সাভারকার চির অম্লান, চির প্রণম্য হোমাগ্নি

দিনটি ছিল ১০ই মে; সাল ১৯৩৭, সুদীর্ঘ ২৮ বছরের রাজরোষ সহ্য করে, আন্দামান, আলিপুর, ইয়েরাওয়াদা, রত্নগিরি প্রভৃতি ব্রিটিশ কারাগাররের সাথে তাঁর অতীব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সাঙ্গ করে অবশেষে মুক্তি পেলেন এক ব্যক্তি – বিনায়ক দামোদর সাভারকার। কোনমতেই সাধারণ নয় দিনটি – ১০ই মে, ১৮৫৭ সালে প্রারম্ভ হয়েছিল ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ আর তার ৮০ বছর পূর্তিতেই বহু কাঙ্খিত মুক্তি পেলেন তিনি। অবশ্য লোকচক্ষুর আড়ালে জেলে থাকতেও যে তিনি চর্চা থেকে হারিয়ে যাননি তার প্রমাণ রয়েছে অজস্র। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে তিনি নতজানু হয় Royal Clemency প্রাথনা করেছিলেন – বর্তমানে এই রোমাঞ্চকর চিন্তাপ্রবাহের জন্মদাতা নব্য কম্যুনিস্টরা (সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামে অংশগ্রহণের পরিবর্তে প্রতিনিয়ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুখ ভোগ করা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ) হয়তো বিস্মৃত থাকেন সর্বদা (মোহমুক্ত হয়ে বিদ্যাচর্চার অভাবেই সম্ভবত) যে অতীতের কিংবদন্তী কংগ্রেসী, বামপন্থী নেতৃবৃন্দ ছিলেন তাঁর অনুরাগী।

তাঁর মুক্তিতে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং মানবেন্দ্রনাথ রায়, এই প্রসঙ্গে বিদগ্ধ চিত্র পরিচালক JBH Wadia তাঁর অধুনা বিস্মৃত memoirs “Those were the Days” এ লিখছেন, “Roy was staying at the Wadia residence in what was then Bombay. One morning, in 1938, his hosts were taken aback to see Roy come to the breakfast table in a spotless white dhoti-kurta worn in the Bengali style. He usually preferred to wear suits or a bush shirt and trousers. Noticing the puzzled look he received that morning, Roy explained to Wadia: “I am going to pay my respects to Veer Savarkar and I thought I should do it in the fittest manner possible. I am sure the old man will be pleased to see me dressed as a full-fledged Indian rather than as Westernized revolutionary.” Wadia adds: “I have a sneaking suspicion that when Roy was in Veer Savarkar’s presence he must have touched his feet in the traditional Indian way.”

এইবার চিরাচরিত ও চির বিতর্কিত clemency উপর দৃষ্টিপাত করা যাক।

সাভারকারের যে royal clemency প্রয়োজন তার প্রথম উপলব্ধি যিনি সর্বপ্রথম করেছিলেন তিনি হলেন শ্রী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে মহাত্মা গান্ধী। তাঁর নিজের লেখায় যা আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেন – “Thanks to the action of the Government of India and the Provincial Governments, many of those who were undergoing imprisonment at the time have received the benefit of the Royal clemency. But there are some notable ‘political offenders’ who have not yet been discharged. Among these I count the Savarkar brothers. They are political offenders in the same sense as men, for instance, who have been discharged in the Punjab. And yet these two brothers have not received their liberty although five months have gone by after the publication of the Proclamation,” – “Savarkar Brothers” in Young India dated 26-5-1920 (Complete Works of Mahatma Gandhi Vol 20; Page 368).

১৯৬৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত হন সাভারকার, ৮২ বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যুর দুদিন পরে লোকসভায় একটি resolution উত্থাপিত হয় স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংগ্রামে অসামান্য ভূমিকা পালনের জন্য – সৌজন্যে ডঃ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়; সাংসদ – সিপিআই। এই প্রসঙ্গে যে সমর্থনটি লাভ করেন হীরেনবাবু তা হল শ্রী শ্রীপাদ অমৃত ডেঞ্জার, চেয়ারম্যান – সিপিআই। কমঃ ডাঙ্গে অভিহিত করেন শ্রী সাভারকারকে “one of the greatest revolutionaries in the anti-imperialist struggle’..তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী অভিহিত করেন সাভারকারকে “byword for patriotism and courage” রূপে ও তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে সাভারকারের প্রতি একটি commemorative stamp issue করে কেন্দ্রীয় সরকার।

১৯৮০ সালে পন্ডিত বাখলে (সম্পাদক – স্বাত্যন্ত্র বীর সাভারকার রাষ্ট্রীয় স্মারক) শ্রীমতী গান্ধীকে সাভারকর জন্মশতবার্ষিকী সম্পর্কে অবহিত করলে প্রধানমন্ত্রী উত্তর দেন, “I have received your letter of May 8, 1980. Veer Savarkar’s daring defiance of the British Government has its own importance in the annals of our freedom movement. I wish success to the plans to celebrate the birth centenary of the remarkable son of India.” (No. 836-PMO/80). এবং সর্বোপরি শ্রীমতী গান্ধী তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১১, ০০০ টাকা সাভারকার ট্রাস্টের তহবিলে দান করেন ও ফিল্মস ডিভিশনকে নির্দেশ দেন তাঁর সমগ্র জীবনের উপর একটি documentary নির্মাণ করতে যা তিনি নিজ দায়িত্বে উদ্বোধন করেন ১৯৮৩ সালে।

প্রসঙ্গ হিন্দু মহাসভা –

অবশেষে মুক্তির পরে সাভারকারকে আপন রাজনৈতিক সংগঠনের এক অপরিহার্য অংশ করতে আগ্রহী ছিল অনেকেই কিন্তু তাঁর যাবতীয় আকর্ষণ ও শ্রম নিয়োজিত হল তখনকার অপেক্ষাকৃত প্রায় নির্জীব হিন্দু মহাসভা। চির প্রণম্য বিপ্লবী ও আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ শস্ত্রাচার্য শ্রী পুলিন বিহারী দাসের গ্রন্থ “আমার জীবন তে দেখা যায় – “হিন্দু ধর্মের প্রতি সভরকারের বিশেষ কোন মোহ ছিল বলিয়া মনে হইত না, কিন্তু হিন্দুর কৃষ্টি ও হিন্দু জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করিবার সংকল্পই তাহার মনে অতি প্রবল ছিল।” প্রশ্ন ওঠে – তাঁর লক্ষ্য কি? হিন্দু ধর্ম না হিন্দু রাষ্ট্র? এক পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের আবরণে ধর্মের এক নব সংজ্ঞা যা যুগধর্ম রূপে অভিহিত হবে আগামী ইতিহাসের প্রত্যেক প্রচ্ছদে?

এইজন্যই কি তিনি ব্যক্তি হিন্দুর সংজ্ঞা রচনা করলেন সর্বপ্রথম?

“আসিন্ধু সিন্ধু পর্যন্তা যস্য ভারতভূমিকা। পিতৃভূ পুন্যভূশ্চৈব স বৈ হিন্দুরিতি স্মৃতঃ”।।
অর্থাৎ তিনিই হিন্দু যিনি সিন্ধু নদ ও সমুদ্রের মাঝখানের ভূমিকে নিজের পিতৃভূমি বলে মনে করেন এবং যা তার কাছে এক পবিত্র ভূমিও বটে।

হিন্দু কি তাহলে একটি ভূ-রাজনৈতিক চিন্তা যার বিস্তার কার্যত অসম্ভব? এর মাধ্যমে কি হিন্দুর গৃহস্থাশ্রমের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মানচিত্র সম্প্রসারণের একটি সীমারেখা টানা হচ্ছে? তাহলে কি প্রাচীন ভারতের আর্য হিন্দু সাম্রাজ্যবাদিতা এযুগে অসম্ভব? নাকি এই সংজ্ঞার মাধ্যমে হিন্দুর রাজনৈতিক-সামরি ক উচ্চাকাঙ্ক্ষার চূড়া স্পষ্ট হয়ে উঠবে ক্রমশ? ধ্যেয়বস্তু নির্দিষ্ট হবে ও সেই অমোঘ লক্ষ্যকে ভেদ করার প্রতি মার্গ স্বয়ং প্রশস্ত হয়ে উঠবে?

নানাবিধ চিন্তা ভিড় করে; চিন্তার দ্বন্দ্ব ও তার সমাধানই প্রগতির লক্ষণ।

এ প্রসঙ্গে অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য তাঁর আদ্যন্ত সহযোগী বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার অন্যতম স্তম্ভ রূপে পরিচিত শ্রী যতীন্দ্রমোহন দত্তের বক্তব্য। শ্রী দত্ত মহাশয় এক অত্যন্ত প্রসিদ্ধ পরিসংখ্যানবিদ, ১৯৩৯ সালে Oxford University Press, Royal Economic Society র “The Economic Journal” এ প্রকাশিত ও বিখ্যাত ঐসলামিক জাকাত সম্পর্কিত প্রবন্ধের রচয়িতা। যতীন্দ্রমোহনবাবু দ্বারা পরিবেশিত ও তৎকালীন অন্যান্য প্রকাশিত ও প্রমাণিত নিবন্ধ অনুযায়ী, জেলে বাসকালীন ও মুক্তির পরেই সাভারকরের কাছে পরিষ্কার হয়েছিল এক নিষ্ঠুর সত্য – গান্ধী দ্বারা পরিচালিত ও পরিবেশিত প্রত্যেকটি আন্দোলন হিন্দুর সর্বনাশের মাধ্যমেই শেষ হয়। ঐসলামিক মৌলবাদীদের প্রত্যেকটি অন্যায় দাবি মেনে নেওয়াই তার একমাত্র কর্তব্য ও ধর্মীয় ভারসাম্য রক্ষা করার সর্ব দায় একমাত্র হিন্দুর (যে syndrome থেকে মুক্তি পাওয়া যায়নি আজও) হিন্দু তার আপন ‘হিন্দু’ পরিচয় দিতে কুন্ঠিত ও ঐসলামিক মৌলবাদের গনগনে প্রশ্রয়ে পাকিস্তান গঠন এক সার্বিক সত্য। যে স্বাধীনতা পাওয়ার একমাত্র শর্ত পাকিস্তানকে মেনে নেওয়া তা কি হিন্দুর রাষ্ট্রীয়, ধার্মিক ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে সামর্থ্য হবে? যেটুকু বাকি ছিল তাও শেষ হল যখন ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে হিন্দুরা সমগ্র, অবিভক্ত ভারতের ১২ আনা হওয়া সত্ত্বেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদে সংক্যালঘিষ্ঠ – গান্ধী কর্তৃক blank cheque দেওয়ার ফলে।

অতএব, “বারাণসীর বিশ্বনাথের মন্দিরে সন্ধ্যারতি দরজা বন্ধ করিয়া করিতে হইবে; কেন না ববম্ বম্ শব্দে ও ডমরুর তালে মুসলমানের নামাজের ব্যাঘাত হইবে। নগর-সংকীর্তন করিতে হইলে থামিয়া থামিয়া করিতে হইবে – অষ্টপ্রহর কীর্তন হইবে না। “হিন্দুস্থানী” রাষ্ট্রভাষা হইবে, আর তাহা ঊর্দু-বহুল হইবে। আমার পুত্র পৌত্র রামায়ণ পড়িবে – ‘জনাব রামচন্দ্রজিকা সাথে বেগম সীতাকো সাদি হুঁয়ে থী।’ বাংলায় – ‘রামের বনবাসে দশরথ এন্তেকাল করিলেন’; পাখিরা আর রাত পোহাইলে কলরব করিবে না – ‘পাখি সব করে রব ফজর হইল।'” যদি একমাত্র ভবিতব্য হয় তো তাকে ললাটের লিখন বা দৈবের অভিশাপ সাব্যস্ত না করে পুরুষাকারের তেজ দিয়েই নিজ ভাগ্য রচনা করতে হবে হিন্দুকে।

এবং হিন্দুত্বের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে পথ পরিবর্তনের প্রয়োজন – মহাসভা আর হিন্দু ধর্মসভার নামান্তর না হয়ে জীবন্ত রাষ্ট্রসভায় পরিণত করতে হবে – সাভারকার বর্ণিত এই নির্দিষ্ট ধ্যায়বস্তুই ইতিহাসের এক নব যুগের সূচনা করল এবং তার কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই বঙ্গভূমি। ১৯৩৯র ফেব্রুয়ারি মাসে খুলনায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে সাভারকরের বজ্রনির্ঘোষে আহ্বান রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে হিন্দুকে সহসা এক স্বাধীন, আপন স্বার্থবাহী এক চিন্তাধারার দ্যোতক রূপে জন্ম দিল। ক্রমান্বয়ে হিন্দু হিতার্থে, শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃত্বের, সশস্ত্র বিপ্লবীদের, বরেণ্য অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের শ্রেষ্ঠ অভিগমন রূপে চিহ্নিত হল হিন্দু মহাসভা।

কেমন ছিল হিন্দু মহাসভার সংগ্রাম বঙ্গে? প্রত্যেক অর্থেই ভয়ঙ্কর ও রক্তাক্ষয়ী; এর একটিই কারণ কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ভ্রান্তিতে গঠিত হল যে প্রজা কৃষক পার্টি – মুসলিম লীগ সরকার ১৯৩৭ সালে তা ব্যক্তি হিন্দুর অন্দরমহল, মন্দির, ঠাকুরঘরের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন করে তুলল: ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন দিবসে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আবির্ভাব যাতে এক সাময়িক বিরতি টানে। এবং অবশ্যই রাজনৈতিক চক্রান্ত ও চূড়ান্ত নিষ্পেষণে হিন্দু মহাসভার ক্রমাগত রক্তক্ষরণ ও পতন পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুর পতন ঘটায়। একথা বলা যায়, নির্দ্বিধায় বাঙ্গালী হিন্দুর পুনর্জাগরণ ঘটবে এই পথ ধরেই – হিন্দুর রাজনীতিকরণ ও সামরিকীকরণ; politicization, confrontation, regimentation – এর মাধ্যমে। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৮-এর ৩০শে জানুয়ারী পর্যন্ত বঙ্গের রাজনীতিতে, বাঙ্গালী হিন্দু তথা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের স্বার্থ রক্ষার্থে ও প্রসারে হিন্দু মহাসভার সাফল্যের এক আলোকবর্ষের মধ্যে আত্মনিবেদন ও সক্রিয়তার মাধ্যমে আসতে পৰ দ্বিতীয় কোন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দেখা পাওয়া যায়নি এই মুহূর্ত পর্যন্ত।

Hinduize Politics, Militarize Hindudom – রাজনীতির হিন্দুকরণ, হিন্দুর সামরিকীকরণের ন্যায় দ্বিতীয় কোন সূত্র উঠে আসেনি এখনও পর্যন্ত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে। হিন্দুর একান্ত কর্তব্য এই বিশেষ ধারাটি বিকশিত করার তার আগামীর স্বার্থে, পৃথিবীব্যাপী হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার জন্যে।

সাভারকার চির অম্লান, চির প্রণম্য হোমাগ্নি।

বন্দেমাতরম।

শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলাযনম্৷
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্৷৷

(চিত্র: হিন্দু মহাসভার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আলোচনারত তাতিয়া রাও – সাভারকার)
সৌজন্যে: Bengal Volunteers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.