তৃতীয় পর্ব
কাগজের থেকেও হাল্কা যে বস্তুটি -তালপাতা , কাপড় বা কাগজের পরিবর্তে চিত্ররচনার জমি হিসাবে সর্বতোভাবে উপযুক্ত , তাহল শ্বেত শুভ্র শোলা। বঙ্গের সনাতন শিল্পধারায় শোলার দুটি শিল্পরূপ চোখে পড়ে , একটি চিত্রিত এবং অপরটি মন্ডিত। কাপ নামে পরিচিত রিলের মতো গোটানো শোলা স্বচ্ছন্দে কাগজের মতো ব্যবহার করা যায়। শোলার ওপর রঙের কাজও হয় খুব ভালো , কারণ এতে রঙ ধরে ভালো। এই শোলা গাছ কাটা থেকে শোলার উপর কারুকাজ একটি পথ। সেই পথ অতিক্রম করতে গেলে শোলা শিল্পের জন্য বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি আবশ্যক :
১. শোলা কাটার ছুরি , একে কাথ বা হেতের বলে।
২. সান কাঠ
৩. কাঁচি
৪. জ্যামিরে ভাঙা কল বা কাগজ কুঞ্চিত করার যন্ত্র
৫. ছুঁচ
৬. সুতো বা কলার খোল থেকে তৈরি বেটে
৭. বাটালি , হাতুড়ি
৮. রঙ তুলি
৯. নানা রকমের কাগজ
১০. আঠা
১১. অন্যান্য সামগ্রী
পূর্বেই বলেছি যে শোলার দণ্ডটিকে যে ধারাল ছুরি দিয়ে কাটা হয় তাকে কাথ বা হেতের বলে। পাতলা ইস্পাতের দন্ড দিয়ে এই ছুরি নিৰ্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ১৫ -১৮ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৩ – ৪ সেন্টিমিটার। এই ছুরিটির ধারের উপর কাটা শোলার মসৃণতা নির্ভর করে। ছুরিটি অত্যন্ত ধারালো হলে শোলাকে বিভিন্ন ছাঁচে কাটা যায়। শোলা শিল্পীর দক্ষতার উপর ছুরির উপযুক্ত ব্যবহার নির্ভর করে।
শোলা কাটার ছুরিকে সর্বদা ধারালো রাখার জন্য যে কাঠের টুকরো ব্যবহার করা হয় তাকে ” সান কাঠ” বলে । ২.৫ – ৩ ফুট লম্বা ও ১- ২ ইঞ্চি চওড়া একটি কুল কাঠের টুকরোকে সান কাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই সান কাঠের উপর ঘুঁটের নরম ছাই দিয়ে ছুরিতে সান দিয়ে ধারালো করা হয়। ঘুঁটের ছাই নরম ও মসৃণ । তাই ছুরি সান দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
শোলার কাজে কাঁচির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাগজ , সুতো বা বাঁশের পাতলা হাতা প্রভৃতি কাটার জন্য কাঁচির দরকার। কামারাই এই কাঁচি তৈরি করেন। নপিতদের ব্যবহৃত কাঁচির থেকে এই কাঁচি কিছু বড় হয়।
রঙিন কাগজকে কুঞ্চিত করার জন্য মালাকারগণ একটি ছোট যন্ত্রের ব্যবহার করেন । এই যন্ত্রকেই জ্যামিরে ভাঙা কল বলে। দুটি ধাতব দণ্ডের মাঝখানে দুটি খাঁজযুক্ত ধাতুর গোলাকার দণ্ড পরস্পরের সঙ্গে জোড় বদ্ধভাবে লাগানো থাকে। আখ মাড়াই কলের মতো। একটি লিভার খাঁজযুক্ত দন্ডদুটির একটি যুক্ত থাকে। লিভারটি ঘোড়ালেই দুটো খাঁজযুক্ত দণ্ড ঘুরতে থাকে। ঘুরন্ত খাঁজযুক্ত দণ্ডটির মধ্যে কোনো রঙিন কাগজ দিলে সেটা কুঞ্চিত হয়ে যায়।
মালাকারগণ মালা গাঁথার জন্য যে সূঁচ ব্যবহার করেন সেগুলি সাধারণ সূঁচের তুলনায় একটু বড় হয়। কাঁথা সেলাই করার সময় যে রকম সূঁচ ব্যবহার করা হয় সেরকম। প্রায় ৩ ইঞ্চি লম্বা হয় , তবে মোটা নয়।
আগে কলা বা অন্য গাছের ছাল থেকে সুতো তৈরি করা হতো । এরকম সুতোকে বেটে বলা হয়। তবে এখন বাজার থেকে সুতো কিনে এনে ব্যবহার করা হয় ।
শোলার কাজের জন্য বাটালির প্রয়োজন হয়। তবে এই বাটালি সূত্রকরদের বাটালির মতো না হলেও চলে । চাঁদমালা বা মুকুটের জন্য যে কাগজের কাঠামোটার প্রয়োজন হয় সেই কাঠামোগুলি একত্রে অনেকগুলি কাটার জন্য বাটালি বা হাতুড়ির দরকার হয়।
মালাকাররা বাটালিকে কীভাবে ব্যবহার করে চাঁদমালার ছাঁচ তৈরির জন্য উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝানো যেতে পারে। চাঁদমালা নিৰ্মাণ করার জন্য যে গোল কাগজের কাঠামোর প্রয়োজন হয় সেই গোল অংশটিকে যখন একত্রে অনেকগুলি কাটতে হয় ,তখন কাঁচি বা ধারাল যন্ত্র দিয়ে সে কাজ করা যায় না। তাই বাটালিকে কাগজের উপর রেখে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকেঠুকে কাটতে হয় ।
মালাকারদের তৈরি ঝাড়া , ফুলঘর , রথঘর ইত্যাদিকে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করার জন্য রঙ তুলির ব্যবহার করা হয় । আগে ঘরোয়া উপায়ে এই তুলি তৈরি করা হতো। এখন অবশ্য বাজার থেকে কেনা তুলিই ব্যবহার করা হয়।
মালাকারগণ যে শোলার কাজ করেন , কাগজ দিয়ে তার কাঠামো তৈরি করা হয়। মুকুট, চাঁদমালা এবং শোলার অলঙ্কার নির্মাণের জন্য শক্ত কাগজ ব্যবহার করা হয় । এই শক্ত কাগজ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রঙিন কাগজ ব্যবহার করা হয়।
শোলার কাজের জন্য আঠা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শোলার টুকরোগুলিকে আঠা দিয়ে আটকানো হয়। মালাকার সমাজে শোলা জোড়া দেবার জন্য নিজেরাই আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি করেন। আটা বা ময়দাকে সামান্য তরল করে আগুনে ফুটিয়ে নেন। গোলা অবস্থায় তাতে একটু তুঁতে গুলে মিশিয়ে দিলে পোকায় কাটে না।
শোলার কাজকে সুন্দর রূপে ফুটিয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের চুমকি, কাঁচ , রাংতা , পুঁথি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় । অতীতে মালাকারগণ শোলা শিল্পে অনেক বেশি অভ্রের ব্যবহার করতেন । কিন্তু অভ্র তেমন সহজলভ্য না হওয়ায় বর্তমানে এর ব্যবহার অনেক কমে গেছে।
শোলার বুকে ছবি আঁকার পদ্ধতি বঙ্গ এবং অঙ্গ উভয় স্থানেই দেখা যায়। আসামের গোয়ালপাড়া , বঙ্গের উত্তরে তরাই অঞ্চলে , পূর্ববাংলার ঢাকা , ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লায় এধরনের কাজ ব্যাপক হারে হয়।
শোলার উপর চিত্র রচনা পশ্চিমবঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য চারুশিল্প, #মনসা_মেড় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। মনসা মেড় বা করন্ডি চিত্রিত শোলার সুন্দর নিদর্শন । বেহুলা – লক্ষ্মীন্দরের লৌহবাসর গৃহের সম্ভাব্য প্রতীক এই করন্ডি সর্পপূজার বিশেষ অঙ্গ। শোলার তৈরি ঘরের আকৃতি বিশিষ্ট করন্ডি দু ফুটের মতো উঁচু হয়। এর মাথার চাল হয় ত্রিকোনাকৃতি এবং ঢালু। করন্ডির একদিকের দেওয়ালে সর্পদেবী মনসা আর বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের প্রতিকৃতি আঁকা থাকে। পূর্বে সম্ভবত করন্ডির সর্বাঙ্গই চিত্রিত হতো। মনসা মেড় বা করন্ডির গাত্রে ছবির বিষয় একই থাকে ,কেবল অঞ্চল বিশেষে নক্সা এবং আঁকার ঢঙে কিছু পার্থক্য হয়।
প্রসঙ্গত কিছু বিষয় উল্লেখ করি , অনেকের মতে এই করন্ডি হল গুহামন্দিরের প্রতীক। কেউ কেউ একে শস্যাগারের প্রতীক বলেও মনে করেন। কারণ কৃষি প্রধান দেশ ভারতে মাড়াই এবং কোড়াই এই দুই ধরণের শস্যাগারের মধ্যে কোড়াইয়ের সঙ্গে করন্ডির আকৃতিগত সাদৃশ্য আছে। তবে মনসা ব সর্পপূজার সঙ্গে শোলা চিত্রণের এই নিবিড় সম্পর্ক প্রমাণ করে বঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে শোলা শিল্প খুবই প্রাচীন এবং ঐতিহ্যমন্ডিত। কারণ সর্পপূজার মধ্যে সুপ্রাচীন সনাতনী সমাজের এক প্রাচীন বিশ্বাস নিহিত আছে।
শোলার কতকগুলি পাতলা স্তর একটির উপর আরেকটি আঠা দিয়ে জুড়ে একটি পুরু স্তর তৈরি হয় , কাঁথা বা দেশী তাসের জমির মতো। শোলার স্তরগুলি জোড়ার জন্য তেঁতুলের আঠা বা ময়দার লেই ব্যবহার করা হয়। মনসার মেড় ও গোয়ালপাড়ার পিথের মতো চিত্রিত ও রঞ্জিত শোলার কাজ পরস্পর পুরু স্তরের উপরেই শোলার কাজ হয় ।
এছাড়াও এরম ধরনের আরো একটি বস্তু শোলা শিল্পীরা নিৰ্মাণ করে থাকেন , তাকে ফুলঘর বা রথঘর বলা হয়। আত্মা অবিনশ্বর। মৃত্যুর পরে সেই আত্মা নতুন এক জগতে প্রবেশ করেন।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণোন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥
সেই আত্মার আপন জগতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন হয় রথের। তাই সনাতনী বহু লৌকিক রীতিতে পুকুর নদী বা সমুদ্রে শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন হলে একটি শোলার ঘর ভাসিয়ে থাকেন । এই ঘরটিকেই বলা হয় রথঘর বা ফুলঘর। দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের মালাকারগণ যে ফুলঘর , রথঘর তৈরি করেন তার দুইটি অংশ থাকে।এই ঘর নির্মাণের জন্য প্রথমে বাঁশের বাতা দিয়ে একটি কাঠামো প্রস্তুত করা হয় । তারপর সেটিকে কাগজ বা পাতলা শোলা দিয়ে সুন্দর আকৃতি দেওয়া হয়। এই ঘরটিকে শোলার বান্ডিল বা কলাগাছের ভেলা দিয়ে নদী বা পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। লোক বিশ্বাস এই রথেই আত্মা এই ইহলোক ছেড়ে পরলোকে গমন করেন।
খেলনা পুতুল নির্মাণের জন্য প্রস্থ ও বেদযুক্ত শোলা খন্ডের প্রয়োজন হয়। শিল্পীর হাতে ধরা যন্ত্রের অল্পকটি অমোঘ আঘাতে সেই সব শোলার টুকরো থেকে পুতুল বা অপরাপর বস্তুর বাঞ্চিত আকৃতি বেরিয়ে আসে। বাংলার যাবতীয় সনাতন চারু ও কারুশিল্পের মতো শোলা শিল্পের ক্ষেত্রেও শিল্পীর দক্ষতা ও নৈপুণ্য ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় গড়ে উঠেছে।
ক্রমশঃ
©দূর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. অনবদ্য শোলা শিল্প
২. শোলা শিল্প : ডঃ বাদল চন্দ্র সাহা