শিবরাত্রি আসলে এক যৌগিক প্রক্রিয়া

 ”শিব” এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘মঙ্গলম্‌’। শিব অর্থে সন্তোষ, কল্যাণ এবং যা কিছু সুন্দর, জ্ঞানময়। শিবঠাকুরকে সব দেবতার আদি বা ‘আদিদেব’-ও বলা হয়। পুরানের ‘ত্রিদেব’ (প্রধান তিন দেবতা)’র অন্যতম মহাদেব শিব।
প্রাচীন মুনি ঋষিদের উপাস্য দেবতা শিব হওয়ায় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত শিবালয়ের ছড়াছড়ি সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, পশুপতিনাথ–এর মত গরিমাযুক্ত মন্দিরের কথা বাদ দিলেও রামেশ্বর, বানেশ্বর, জলেশ্বর, জল্পেশ্বর, চন্দনেশ্বর বা তারকেশ্বরই কম যান কিসে? দেওঘরের বৈদ্যনাথধামে চৈত্রমাসে ভক্তদের শ্রদ্ধাভক্তি, আনন্দউল্লাস আজও চোখে পড়ার মতো। অধ্যাত্মিক চেতনারই প্রকাশ নয় কী?

আজও এই আর্যাবর্তে (বর্তমান ভারতবর্ষে) মহাদেবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ যেন সনাতন ধর্মের বারোটি সুউচ্চ স্তম্ভ স্বরূপ।
সৌরাষ্ট্রে সোমনাথঞ্চ শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুনম্‌ ।
উজ্জয়িন্যাং মহাকালমোঙ্কারমমলেশ্বরম্‌ ।।
পরল্যাং বৈজনাথং চ ডাকিন্যাং ভীমশঙ্করম্‌ ।
সেতুবন্ধে তু রামেশাং নাগেশং দারুকাবনে ।।
বারাণস্যাং তু বিশ্বেশং ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে ।
হিমালয়ে তু কেদারং ঘুসৃনেশং শিবালয়ে ।।

ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর নিত্য দ্বন্দ্বের চিরবিনাশ করে মহাদেব শ্রেষ্টত্বের প্রমান রাখলেন সমগ্র ভারতে আদি অন্তঃহীন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ হিসাবে–পুরাণআদি আমাদের সে কথাই জানায়।

শিব কী বৈদিক দেবতা?
অনেক অধ্যাত্মিক সমালোচক শিবকে বৈদিক বা আর্যদের সেবিত দেবতার স্বীকৃতি দিতে চান না। কারন, তাঁর সহজ সরল কৃত্রিমতাহীন জীবনযাপন, সাজপোশাক ইত্যাদি আর্য সেবিত হিসাবে নাকি নেহাতই বেমানান। ব্যাঘ্রচর্মে নামমাত্র লজ্জা নিবারণ, নাগভূষণ, সর্বাঙ্গে চিতা ভষ্ম, তেল স্যাম্পু বিহীন জটাজাল। বৃদ্ধ ষাঁড় তাঁর বাহন। নন্দী, ভৃঙ্গী প্রধান সহকারী। সঙ্গী বলতে ভীষণ দর্শনা ভূত, পেত্নী, চেড়ি, চামুন্ডী। নির্জন শ্মশানই তাঁর আদর্শ বিচরণভূমি। এমন দেবতার উচ্চজাতে প্রবেশ, দক্ষরাজের যজ্ঞে প্রবেশ, এসব তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়!

কিন্তু, ঋগ্বেদেও যে তাঁর অবাধ প্রবেশ লক্ষনীয়! এই বেদে তিনি ‘রুদ্র’। ঋগ্বেদের ১০ম মন্ডলের ১০ম অনুবাকের ১২৫ নং সূক্ততে রয়েছেঃ
“ওঁ অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্‌
আদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ”। …………. অর্থাৎ আমি একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য ও সমগ্র বিশ্বের দেবতা হিসাবে (আত্মা হিসাবে) বিচরন করি।

ঋক্‌বেদের অন্তর্গত ‘মহামৃত্যুঞ্জয়’ মন্ত্রে এই শিবই ত্র্যম্বক (ওঁ ত্র্যম্বকম্‌ যজামহে সুগন্ধিম্‌ পুষ্টি বর্ধনম্‌….)। কোথাও বা তিনি বজ্রধারী – কপর্দী। যজুর্বেদে এসে সেই তিনিই হলেন নীলকন্ঠ।

উপনিষদে বিশেষতঃ ছান্দোগ্য উপনিষদে সর্বাঙ্গ হিরন্ময় যে সুপুরুষকে আদিত্য মন্ডলের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং সেই অবস্থায় ধ্যান করার নির্দেশ আছে তিনি মহাদেব শিব ছাড়া আর কেউ নন।

বেদে শিব/রুদ্র মঙ্গলময় ও কল্যাণকারী। (মহাকবি কালিদাস লিখছেনঃ “শিবাস্তে সন্তু পন্থানঃ” – আপনার যাত্রাপথ মঙ্গলময় হোক ।) বেদের শিব ‘আশুতোষ’ – যিনি অতি সহজেই সন্তুষ্ট হয়ে যান। বেদের শিব বনৌষধি’র জ্ঞাতা, নটরাজ মূর্তিতে হট্‌যোগের উদ্গাতা, সমগ্র সংগীত শাস্ত্রের শ্রষ্টা। পানিনীর ‘অষ্টাধ্যায়ী’–ও নাকি আসলে শিবের ডম্বরুর আঠারোটি বিশেষ প্রকারের বাজনা। আর আমাদের হরপার্বতী’র একান্ত কথোপকথনের মাধ্যমেই ভারতীয় আগম শাস্ত্র বা তন্ত্রের আগমন।

এমন মহাদেব আর্য দেবতা না অনার্য সেবিত দেবতা – এই বিষয়ে ঐক্যমতে আসা হয়ত কিছুটা কঠিন, তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, আদিদেব শিব স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতি। শিব পূজা মানেই প্রকৃতির উপাদান বা সৃষ্টি তত্বের পূজা। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এর শান্তি, স্বস্তি ও শ্রীবৃদ্ধি, কামনা – “ওঁ সর্বায় ক্ষিতিমূর্তয়ে নমঃ, ওঁ ভবায় জলমূর্তয়ে নমঃ, ওঁ রুদ্রায় অগ্নিমূর্তয়ে নমঃ” – এইসব বেদমন্ত্র আমার এই ধারনার বলিষ্ঠ প্রমাণ।

শিবরাত্রি ব্রতকথাঃ
অনার্য শিব আর্য হয়ে ঋগ্বেদে স্থান করে নিলেন। ঋগ্বেদ্‌ থেকে যজুর্বেদ্‌ হয়ে উপনিষদ্‌। উপনিষদ্‌ অতিক্রম করে পুরাণ। অন্তিমে পাঁচালি বা ব্রতকথাতে–যা আজও মায়েরা চতুর্থ প্রহর পূজার শেষে শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে, পরমনিষ্ঠার সাথে পাঠ করে নিজে শুনেন, শিবভক্তদের শোনান।

বারানসীর গভীর জঙ্গলে একব্যাধ বাস করতো। সারাদিন পশু শিকার করে দিনের শেষে সেই মাংস লোকালয়ে বিক্রি করে সে দিন যাপন করতো। একদিন প্রচুর মাংস সংগ্রহ করে ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিল। সেই অবকাশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ঘুম যখন ভাঙে তখন সূর্যদেব অস্তমিত। বাড়ি ফেরার কোনও সুযোগ নেই।
তখন সেই ব্যাধ বনের হিংস্র জানোয়ারদের ভয়ে অগত্যা ঐ গাছেরই মগডালে আশ্রয় নেয়। মাংসের পোঁটলার কাপড় ছিড়ে ডালের সাথে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে নেয়। অভুক্ত পেট, মনে ভয়, মাথায় শিশির–ঘুম আর আসে কী করে? থরথর করে কাঁপতে থাকে গোটা রাত্রি। আর এই কম্পনের ফলে মাঝে মধ্যেই একটি করে ফল আর পাতা অজানতেই পড়তে থাকে নীচে। ভাগ্যক্রমে নীচে মহাদেব শিব ছিলেন লিঙ্গরূপে। আর সেই গাছটি ছিল বেলগাছ। মহাদেব শিব এতেই অতি প্রসন্ন হয়ে গেলেন তৎকালীন অছ্যুৎ, অপাঙ্‌ক্তেয় এই ব্যাধের উপর। তাই তো তিনি ‘আশুতোষ’! সারাজীবন মন্দিরে না গিয়েও মৃত্যুর পরে নিকৃষ্ট ব্যাধের শিবলোক প্রাপ্তি হোল।

শিবরাত্রির যৌগিক ব্যাখ্যাঃ এমন এক পবিত্র দিন যেদিন নির্জলা উপবাস থেকে কঠোর সাধনার অবসানে হর – পার্বতীর মিলন হয়েছিল ।
পুরানে রয়েছে – “ফাল্গুনে কৃষ্ণপক্ষস্য যা তিথিঃ স্যাচ্চতুর্দ্দশী।
তস্যাং যা তামসী রাত্রিঃ সোচ্যতে শিবরাত্রিকা”।।
বাংলা ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের যে চতুর্দ্দশী তিথি হয় তার রাত্রিই শিবরাত্রি হিসাবে নির্দিষ্ট।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, উজ্জ্বল দিবালোক ছেড়ে ঘোর কৃষ্ণা চতুর্দ্দশীতে শিবস্ততির আয়োজন কেন? কেনই বা চারপ্রহরে আলাদা উপাচারে “বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্‌”–এর পূজন বন্দন?
আসলে, এই বিধানের সাথে যোগমার্গের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পান কোনো কোনো আধ্যাত্মিক তত্ত্ববেত্তা।
এখানে, তমসাচ্ছন্ন রাত্রি অজ্ঞানতারূপ অন্ধকারের প্রতীক।উপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলেনঃ ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’। হে মহাদেব! হে ঈশ্বর ! আপনি আমাদের মন থেকে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে জ্যোতি’র পথে প্রেরন করুন। শিবসূত্রে আছেঃ জ্ঞানম্‌ জাগ্রতঃ। জাগৃতি বলতে জ্ঞানই। ঋগ্বেদে ‘রাত্রিসূক্ত’ নির্দিষ্ট আছে। ওখানে রাত্রিকে এবং ঊষাকে দেবত্ব প্রদান করা হয়েছে–বিশেষ বিশেষ মন্ত্রে।
আর এ কথাও ঠিক নানান কোলাহল, যান্ত্রিক শব্দের মাঝে চঞ্চল চিত্তে ‘মঙ্গলম্‌’ শিব এসে বসবেনই বা কোথায়– সেজন্যই হয়ত রাত্রির নিদান।

সাংখ্য যোগে রয়েছেঃ
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।
মূঢ়তা এবং অজ্ঞানতার অন্ধকারে সাধারন জীব যখন ঘুমন্ত/আচ্ছন্ন থাকে, যোগশ্রষ্টা মঙ্গলমূর্তি শিবের তখনই আগমন। আর কিসে আগমন? এই নন্দী ভৃঙ্গীতে চড়ে। এই নন্দী ভৃঙ্গী আসলে ‘ইড়া’ এবং ‘পিঙ্গল’–এই দুই নাড়ি।এদের অবস্থান মূলাধার চক্র। এরাই পার্থিব সব কামনা বাসনা ভোগ ও চিত্তচাঞ্চল্যের আঁতুড় ঘর। কঠোর যোগাভ্যাসের মাধ্যমে জীব (প্রকৃতি বা পার্বতী), ‘চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’ করে যখন যোগ ধ্যান ও চিন্তন এবং স্মরণের মাধ্যমে এই ইড়া পিঙ্গ্‌লার উপর প্রভুত্ব দেখিয়ে সুষুম্না মধ্যস্থ ষড় চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রারে পৌছয় তখনই বাস্তব হর-পার্বতীর মিলন হয়। জীবের শিবপ্রাপ্তি ঘটে। শিবপ্রাপ্তি মানে আত্মজ্ঞান লাভ। পার্বতীর আসল স্থিতিকে বিসর্জন দিয়ে শুধু নির্জলা উপবাসটুকুকেই যদি আমরা শিবরাত্রির একমাত্র উদ্দেশ্য ভাবি তবে কলির জীব যে তিমিরে ছিল তাকে সেই তিমিরেই আরও কতশত বছর থাকতে হবে তা মহাদেব শিবই জানেন। ওঁ নমঃ শিবায়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.