মিথোম্যানিয়া কী? মিথোম্যানিয়া হচ্ছে দেশীয় পুরাণের প্রতি সদর্থক আসক্তি। এই আসক্তি দ্বিবিধ — প্রথম, সরাসরি পুরাণের ব্যবহার; দ্বিতীয়, মনের মধ্যে পুরাণের যে প্রাসঙ্গিকতা রয়ে যায়, বারে বারে তারই পটভূমিতে সাহিত্যের জগতে মানস-প্রতিমা নির্মাণ। রবীন্দ্রনাথে দু’ধরনের আসক্তিই ছিল। আর ছিল বলেই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, শিশুপাঠ্যে শিশুকে সবসময় তার ঐতিহ্যের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে দিতে হবে। ঐতিহ্যের শিক্ষার মধ্যেই সবচাইতে ভালোভাবে শিক্ষিত করা সম্ভব। শিশুকে যথোপযুক্ত নাগরিক হয়ে উঠতে সহায়তা করে দেশ ও ঐতিহ্য। ঐতিহ্যের প্রতি প্রাণের টান, ঐতিহ্য-বিষয়ক জ্ঞান একেবারে ছোটোবেলা থেকেই আসা দরকার। রবীন্দ্র মানসে রামায়ণ যেভাবে ঢুকে আছে, সহজপাঠে, শিশু কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে; একইভাবে ঢুকে আছে রামায়ণ যাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না কখনও। ‘রাম’ বলতেই ভারতীয় শিশুর কাছে এক অমোচ্য চিত্র ফুটে ওঠে, এই মিথোম্যানিয়ার জন্যই কি সহজপাঠ বইটি আজ অনেকের কাছে ব্রাত্য?
শিশু কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ দু’ভাবে শিশুকে রামায়ণের সঙ্গে সংপৃক্ত করে দিচ্ছেন, নাম-বাচক শব্দে এবং প্রকৃতি চিত্রণে। কখনো নাম না বলেই শিশু রামায়ণে পাড়ি দিয়েছে — “মা গো, আমায় দেনা কেন/একটি ছোটো ভাই –/দুইজনেতে মিলে আমরা/বনে চলে যাই।” এখানে নাম না করেও শিশু নিজের সঙ্গে শ্রীরামকে অভেদ কল্পনা করছে, ছোটো ভাইটি যে সহোদর লক্ষ্মণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতি চিত্রণেও রামের বনবাস জীবন শিশুর কল্পনার নাগালে মুহুর্তেই চলে আসে — “চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই/এমনি বরষাতে…”। রাজপুত্রের বনবাসী হয়ে যাওয়া বাঙ্গালি তথা ভারতীয় শিশুর মানস-কল্পনায় কতটা প্রভাব এনেছিল, ‘সহজপাঠ’-এর একটি কবিতায় কবি তা এক লহমায় ধরে দিয়েছেন — “ঐখানে মা পুকুরপাড়ে /জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে/হোথায় হব বনবাসী –/কেউ কোত্থাও নেই।/ঐখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধবো তোমার ছোট্ট কুঁড়ে,/শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে/থাকব দুজনেই।” কি বলবেন একে, মিথোম্যানিয়া নয়? রামায়ণ-ম্যানিয়া নয়! পারবেন তো এই শিকড়কে কেটে দিতে! আমার কিন্তু একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। আপনার?
কল্যাণ চক্রবর্তী।