আজ আপনাদের এমন একজন ভারতীয় রাজার গল্প বলব, দেশের জন্য তথা দেশের প্রতি যার অবদান ছিল অনস্বীকার্য, কিন্তু সেইসব কিছুই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কালের নিয়মে আর কিছুটা অবশ্যই মানুষের বিস্মৃত স্বভাবের জন্য। ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ধর্মের প্রতি তাঁর অবদান আজও রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে, চেনা গন্ডীর ওপারে।
হ্যাঁ, আমরা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের কথা বলছি। তিনি ছিলেন রাজা বৃহদ্রথের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ এবং বৈদিক আচার, পদ্ধতির প্রতি অগাধ বিশ্বাসের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন সুপরিচিত।
তিনিই প্রথম রাজা বৃহদ্রথের শাসনকার্য পরিচালনার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে রাজার শাসনপদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত নয়। ধীরে ধীরে পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হয়ে ওঠেন এক পরিচিত মুখ। রাজা বৃহদ্রথ ছিলেন বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। এই ধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অপরিসীম এবং সর্বজনবিদিত। কথিত আছে রাজা বৃহদ্রথের অপরিণত শাসনপদ্ধতি এবং বিশেষ ধর্মের প্রতি তাঁর এই তোষণ নীতি রাজ্য পরিচালনার পথে অন্তরায় হয়ে ওঠেছিল। তাঁর নিষ্ক্রিয়তার ফলে বেশ কয়েকটি প্রদেশ মগধের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাঁর সাম্রাজ্যকে অনেকগুলি বিদেশী শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। এইসমস্ত সামরিক অভিযান যে তাঁর নিজের জন্য এবং রাজ্যের জন্য সুখকর ছিল না তা বলাইবাহুল্য।
এখানে একটি লক্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল যে রাজা চন্দ্রগুপ্ত এবং অন্যান্য রাজারাও ম্যাসেডোনিয়ানদের মতো অনেক প্রতিপক্ষ এবং বিদেশী আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন বা কখনো পরাজিত হয়েছেন কিন্তু গুপ্ত রাজাদের ভয়ে বহু দশক ধরে কেউ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করার সাহস পায়নি।
ম্যাসাডোনিয়ানরা মগধ সহ ভারতের আরও অন্যান্য রাজ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে এবং এই কাজে তারা আরও কয়েকজন ইন্দো-গ্রীক রাজার সমর্থন পেয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হ’ল যে তাঁরা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। প্রাথমিক ভাবে এই সামরিক আঘাত হানার পিছনে দায়ী ছিল মগধরাজ বৃহদ্রথের নরম মনোভাব। তিনি এইসমস্ত বিদেশী আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ধরণের প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি।
রাজা বৃহদ্রথের অলস মনোভাব পুষ্যমিত্র শুঙ্গকে অত্যন্ত হতাশ করেছিল এবং বৈদিক সংস্কৃতি, শিক্ষা বাদ দিয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব তাঁকে বিস্মিত করেছিল।
বিদেশী আক্রমনের খবর পাওয়ার পরেও বৃহদ্রহ ছিলেন চরম উদাসীন এবং আসন্ন গ্ৰীক আক্রমনকারীদের হাত থেকে নিজের সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও তিনি করেননি।
বৃহদ্রহের এই কর্মবিমুখ মনোভাব এবং ঔদাসীন্য তাঁর প্রতি তৈরী হওয়া বিদ্বেষের প্রধান কারণ ছিল। শুধুমাত্র পুষ্যমিত্র নয় বরং পুরো সেনাবাহিনীর কাছেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন অকর্মণ্য রাজা। ধীরে ধীরে পুষ্যমিত্র রাজ আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন। একবার তিনি বৌদ্ধদের আক্রমণ করে সেখান থেকে ৩০০জন গ্রীককে বন্দী বানিয়ে তাদের প্রত্যেকের শিরশ্ছেদ করেছিলেন এবং বৌদ্ধদের বৃহদ্রথের সামনে এনে উপস্থিত করেন। এই ঘটনার পর পুষ্যমিত্রকে ভৎসনা করে রাজদরবার থেকে বহিষ্কার এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পুষ্যমিত্র এবং বৃহদ্রহের মধ্যে এরপর তীব্র বাদানুবাদ সৃষ্টি হলে ক্রুদ্ধ পুষ্যমিত্র বৃহদ্রহকে হত্যা করেন।
বৃহদ্রহের মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর সমর্থনে পুষ্যমিত্র হয়ে ওঠেন স্বঘোষিত রাজা এবং প্রতিষ্ঠা করেন শক্তিশালী শুঙ্গ রাজ্য। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই পুষ্যমিত্র তাঁর সাম্রাজ্যকে বড় করার উদ্দেশ্যে বৈদিক আচার, রীতিনীতি মেনে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন এবং এইভাবে তিনি মগধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অনেকগুলি স্বাধীন রাজ্যেকে নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পুষ্যমিত্র সাঁচী, উজ্জয়িনী, শিয়ালকোট এবং মথুরা সহ সেই সময়ের বেশ কয়েকটি বড় বড় সাম্রাজ্যকে নিজের শাসনের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন। কথিত আছে যে ম্যাসেডোনিয়ার রাজা মিলিন্দ পাটলিপুত্র আক্রমন করেছিলেন এবং এই সামরিক অভিযানে তিনি মারা যান। অনুমান করা হয় যে, মিলিন্দ হয়তো পাটলিপুত্র আক্রমণ করেছিলেন এবং তারপর শুঙ্গদের কাছে পরাজিত ও নিহত হন কিংবা হয়তো তিনি শাকল আক্রমণ করেছিলেন এবং জয়লাভ করার পর সেখানে মিলিন্দকে হত্যা করেছিলেন। শুঙ্গের বংশধররা কিছুকাল সেখানে রাজত্ব করায় মিলিন্দ নিশ্চিতভাবেই মগধ জয় করতে পারেন নি। যাই হোক না কেন, এটা পুরোপুরি স্পষ্ট যে পুষ্যমিত্রের রাজত্বকালে ম্যাসেডোনিয়ানদের সাথে এক বা একাধিক লড়াই সংঘটিত হয়েছিল।
পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কলিঙ্গ ও সাতবাহন রাজ্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের পরাজিত করেছিলেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের জন্যই শুঙ্গরা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মগধ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার কাজে সফল হয়েছিলেন।
পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কি খারাপ মানুষ ছিলেন?
ঠিক এখানেই পুষ্যমিত্র শুঙ্গর বিরুদ্ধে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতেই পারে কারণ কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থে তাঁকে একজন খলনায়ক হিসাবেই বর্ননা করা হয়েছে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে যে বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রবল ঘৃণা এবং অসন্তোষের কারণে তিনি বহু বৌদ্ধস্তূপ এবং মঠ ধ্বংস করেছিলেন। যদিও, বেশকিছু স্বাধীন উৎস এবং কয়েকটি বৌদ্ধ উৎস থেকে জানা যায় যে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল ছিলেন।
তিনি বৈদিক জীবনধারা ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্য পরিচিত ছিলেন। যদিও বৈদিক সংস্কৃতিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল তার অনেক আগের থেকেই। আমাদের পাঠকের উল্লেখিত কিছু মতানুসারে জানা যায় যে সেইসময় “সামন্ত” প্রথার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল এবং তার পাশাপাশি জাতিভেদ প্রথাও প্রবল আকার ধারণ করেছিল। এরফলে সমাজে শূদ্ররা বর্ণ বৈষম্যের শিকার হতে থাকে।
বৈদিক সংস্কৃতির আশ্রয়স্থল ছিলেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ।
আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত জনশ্রুতি এবং কিছু অর্ধ-সত্য ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। কিন্তু এর বাইরেও একটা সত্যি রয়েছে, যা থেকে জানা যায় যে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে শুঙ্গ সাম্রাজ্যের এক বিরাট অবদান রয়েছে। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সংক্রান্ত নিয়মের বিখ্যাত সংকলন (পানিনি রচনা করেছিলেন) এই সময়কালে পতঞ্জলি নামক একজন আচার্য সম্পন্ন করেছিলেন এবং এই ভাষ্যটির নাম ছিল “মহাভাষ্য”।
আমাদের কাছে সেই যুগের অনেক দলিল রয়েছে। এই সময়কালের মধ্যেই রচিত হয় কালিদাসের বিখ্যাত নাটক “মালবিকাগ্নিমিত্রম্”, যার প্রধান চরিত্র অগ্নিমিত্র ছিলেন পুষ্যমিত্রের পুত্র।
পুষ্যমিত্রের শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের জায়গায় ব্রাহ্মণ্যবাদের ব্যাপকভাবে পুনর্জাগরণ ঘটেছিল। বলা হয় যে তাঁর শাসনকালে সবথেকে বেশি সনাতন ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল এবং সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। এইসময় যুদ্ধের দেবতা হিসাবে সেনাপতি কার্তিকেয়’র উপাসনা করা হত। পুষ্যমিত্রের আমলে হিন্দু ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। মনুস্মৃতি’র অন্তর্গত ব্রাহ্মণ্যবাদের আদর্শগুলি তাঁর আমলে বিস্তার লাভ করে।
সুতরাং, আমরা বলতেই পারি যে বিদেশী শক্তিকে উপেক্ষা করে, তার কাছে মাথা নত না করে বৈদিক সভ্যতা তথা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার পিছনে পুষ্যমিত্রের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালে আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতিকে রক্ষা এবং আমাদের অতীতকে গৌরবান্বিত করার জন্য শুঙ্গ রাজাদের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
রাজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করা ছিল পুষ্যমিত্রের জীবনের একমাত্র ভুল। শুঙ্গের হাত ধরে শুরু হওয়া এই গণহত্যার ধারা বহুকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। শেষ শুঙ্গ রাজা তাঁর নিজের মন্ত্রীর হাতে নিহত হওয়ার পর এই ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে।
আমরা জানি যে আমাদের ইতিহাস রচনাকারী ঐতিহাসিকরা ছিলেন ভীষণ পক্ষপাতদুষ্ট এবং তারা আমাদের অতীতের সংস্কৃতি ও সভ্যতার গৌরবময় অধ্যায়গুলি ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়েছেন। সরকারের উচিৎ দায়িত্ব নিয়ে পুষ্যমিত্র শুঙ্গের কাহিনী মানুষকে জানানো, তাঁর অবদানের কথা জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়া।
(ট্রনিকল ডট কম থেকে গৃহীত)