প্রথম পর্ব
তেমন কিছু নয় , শোলার ফুল চাঁদের আলোয় সত্যি মনে হয়
তেমন কোনো দোষদেখা হল না, এই যা আফশোস
ফুলের সোনায় জলজমেছে ভাই, এবার ফিরে চল
পাহাড়তলির পাড়াএখন ঘুমে, বাজাব একতারা
তেমন কোনো ভুলকোথায় আর, শুধুই শোলার ফুল … ( অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় )
সনাতনের যেকোনো মাঙ্গলিক কার্যে এক অপরিহার্য প্রাকৃতিক বস্তু হল শোলা। পূজা, উপাসনা, বারব্রত, বিবাহ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন ইত্যাদি সকল কার্যেই শোলাকে প্রয়োজন হয়। একটা দীর্ঘ সময়কাল পর্যন্ত বঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠানে গৃহ বা মঞ্চ সজ্জার অন্যতম উপাদান ছিল শোলার তৈরী কদম ফুল, নানা আল্পনা, চাঁদমালা। তাছাড়া পূজার সময় ঘট থেকে দেবদেবীরমূর্তি সর্বত্র শোলার চাঁদমালা একান্ত অপরিহার্য …. নারায়ণের আশীর্বাদে শুদ্ধ শোলার নির্মিত গহনা ,মানে এখন আমরা বলি ডাকের সাজ , সে সাজ ব্যতীত যেন দেবদেবীর অঙ্গসজ্জা সম্পূর্ণ হয় না। শোলার সাজকে যদিও সেই অর্থে ডাকের সাজ বলা ভুল। প্রশ্ন হলো , ডাকের সাজ শব্দটি এলো কোথা থেকে?
পুরানো দিনে দূর্গা মূর্তির সজ্জা হলো এই বিখ্যাত ডাকের সাজ।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জার্মানি থেকে আমদানি করা হতো রাংতা, যার হাত ধরে এল ডাকের সাজের কনসেপ্ট। যেহেতু ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমেই আসতো এর সরঞ্জাম, নাম হল তাই ডাকের সাজ। তাই দেশীয় শোলার তৈরী গহনাকে কোনোভাবেই ডাকের সাজ বলা যায় কি ? যাক সেসব বিতর্কে না গিয়ে আজ আমি শোলা শিল্প নিয়ে লিখব। আর ক’দিন বাদেই দুর্গা পূজা। চিন্ময়ী মা মৃন্ময়ী হয়ে আমাদের গৃহে আসবেন। তিনি অপরূপা এবং তাঁর এই অপরূপ মূর্তি কেবল তাঁর প্রকৃতির সংসারে জন্মপ্রাপ্ত শোলার গহনার সাজে যত সুন্দর হয়ে ওঠে , স্বর্ণালঙ্কারও সেসবের নিকট ফিকে হয়ে যায়।
মহামায়া প্রকৃতির সংসার হতে নানা বস্তুর মাধ্যমে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ,বাসস্থানের জন্য নানা উপাদান সংগ্রহ করে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। প্রকৃতি মাতার অফুরন্ত সম্পদকে নানাভাবে , নানারূপে নিৰ্মাণ , বিনির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করে নিজ প্রয়োজনে লাগিয়েছে। প্রয়োজনের পর আসে নান্দনিক বোধ। সেখানেও প্রাকৃতিক সম্পদ।।ক্রমে জলজ উদ্ভিদ শোলা দিয়ে পুষ্পাভরণ ও শোলার আভরণ অলঙ্কার নির্মাণে সমাজের একটি গোষ্ঠী দক্ষ হয়ে উঠলেন। কল্পনায় এবং ধৃতিতে নতুন নতুন রীতি আবিষ্কার করে এই শিল্পকে সর্বজন গ্রহণীয় , অনিবার্য করে তুললেন। তখন এই শোলা শিল্পই হল তাঁদের মূল জীবিকা।
শোলা একটি জলজ উদ্ভিদ। বঙ্গের গ্রামে শোলা নিয়ে একটি প্রবাদ সুপ্রচলিত আছে –
” জলে জন্ম, পাড়ে কর্ম কারিগরে গড়ে , দেব নয় , দেবতা নয় মাথার উপর চড়ে”
হ্যাঁ , বস্তুটি যে টোপর এবং সেটি যে শোলা দ্বারা নির্মিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শোলা এই যেন নামকরণের কারন বা উৎস সন্ধান করতে গেলে আমরা জানতে পারব সলিল থেকে সোলা বা শোলা কথাটি জাত। সলিল থেকে সলিলা , সলা এবং শেষে সোলা বা শোলা।
ইংরেজি নাম sponge এবং বোটানিক্যাল নাম Aeschynomeha aspera. জলা ,জঙ্গল, খালে বিলে এর জন্ম। আগে এই জলজ উদ্ভিদকে মানুষ জ্বালানি হিসাবের ব্যবহার করত। বিশেষ করে আগুন জ্বালার সহজ উপায় হিসাবে যখন চকমকি পেল। এক খন্ড লোহাকে পাথরের বুকে ঘর্ষণ করে তার স্ফুলিঙ্গ শোলার বুকে ধরে রাখা সহজ দাহ্য বলে আগুন জ্বালার কাজটি অতি সহজেই সম্ভব হতো।
ধীবর সম্প্রদায় শোলার আঁঁটির ভেলা করে মাছ ধরতে যেতেন। আয়তনের তুলনায় ওজন কমে থাকায় , নিমজ্জিত অবস্থায় অপসারিত জলের ওজন শোলার ওজন থেকে অধিক হয়। পশ্চিমে তখনও আর্কিমিডিস আসেন নি এবং তিনি ইউরেকাও করেন নি। সেই ইউরেকা হবার পূর্বেই ভারতের অজানা অনামী গাঁয়ের মানুষজন বংশপরম্পরায় এই জলজ উদ্ভিদটিকে মাছ ধরার কাজে ভেলা হিসাবে ব্যবহার করতেন।
শোলা বড় নরম , বড় হাল্কা। মালাকার সম্প্রদায়ই প্রথম এই নরম শোলাকে কেটে সূক্ষ্ম নৈপুণ্যে অলঙ্কার , গৃহসজ্জার নানান বস্তু নির্মাণে ব্যবহার করলেন। আঁশ ছাড়িয়ে লম্বা লতি বানিয়ে তৈরি হতে লাগল নানা গহনা। তার কত বাহার….সাধারণ মানুষ যাঁরা গজমোতির হার পেতেন না তাঁরা কাঠ, পাথর, পোড়ামাটি ,শোলার অলঙ্কারে সুসজ্জিত হয়ে উঠতেন। কেবলমাত্র কি মানুষ ? যে গৃহ বা যে দেবলায়ে , যে দেব থানে ভক্তি থাকত আড়ম্বর থাকত না সেই দেবালয়ের দেবদেবীরাও সুসজ্জিতা হয়ে উঠতেন শোলার গহনায়। তৈরি হতো তাঁদের মাথার মুকুট , মুকুটের খোল।
অনেকে স্থানের লৌকিক বা গ্রাম্য ভাষায় শোলাকে #খাড়া বলা হতো। জলের মধ্যে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তো শোলা গাছ… তাই এমন নাম। এছাড়াও বিয়ের টোপর, চাঁদমালা, গঙ্গা পূজায় ভাসানোর জন্য নৌকা মাথার টুপি ইত্যাদি নানান লোকশিল্প একত্রে হয়েছে শোলা শিল্প।
পূর্বেই বলেছি যাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা মালাকার সম্প্রদায় বা পদবির হন। কেন মালাকার ? প্রাচীন ভারতবর্ষে লোকশিল্প বংশপরম্পরায় হওয়ার জন্য তাঁদের পেশাগত দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পায় , তেমনি ওই কর্মরত ব্যক্তিবর্গকে একটি সম্প্রদায়ে অভিহিত করা হয়। যেরূপ – পুষ্প ও শোলা শিল্পীদের নাম হয় মালাকার সম্প্রদায়। সেই প্রাচীন কাল হতে যাঁরা অরণ্য থেকে পুষ্প চয়ন করে দেবতার লাগি, মন্দিরে মন্দিরে মালা গেঁথে , পূজার পুষ্পের যোগান দিতেন, যাঁদের হাতের গাঁথা মালায় কত অপরূপা সুন্দরী আরো অপরূপা হয়ে উঠতেন, যাঁদের যোগান দেওয়া বনফুলে রাজা থেকে সাধারণ মানুষের গৃহ সুসজ্জিত হয়ে উঠত তাঁদের মালাকার আখ্যা দেওয়া হতো।
অনেক মালা গেঁথেছি মোর
কুঞ্জতলে,
সকালবেলার অতিথিরা
পরল গলে।
সন্ধ্যেবেলা কে এল আজ
নিয়ে ডালা!
গাঁথব কি হায় ঝরা পাতায়
শুকনো মালা!
যাঁরা মালা গাঁথতেন অনেকক্ষেত্রেই তাঁরা পুষ্প উদ্যান পরিচর্যা করতেন না। যাঁরা উদ্যান পরিচর্যা করতেন তাঁদের মালি বলা হতো। মালি নানান নাম জানা , না জানা অপূর্ব ফুল ফোটাতেন । মালাকার সেসব পুষ্প চয়ন করে নানা আভরণে দেবতা হতে মানুষ সকলকে সুসজ্জিত করতেন। ক্রমে পুষ্পের কাজের সঙ্গে দেব সজ্জায় শোলার কাজেও এঁরা দক্ষ হয়ে উঠলেন। মালাকার সম্প্রদায়কে নিয়ে , শোলা গাছ নিয়ে নানা পৌরানিক কথা আছে , একটু বলি –
শ্ৰীকৃষ্ণ , শ্ৰীবলরাম – তাঁদের বড় অন্তরঙ্গ সখা সুদামা। সুদামা নিতান্তই দরিদ্র ব্রাহ্মণ। কিন্তু কৃষ্ণ ,বলরামের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অপরিসীম। সুদামা বনপুষ্পের মালা গেঁথে নিত্য তাঁর প্রিয় সখাদ্বয়কে সাজাতেন। তাঁর এক মাত্র চিন্তা ছিল কোনদিন কোন পুষ্পের অলঙ্কার দিয়ে বন্ধুদ্বয়কে সাজানো যায়। এরই জন্য সুদামা সারাদিন বনে বনে ঘুরে নানান নাম না জানা পুষ্প চয়ন করে বেড়াতেন। তারপর সেইসব পুষ্প বেঁধে , গেঁথে নানান অলঙ্কার তৈরি করতেন। দিবারাত্রি মালা গাঁথার জন্য সুদামা বড় পরিশ্রম করতেন , নিমগ্ন থাকতেন সেই কার্যে। এদিকে সুদামার দারিদ্র উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল , নিঃস্ব হয়ে পড়লেন তিনি। সুদামা অর্ধাহারে , অনাহারে কালাতিপাত করতে লাগলেন , তবুও তাঁর কৃষ্ণ প্রেমে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ল না।
এভাবে দিন অতিবাহিত হয়। এবার কংস বধের জন্য কৃষ্ণ বলরামকে বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা যেতে হবে। এ জন্য তাঁরা যোদ্ধা বেশে প্রস্তুত হচ্ছেন তাঁরা। এবার তাঁদের আর মোহন বেশ চলবে না। বীর বেশ ধারণ করে যেতে হবে মথুরা। বীর সাজে সাজিয়ে দেবার নিমিত্ত কৃষ্ণ ও বলরাম সুদামার কাছে এলেন। কিন্তু সুদামার ঘর নেই। একটি ছোট্ট কুঁড়ে ছিল , তাও ঝড়ে ভেঙে পড়েছে , এখন বকুল গাছের তলায় তাঁর নিবাস।
কৃষ্ণ বলরামকে দেখে সুদামার আনন্দের সীমা থাকল না। কিন্তু বন্ধুদের বসতে দেবেন কোথায় ? না আছে ঘর , না উঠান, না কোনো আসবাব বা চাটাই। বড় বিব্রত বোধ করলেন তিনি। অবশেষে কৃষ্ণ বলরামকে যথাযোগ্য আদর আপ্যায়ন করে নিজে অনাবৃত বকুল তলায় শুয়ে পড়লেন। বললেন, ” ঠাকুর , আপনাদের বসতে দেবার জায়গা নেই, আসন নেই আমার কাছে। দয়া করে আপনারা আমার বক্ষে বসে বিশ্রাম নিন।” শ্ৰী কৃষ্ণ, বলভদ্র সুদামার এই অতুলনীয় প্রেম , ভক্তি দেখে কেঁদে ফেললেন । বললেন , ” আমরা এই বকুল তলেই বসি। আর তো বৃন্দাবন ফিরব না। কংস বধের জন্য যাব মথুরা । তুমি আমাদের বীর বেশে সাজিয়ে দাও। “
সুদামা পড়লেন বড় চিন্তায়। বনফুলের মালায় এতদিন তিনি সখাদের মোহন বেশে সাজিয়ে আসছেন। আজ সেই বনের ফুলে কেমন করে বীর বেশ দেবেন ?
তবুও তাঁর প্রিয় সখা চেয়েছেন তাই তিনি বীর বেশে সজ্জার একটি প্রয়াস করলেন। কৃষ্ণ , বলভদ্রকে পীত বসন মল্লকচ্ছ করে পরালেন। উভয়ের মস্তকে পীত বর্নের পাগড়ি সুশোভিত হতে লাগল। তাঁদের হাতে তাঁদের সঙ্গে আনীত অস্ত্র তুলে দিলেন । তাঁরা ধনুর্বান সহ পদ্মে সুশোভিত হয়ে উঠলেন। নানা সুগন্ধী বনজ পুষ্পের আভরণ নিৰ্মাণ করে দুই প্রভুকে সাজালেন। তাঁদের গলে, হস্তে, কর্ণে বনফুল শোভা পেতে লাগল। তাঁদের কপালে চন্দন, কুঙ্কুমের তিলক এঁকে দিলেন সুদামা। বীর বেশ ধারণ করে কৃষ্ণ বলভদ্র চললেন মথুরা।
মথুরা ও দ্বারকার প্রতাপশালী মহারাজ যাদবশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ বলরাম সিংহাসনে বসেও বন্ধু সুদামার কথা বিস্মৃত হন নি। পূর্ব পূর্ব জন্মের অভিশাপে সুদামা চরম দারিদ্র্যে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। তাঁর সেই অভিশাপের অন্তিম পর্যায়ে এল। একদিন সুদামা কিছু চিপিটক নিয়ে এলেন সখাদের সঙ্গে দেখা করতে। তখন সুদামার দারিদ্র চরমে। তার দারিদ্রতার নিমিত্ত ব্রাহ্মণ সে সমাজে প্রায় অচ্ছুৎ ন্যায় বাস করে। কৃষ্ণ রাজদুয়ার হতে পরম সমাদরে তাঁকে নিয়ে এলেন। তাঁর দেওয়া শুষ্ক চিপিটক পরম তৃপ্তি করে খেলেন যাদবশ্রেষ্ঠ। ব্রাহ্মণ সখার পা ধুইয়ে তাঁর সেবা করলেন। তারপর বলভদ্র এবং কৃষ্ণ বললেন , ” এত দিন তুমি নিঃস্বার্থে আমার সেবা করেছ। তোমার মতো বন্ধুপ্রেম পৃথিবীর বুকে অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে। বল কি বা চাও ? “
সুদামা দরিদ্র কিন্তু লোভী নয়। দারিদ্রতার নিমিত্ত তিনি ও তাঁর পরিবারকে নিত্য সমাজে লাঞ্ছনা , গঞ্জনার স্বীকার হতে হয়। তবুও, অশ্রু বিগলিত কন্ঠে সুদামা বললেন , ” আমি তোমার শ্ৰী চরণ ব্যতীত কি বা চাইব ? তবুও যদি কিছু দিতে চাও , তবে এই বর দাও – দরিদ্র হবার নিমিত্ত আমি যে যন্ত্রনা ,হীনমন্যতায় ভুগী তা যেন আমার বংশ না ভোগে। আমাকে কেবলমাত্র দারিদ্রতার কারনে এই সমাজ যেমন অচ্ছুৎ করেছে , আমার সেই বংশের ছোঁয়া ব্যতীত যেন দেব পূজা সম্পন্ন না হয়। “
কৃষ্ণ , বলভদ্র বললেন , ” তুমি বনে বনে পুষ্প চয়ন করে বাল্য ও কৈশরে আমাদের সুজ্জিত করতে সুদামা। তুমি নিঃস্ব হয়ে একদিন বকুল তলে আমাদের বীর বেশ দান করেছিলে। আজও তুমি নিঃস্ব হয়েও কেবল বনের ফুলে মালা গেঁথে নারায়ণ পূজা করো। তাই তোমার বংশজ পবিত্র মালাকার জাতি হবে। তাঁদের নির্মিত অঙ্গ, গৃহ সজ্জা ব্যতীত দেবপূজা সম্পন্ন হবে না। তাঁরা কোনদিনও অপবিত্র ,অশুচি হবেন না। পরম পবিত্র জাতি বলে তাঁরা গণ্য হবেন।”
সুদামা প্রত্যহ কৃষ্ণ ও বলভদ্রকে বনের ফুল ও বেলপাতা দিয়ে সজ্জা ও পূজা করতেন। সখাদের অনুপস্থিতিতে তিনি নারায়ণের উপাসনা করতেন । নারায়ণের নাম জপ করতে করতে একদিন সুদামা বিল্ববৃক্ষ হতে পত্ৰ সংগ্রহ করছিলেন। নাম গানে সে সময় তিনি বিভোর হয়ে পড়েন। বিভোর হয়ে তাঁর পৈতে বেলগাছের কাঁটায় আটকে গেল। এরপর পৈতা ছাড়াই তিনি পূজায় গেলেন। লোকে গঞ্জনা দিতে লাগল তাঁকে। লজ্জিত সুদামা, কুন্ঠিত হয়ে মন্দিরের বাইরে বসে রইলেন। সেই সময় কৃষ্ণ সখার ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে সেথায় উপস্থিত হয়ে নিজ মুখে বললেন, ” তোমার ভক্তি, তোমার ঈশ্বর প্রেম, তোমার সখাভাবই তোমার মূল উপবীত। তাই আমি তোমাকে তো বর দান করেছি যে, তোমার বংশজ শুদ্ধ। তোমার পুণ্যে তাঁরা উপবীত হীন হয়েও আমার বিভিন্ন রূপককে পূজার অধিকার পাবেন। তাঁদের নিৰ্মাণ ব্যতীত পূজা অসম্পূর্ণ থাকবে। “
তাই হয়তো আজও একটি প্রবাদ আমাদের মুখে মুখে প্রচলিত আছে – ” চেনা বামুনের পৈতে লাগে না….” প্রসঙ্গত , বঙ্গে এক সময় আচার্যি ব্রাহ্মণরাও শোলার কাজ করতেন। তাঁরাও শিল্পী সমাজের মধ্যেই পড়তেন। তাঁদের মধ্যে বহু উৎকৃষ্ট শিল্পীও ছিলেন।
তাছাড়াও শোলা একটি পবিত্র জলজ উদ্ভিদ। কথিত আছে, সমুদ্র মন্থনের সময় নারায়ণ কূর্ম অবতার ধারণ করেন। সেই কার্য সম্পন্ন হলে কূর্ম রূপে যখন তিনি জলে অবস্থান করছেন তখন কোনো একদিন এক ব্যাধ তাঁকে শিকার ভেবে তাড়া করেন। কূর্ম রূপী নারায়ণ এক জলাশয়ের মধ্যে কালো গুচ্ছ মূলের ভেতর আশ্রয় নেন। সেগুলি শোলা গাছ ছিল। নারায়ণ আপন রূপ ধারণ করে ব্যাধ ও শোলা গাছকে দর্শন দেন। শোলা গাছকে তিনি বর প্রদান করলেন , ” যেহেতু তোমার মধ্যে যেকোনো জলজ প্রাণী আশ্রয় নিয়ে আপন আপন প্রাণ রক্ষা করতে পারে ,তাই আজ থেকে তুমি শুদ্ধ উদ্ভিদ হলে। তোমাদের দ্বারা চিরকাল দেব পূজা সম্পন্ন হবে।”
ক্রমশঃ
©দূর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. অনবদ্য শোলা শিল্প
২. শোলা শিল্প : ডঃ বাদল চন্দ্র সাহা