলে দেন । এই প্রসঙ্গে সাংখ্যশাস্ত্র প্রণেতা ও স্বয়ং ভগবানের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ভগবন কপিলমুনির উল্লেখের মাধ্যমে শাশ্বত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সম্মুখে হিন্দু দর্শনের ঔদার্যের বিষয়টি লক্ষ্যনীয় হয়ে আছে । এ’কথা স্মর্তব্য যে এই ভারতবর্ষেই, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও যোগেশ্বর পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ‘সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ’ বলে ভগবন কপিল মুনিকে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করে গেছেন । তাঁর আশ্রমের কাছে এসেই মা গঙ্গা সমুদ্রে সমাহিত হন ।

_মকরসংক্রান্তি ঋতু পরিবর্তন এবং কৃষি ও কৃষিজ উৎপাদনেরও দ্যোতক । এই উৎসবের মধ্য দিয়েই আমরা অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারি যে মানুষ প্রকৃতিরই সন্তান, তাঁরই অংশবিশেষ, মানব ও প্রকৃতি এক ও অভিন্ন । সম্পূর্ণ জগৎ সংসার যেমন জীবনের জন্য সূর্যের কাছে ঋণী, সূর্যের ওপর নির্ভরশীল, আমরা, মানুষরাও ঠিক তেমনি সূর্য তথা প্রকৃতি নির্ভর । নদী ও সঙ্গমের তীরে মেলা বসা ও পূণ্য স্নানের মাধ্যমে মানব ও প্রকৃতির সেই শাশ্বত একাত্মতারই জয়গান করে সনাতন সমাজ । প্রতি বৎসরান্তের এই মকরসংক্রান্তি পর্ব তাই ভারতীয় তথা সনাতনী মাত্রের জন্যই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।

বিভিন্ন রাজ্যে মকরসংক্রান্তি উৎসবের ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে । যেমন কর্ণাটকে মকরসংক্রান্তি ইল্লু – বিল্লা, মহারাষ্ট্রে তিলগুল, আসামে ভোগালি বিহু আর উড়িষ্যার একাংশে টুসু নামে পরিচিত । আমাদের প্রিয় বাংলায়, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গেও মকরসংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি বা নবান্ন অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ধার্মিক অনুষ্ঠান । পশ্চিমবঙ্গের আপামর বাঙ্গালী হিন্দু পৌষ মাসের অন্তিম দিনে ঐতিহ্যবাহী এই ফসল তোলার উৎসবটি হর্ষোল্লাসের মধ্যে দিয়ে পালন করেন । উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ডিসেম্বর মাসের শেষে মাঠের নতুন ধান গোলায় ওঠে । খেজুর গাছের সুমিষ্ট রসে তৈরী নতুন নলেনগুড় আর খেজুর পাটালির সুঘ্রাণে বাতাস আমোদিত হয়ে ওঠে । ঘরের চালায় লকলকিয়ে ওঠা নতুন লাউ, উঠোনে ধনেপাতা, মূলো । পরিবারের মহিলা সদস্যরা সকলে মিলে রকমারি ও সুস্বাদু পিঠে – পুলি – পায়েস প্রস্তুত করেন । আগেকার দিনে গ্রাম ঘরে এই জন্য ঢেঁকিতে চাল কোটা ( গুড়ি কূটা উৎসব) হতো । আজও গ্রামের ঘরে ঘরে আলপনা, নতুন সাজ – সজ্জা ও ঘরবাড়ি, রান্নাঘর পরিপাটি করে পরিষ্কার করে তোলা হয় । গুজরাটের পতংগ উৎসবের মতোই এই রাজ্যেও ঐ দিন আকাশে প্রচুর রং – বেরং-এর ছোট, বড়ো সুদৃশ্য ঘুড়ি ওড়ানো হয় । সন্ধ্যের পর শহর ও গ্রামের মানুষ আকাশে ফানুস উড়িয়ে আর পটকাবাজী ফাটিয়ে উৎসবটিকে আনন্দময় করে তোলেন ।

মকরসংক্রান্তির পূণ্য লগ্নে পূণ্যার্থী বহু মানুষ, বহু যোগী ও সাধু সারাদেশ থেকে এসে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে পূণ্যস্নান করেন । গঙ্গাসাগরে বিশাল মেলা বসে এই উপলক্ষে । বীরভূমের কেন্দুলী-তেও এই দিনে বিখ্যাত জয়দেবের মেলা (জয়দেব কেন্দুলী মেলা) বসে । বহু বাউল – কবিয়াল সেখানে পৌঁছে লোকসঙ্গীতের বৈচিত্র্যময় আসর জমিয়ে দেন । গঙ্গাসাগরের মেলা এবং জয়দেব – কেন্দুলীর মেলা, দুটিই বিশেষ ঐতিহ্যময় ও জগৎ বিখ্যাত অনুষ্ঠান ।

মকরসংক্রান্তির দিনটি ভারত ও নেপালের আধ্যাত্মিক মিলনেরও দিন । উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের জগদবিখ্যাত গোরক্ষনাথ মন্দিরে গুরু গোরক্ষনাথের দর্শনের জন্য বিশাল সংখ্যায় ভক্তদের সমাগম হয় । নেপালের রাজা বিচ্যুত সেই মন্দিরের সর্বপ্রথম ভেঁট প্রদান করেন । কাশী মথুরাতেও এই পূণ্য দিনে বিশাল ও সুব্যবস্থিত মেলা আয়োজিত হয় । সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দুরা মঠে – মন্দিরে উপস্থিত হয়ে সাধ্যানুযায়ী পূজার্চনা করেন ।

মকরসংক্রান্তির অন্যতম মহত্ত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সামাজিক সমরসতা । এর গুরুত্ব অপরিসীম । শ্বেতশুভ্র তিলের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে থাকা হিন্দু সমাজকে তিল – গুড়ের নাড়ুর মতোই আত্মীয়তা ও একাত্মতার সুমিষ্ট বন্ধনে বেঁধে এক ঐক্যবদ্ধ, একাত্ম, সুসংগঠিত ও সমরস হিন্দু সমাজ গড়ে সমৃদ্ধ ও সুসংহত জীবন নির্মাণ মকরসংক্রান্তি উৎসবের অন্যতম প্রধান বিষয় । সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক, মঠ – মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সাধু – সন্যাসী ও ভক্তমন্ডলী পূণ্যময় এই মকরসংক্রান্তি তিথিতে সমাজের প্রান্তিক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন ।

আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, মকরসংক্রান্তি যখন পরিবর্তন আনে, তখন সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন যাতে সমাজ সম্যক দিশায় অগ্রসর হয় । সম্যক অর্থাৎ, সঠিক দিশা । ভারতের সনাতনী সমাজের হিতার্থে বহু সমাজসুধারক মনীষী এসেছেন । শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ, আচার্য্য চাণক্য, ছত্রপতি শিবাজী, গুরু গোবিন্দ সিংহ জী, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও যুগাচার্য্য স্বামী প্রণবানন্দ ব্রহ্মচারীজী মহারাজের মতো প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের মার্গদর্শন, ত্যাগ, তপস্যা ও বীরোচিত বলিদান হিন্দু সমাজকে বারংবার সেই সম্যক দিশার পথদর্শন করেছে ।


জয়তু মা ভারতী
বন্দে ভারত মাতরম্

(দেবব্রত ভট্টাচার্য্য)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.