শ্রীরামকৃষ্ণ-সত্তায় অর্ধেক রাম, অর্ধেক কৃষ্ণ; ইদানীং তিনি রামকৃষ্ণ। একইদেহে রাম আর কৃষ্ণ সুমধুর; একতারাতে দোঁহে বাঁধা। অথচ অবতার-বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণ-র পরিচিতির মধ্যে বাংলার বুধজন যেভাবে তাঁর শ্রীরাম সত্তাকে, শ্রীরাম-সাধনাকে লুকিয়ে রাখতে চান, তার মধ্যে অনৈতিক উদ্দেশ্যই কাজ করে। সুযোগসন্ধানী মানুষ তো বলেই বসেন, বাংলায় শ্রীরাম-সাধনা একেবারেই অপ্রচলিত, একটি রাজনৈতিক দলই তার আমদানি ঘটিয়েছে। কিন্তু সত্যিই কী তাই?
১. গদাধরের (শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্যনাম) পিতামহ মানিকরাম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ‘দেরে’ গ্রামের এক সদাচারী ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ; দিন কাটতো রঘুবীরের সেবায়। গদাধরের পিতা ক্ষুদিরাম রঘুবীরের পুজো না করে জল পর্যন্ত স্পর্শ করতেন না। জমিদার রামানন্দ রায়ের অত্যাচারে যখন ক্ষুদিরামকে দেরে গ্রাম ছেড়ে কামারপুকুর চলে আসতে হল তখন প্রায় কর্মহীন ক্ষুদিরামের সিংহভাগ কাটতো তার আরাধ্য রঘুবীরকে নিয়ে; রাম-ই তখন তাঁর একমাত্র শান্তি ও প্রাণের আরাম।
২. মানিকরাম সহ তাঁর বংশের প্রায় সকলের নামের মধ্যে ‘রাম’ কথাটি যুক্ত হয়েছিল, তা অবশ্যই অচেতনভাবে নয়। মানিকরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র তথা শ্রীরামকৃষ্ণের পিতার নাম ‘ক্ষুদিরাম’। মানিকরাম তার অপর দুই পুত্রের নাম রাখলেন ‘নিধিরাম’ ও ‘কানাইরাম’; কন্যার নাম ‘রামশীলা’। ক্ষুদিরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘রামকুমার’, মধ্যমপুত্র ‘রামেশ্বর’; কানাইরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘রামতারক’; রামশীলার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘রামচাঁদ’; রামশীলার দৌহিত্র ও দৌহিত্রীদের নাম যথাক্রমে ‘রাঘব’, ‘রামরতন’, ‘হৃদয়রাম’ এবং ‘রাজারাম’।
৩. ক্ষুদিরাম এক গ্রীষ্মকালের দুপুরে কাজে বেরিয়েছেন দূর গ্রামে; রৌদ্রতেজে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। পথে এক বৃহৎ গাছতলের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন-ই দেখলেন এক বিচিত্র স্বপ্ন। এক শ্যামলা ছেলে বায়না করছে তাকে যেন ক্ষুদিরাম সঙ্গে নিয়ে যান। ক্ষুদিরামের তখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু চিনতে পারেন, সেই শ্যামল সুন্দরকে; এ তো বালক রঘুবীর! তিনি দেবসেবা করবেন কী করে! বালক বলছে, সে তো বিশেষ কিছু চায় না, ক্ষুদিরাম যেভাবে রাখবেন সেভাবেই খুশি থাকবেন। তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। নির্দেশ অনুযায়ী পাশের ধানক্ষেতে গেলেন। মাটির ঢিপির পাশে এক শালগ্রাম শিলা; একটি বিষধর সাপ তার পাশে। সাপ সরে গেলে আনন্দে শিলাখণ্ডটি মাথায় তুলে নিলেন ক্ষুদিরাম। চিনতে ভুল হয় না তাঁর; এ যে সত্যিই রঘুবীর শিলা! অতঃপর রঘুবীর-ই হয়ে উঠলেন ক্ষুদিরামের গৃহের অন্যতম আদরের রামলালা। শিলাখণ্ডটিকে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের ঘটের পাশে স্থাপন করলেন; রাঘব রঘুনন্দন-ই তাঁদের গৃহদেবতা হলেন।
৪. আনুমানিক ১২৩০ সনে ক্ষুদিরাম রামেশ্বর তীর্থ দর্শনে যান এবং একটি বাণলিঙ্গ নিয়ে ফেরেন। ১২৩২ সনে জন্ম নেয় তার দ্বিতীয় পুত্র রামেশ্বর। ওই তীর্থে শ্রীরামচন্দ্র শিবের উপাসনা করেছিলেন।
৫. শ্রীরামকৃষ্ণের দাদা রামকুমারকে দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর সেবার দায়িত্ব তুলে দিলেন রাসমণি। ঘটনাক্রমে এই রাসমণির বাপের বাড়িতেও ছিল রঘুবীর। আর রাসমণি বিয়ের পর অচেনা সন্ন্যাসীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন সুলক্ষণ রামশিলা। বোধহয় রামকুমার ও রাসমণির জীবনে এ এক আশ্চর্য সমাপতন। রাসমণি কী চেয়েছিলেন? শ্রীরাম-ঘরানার কোনো পুরোহিতই আদ্যাশক্তির পুজোর ভার নেবেন? শ্রীরাম যোদ্ধাবতার, ক্ষত্রিয় বীর; মা কালী অসুর-দলনী। দেশপ্রেমী জমিদার গিন্নীর নেপথ্য-ভাবনা কী ছিল বাঙ্গলার মাটিতে শক্তি সাধনার পীঠ তৈরি করা? তাতে সমন্বয় সাধিত হোক রাম আর কালী?
৬. শ্রীম কথামৃতে লিখছেন দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দিরে তার প্রথম দিনের দর্শনের কথা, “এক পার্শ্বে পরমহংসদেবের সন্ন্যাসী হইতে প্রাপ্ত অষ্টধাতু নির্মিত রামলালা নামধারী শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহমূর্তি ও বাণেশ্বর শিব।” তা এই রামলালা ঠাকুর পেলেন কীভাবে?
৭. ১২৭০ সন, তীর্থযাত্রা পথে বিশ্রাম নিতে কালীবাড়িতে এলেন জটাধারী নামক রামাইত সাধু; নিত্য যার সঙ্গে ধাতুনির্মিত শ্রীরামচন্দ্রের শৈশবমূর্তি থাকে। তার ধ্যানজ্ঞান শ্রীরামকৃষ্ণের নিরন্তর সান্নিধ্য; তার অনুভূতি — শ্যামবর্ণ জ্যোতির্ময় শ্রীরাম নিত্য পুজো নেন তার কাছ থেকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ খুঁটিয়ে দেখলেন এই সেবক-সাধুর রামপূজন, সাধন-ভজন-আরাধন; আর জটাধারীর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে লাগলো। শ্রীরামচন্দ্রের শিশুমূর্তিতে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমাকুল হয়ে উঠলেন। তার মনও ধাবিত হল মায়ের স্নেহের মত রামলালাকে সেবা করতে, দেবশিশুকে কোলে নিতে। ঠাকুরের আগ্রহ দেখে জটাধারী তাকে রামলালার মন্ত্র দিলেন; ঠাকুর মন্ত্র পথে শ্রীরামের অনুসারী হলেন। ঠাকুরের দৈব্য-সেবায় শ্রীরাম ধরা পড়লেন, তিনি দিব্যদর্শন পেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্মুখে এবার আবির্ভূত হলেন দশরথ তনয় শ্রীরঘুপতিরাম; সাধনায় সিদ্ধ হলেন ঠাকুর। আর এই দিব্যলীলা দর্শন করে জটাধারী শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে গেলেন তার রামলীলা বিগ্রহটি; উপযুক্ত উত্তরাধিকারই বটে!
এদিকে রানী রাসমনীর গৃহদেবতাও তো রঘুবীর! রঘুবীর মন্ত্রে স্বামীজিও যে সাধনা করেছেন! সে আলোচনা যথেষ্ট দীর্ঘ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। আজ পুণ্য রামনবমী তিথিতে বাঙালি যেন দিশাহীন হয়ে, শ্রীরামচন্দ্রকে কেবল ‘খৈনিটেপা খোট্টাদের দেবতা’ বলে ধরে না দেন। অবাঙালিকে অশ্রদ্ধা করতে গিয়ে ‘প্রাণারাম’-কে কেড়ে নিতে পারেন না কেউ। প্রকৃত বাঙালি যেন মনে রাখেন। আর বাংলা ভাষায় কথা বললেই কেউ ‘বাঙালি’ হয়ে যান না। বাঙালি হতে গেলে বাংলার হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের সামীপ্যে সান্নিধ্যে থাকতে হয়। রঘুবীরের বিরোধিতা করে বাঙালি হওয়া যায় না।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।