সেই শ্বেত শুভ্র কোমল সুন্দর শিল্পের কথা – চতুর্থ পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত দুরকমের শোলা গাছ পাওয়া যায়- ফুল শোলা এবং কাঠ শোলা। সাধারণত শোলা শিল্পে ফুল শোলার বহুল ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি নরম বলে কাটতে এবং খোদাই কাজ করতে সুবিধা হয়।
 ভাদ্র/আশ্বিন মাসে শোলা কাটা হলেও ,অনেক জায়গায় দুর্গাপুজোর সময় দশমীর দিন থেকে নাকি শোলা কাটা শুরু করা হত- ” শোলা সাইত ” নামক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে।

শোলা গাছ জলে ভাসবে কিন্তু এর শিকড় থাকবে মাটিতে, তবেই গাছ জন্মাবে। 

খুকির সম্পত্তিতে যেমন নায়ে ভরা দিয়ে শোলার টিঁয়ে পাখি ছিল , আমারও মেয়েবেলায় তেমন শোলার টিঁয়ে, পুতুল আমার রান্নাবটির খেলার স্থান আলোকিত করত। বোশেখ , চৈত মাসে একখান শোলার টুপি মাথায় পড়ে গুলতি নিয়ে অন্যের বাড়ির গাছের আম শিকার ছিল শৈশব জীবনের এক অন্যতম অধ্যায়। তাছাড়া ছোট বেলায় পড়া জিম করবেটকে আমি অন্তত শোলার টুপি ছাড়া ভাবতেই পারি না। তাছাড়া সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা শোলার টুপিখানা কেমন করে যে কলোনিয়াল হয়ে গেল কে জানে ? সে জিনিস পড়তে এখন বড় লজ্জা করে লোকের , তবে বিদেশি ছাপ্পা মারা টুপির কদর কমে নি। কারণ , গেঁয়ো যোগি ভিখ্ পায় না। 

যা হোক, শোলা দিয়ে মালাকারগণ যে সব অনবদ্য সুন্দর সব বস্তু সৃষ্টি করেন তাদের কয়েকটির কথা পূর্ব পূর্ব পর্বে আলোচনা করেছি। শোলা গাছ ও মালাকার নিয়ে নানা পৌরানিক আলোচনা ও শোলা সংগ্রহ , শোলা শিল্পের নানা প্রয়োজনীয় যন্ত্রের কথা বলেছি। বলেছি শোলা শিল্পী বা মালাকার সমাজের নানা বিভাগের কথা। এই পর্বে আরো কিছু বলব – 
 শোলা শিল্পীদের হাতে অনবদ্য কিছু সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম হল #ঝারা । সত্যনারায়ণ ব্রতকথায় এই ঝারার উল্লেখ আছে এবং সত্য নারায়ণ পূজার সময় সেই ঝারা ব্যবহৃত হয়। গোল শোলার দণ্ড দিয়ে একটি ঘনকের কাঠামো তৈরি করা হয় । ঘনকের প্রতিটি কোন থেকে ধারী দিয়ে একটি করে শোলার তারাফুল বা কদম ফুল ঝোলানো হয় । যেখানে সত্যনারায়ণের পাঁচালি পড়া হয় সেখানে এই ঝারা ঝুলানো থাকে।

মৃন্ময়ী প্রতিমার হাতে এবং ঘটে চাঁদমালা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী সে কথা পূর্বেই বলেছি। অর্ধচন্দ্র , তারা, ছোট ও বড় বৃত্ত, প্রস্ফুটিত পূর্ণদল পদ্ম, কলকা, কদম্বফুল, শঙ্খ, হাঁস আর ময়ূরের মোটিফে বিচিত্র সমাহারে রচিত উপর থেকে নীচে লম্বমান চাঁদমালার দুধসাদা অঙ্গে নানা রঙের রাংতা বসানো হয়। কাগজের গোল কাঠামোর উপর শোলার বিভিন্ন টুকরো দিয়ে কারুকার্য করে এক একটি চাঁদমালা প্রস্তুত করা হয়। এই চাঁদগুলিকে সুতো দিয়ে জুড়ে  চাঁদমালা তৈরি করা হয়। চাঁদমালার প্রান্তভাগ দুটি শোলার কদমফুল ঝোলানো থাকে। চাঁদমালা সাধারণত তিন চাঁদ যুক্ত হয়।  কিন্তু ১.৫ চাঁদ ও ৫ টি চাঁদ যুক্ত চাঁদমালা মালাকারগণ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তৈরি করেন।  ১.৫ চাঁদমালার প্রয়োজন হয় শীতলা পূজার সময় এবং অনেক কালীপূজায় ৫ চাঁদ যুক্ত চাঁদমালা লাগে। 

শোলা দিয়ে বিবাহের যে টোপর ,মুকুট বা মোড় প্রস্তুত করা হয় সেকথাও পূর্বে বলেছি। টোপরের আকৃতি মন্দিরের চূড়ার ন্যায়। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বা ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের শিখরে যেমন আমলক শিলা থাকে, টোপরের উর্ধ্বভাগেও তেমনি আমলক শিলার অনুরূপ খাঁজকাটা গোল অংশ চোখে পড়ে।  টোপরের দুপ্রান্তে  দোলে একটি করে শোলার কদম ফুল। মুকুট বা পাতি মোড় বা সিঁথিমৌর একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম। বিবাহের মুকুটের আকৃতি , দেবপ্রতিমার শিরোভূষণের আদলে আজও রূপায়িত হয়। নক্সা করে কাটা শোলার পাতের উপর আলাদা করে নক্সা শোলার পাত জুড়ে তৈরি হয় সিঁথিমৌর। কখনো জালি কাটা কাজ করে অর্থাৎ নক্সাটুকু রেখে ফাঁকে ফাঁকে বাড়তি অংশ কেটে বাদ দিয়ে গড়ে ওঠে মুকুটের অনুপম আকৃতি। 

সাধারণতঃ মুকুটের মাথায় অনেকগুলি পাতার সমষ্টি যুক্ত যে অলঙ্কারটি থাকে , সম্ভবতঃ সেটি #কল্পবৃক্ষের প্রতীক। আবার কোনোটির চূড়ায় থাকে কলকা বা ময়ূর অথবা ত্রিপত্র।  মুকুটের অপরাপর অলঙ্কারণের মধ্যে আছে প্রজাপতি , মাছ, জোড়া ময়ূর, বা হাঁস , শঙ্খ, মন্ডনায়িত লতা, ফুল, পেঁচাল বৃত্ত এবং ফুলের পাপড়ি। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে শোলা শিল্পে সনাতন ভারতীয় মোটিফগুলি অবিকৃতভাবে স্থান পেয়েছে। প্রসঙ্গত , শোলার অলঙ্কার প্রস্তুত করতে তার, স্প্রিং, অভ্রের পাত , সোনালী ও রূপালী জড়ি , চুমকি, কাঁচ ইত্যাদির দরকার হয়। এসব জড়ি , চুমকি , কাঁচ সুরাট থেকে বঙ্গে আমদানি করা হয় । 
আগে রাংতার ব্যবহার হতো। সেগুলো ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে জার্মান থেকে আসত। সেই রাংতা ও শোলা একত্রে মিশিয়ে যে কাজ হতো, তাকেই ডাকের সাজ বলা হতো। সে কথা পূর্বেই বলেছি। 


বিবাহের সময় হস্ত বন্ধনের জন্য এখনো অনেকে ফুলের মালার বদলে শোলার মালা ব্যবহার করেন। এই মালাটি শোলার পাতলা ও লম্বা খন্ড দিয়ে তৈরি করা হয়। শোলার বাদামি অংশটি ছাড়িয়ে নেবার পর সাদা অংশটি থেকে লম্বা পাতলা টুকরো বের করা হয়। এই টুকরো গুলির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ১ ফুট হয়। স্থানীয় ভাষায় এই টুকরোগুলিকে গাঁথা হয় তখন ভাঁজ করে নেওয়া হয়। ফলে মালাটিও কুঞ্চিত হয়। মালার দৈর্ঘ্য ১ ফুটের মতো হয়। 


এইসব আলোচনার সূত্রে শোলার রাসমঞ্চের উল্লেখ অনিবার্য। এই রাসমঞ্চ রাস উৎসব উপলক্ষ্যে নির্মিত হয়। শোলার রাসমঞ্চের উপরে ফুল দিয়ে তৈরি জলের অন্তরালে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই জালের গায়ে শোলার তৈরি নানা পশু ও পাখী আটকানো থাকে। এই জালিকা মায়াময় জগতের প্রতীক। তাই এর নাম ইন্দ্রজাল বা মায়াজাল। যে বেদীর উপর যুগলমূর্তি স্থাপিত হয়, সেটিও নানারকম শোলার ফুল , পাতা , লতা , কলকা এবং বিভিন্ন পশু ও পাখীর আকৃতি , যেমন – হাতী, ঘোড়া, কুমীর , বাঁদর , টিয়া , কাকাতুয়া , হাঁস, ময়ূর এবং শোলার কদমফুল ও কদমগাছ দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে। কোনো কোনো রাসমঞ্চে থাকে শোলার তৈরি ফলন্ত কাঁদিশুদ্ধ কলাগাছ, তাতে একটি শোলার বাঁদর বসিয়ে দিতেও শিল্পী ভোলেন না। 


মৃন্ময়ী প্রতিমার আভরণ এবং আবরণ , এককথায় সাজ তৈরি হয় শোলা দিয়ে। একথা তো আমি পূর্বে বারংবার বলেছি।  প্রতিমার অলঙ্কারণে ডাকের ও শোলার সাজের প্রসিদ্ধি যেমন সবচেয়ে বেশি , তেমন খরচও বেশি। পুরো শোলার সাজ হয় দুধসাদা শোলা দিয়ে এবং তা আকর্ষণীয় করার জন্য তাকে ডাকেরসাজে পরিণত করা হয়। অর্থাৎ, সোনালী রূপালী জরি , চুমকি, রাংতা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ডাক বা রাংতার সাজে, প্রথমে শোলা কাগজের মতো পাতলা করে কেটে নিয়ে, তার উপরে চুমকি, জরি, কাঁচ, সুতো, অভ্রের পাত বসানো হয়। এই সাজের তলায় সার্টিন বা ভেলভেট কাপড় বা কাগজ লাগানো হয়।  এভাবে বড় কলকা, ছোট কলকা,  ঝালট , হীরাপিট ,মুকুট, কোমরকোষ শাড়ি, আঁচলা, সিঁথি , গলার হার, কানের হাতের এবং পায়ের নানা গহনা তৈরি হয়।  তবে যাবতীয় অলঙ্কারনের মধ্যে শোলার মুকুট এবং আঁচলা দুটি দেখতে সব থেকে সুন্দর এবং তৈরি করতে পরিশ্রমও হয় যথেষ্ট। প্রতিমার শোলার মুকুটে মকরমুখ এবং মাছ বিশেষ উল্লেখযোগ্য মোটিফ। এই সূত্রে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে খেলনা  আর গৃহ সজ্জার উপকরণ হিসাবে  শোলার টিয়ে , দাঁড়ে বসা কাকাতুয়া , মাছরাঙা, মাছ ইত্যাদি এক স্বতন্ত্র মূল্যের অধিকারী। 


খুব পাতলা করে কাটা কঞ্চির ফ্রেমের উপর শোলার পাত লাগিয়ে তার উপর ছবি এঁকে শোলার পাত লাগিয়ে তার উপর ছবি এঁকে শোলার পট তৈরি হয়। পটগুলি সাধারণত দেড় থেকে দু ফিট লম্বা এবং এক ফুট চওড়া। এগুলির আকৃতি নানা রকমের হয় – কোনটি ত্রিকোণ , কোনটি চালচিত্রের ন্যায় অর্ধবৃত্তাকার, আবার কোনো পটের মাথার দিক ক্রমশঃ সরু হয়ে শীর্ষ দেশটি ফুলের পাপড়ির মতো ছিলা কাটা। এই পটগুলিতে সচরাচর নানা পৌরানিক কাহিনী অথবা লোককথা অথবা লোকদেবতার একক আকৃতি আঁকা থাকে। আশুতোষ সংগ্রহশালায় শিব, সিংহবাহিনী দুর্গা, জোড়া হাঁসের পীঠে মনসা, ময়ূরচড়া কার্তিক ইত্যাদি প্রতিকৃতি মূলক পট বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 


উক্ত ছবির কোনোটিতে পটভূমির রঙ হলো স্বাভাবিক শোলার মতো, কোনটি ঘন নীল, কোনটি একসময়ে টুকটুকে লাল ছিল , বর্তমানে জ্বলে গিয়ে ফিকে গোলাপী হয়েছে। ছবির আকৃতিগুলি কালো রঙের জোরালো রেখার টানে আঁকা। ঐ রেখা বাঙ্গালার পট রেখার ন্যায়ই অভঙ্গুর এবং সুডৌল। দেবী প্রতিমার রঙ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে।  ভ্রমর কৃষ্ণ চুল, ভ্রূ এবং অক্ষিতারকা। অঙ্গাবরণ নীল , সবুজ অথবা লাল। বলা বাহুল্য আকৃতিগুলি সবই সামনে ফেরানো।


ক্রমশঃ
©দূর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. অনবদ্য শোলা শিল্প

২. শোলা শিল্প : ডঃ বাদল চন্দ্র সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.