‘পয়লা বৈশাখ’ বাংলা বঙ্গাব্দের প্রথম মাসের প্রথম দিন। এই দিনটি বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। এটি বাঙ্গালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবেও বিবেচিত। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ ই এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল ‘পহেলা বৈশাখ’ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোনও পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল পাওয়া যায়।
হিন্দু সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হয়। এই সৌরপঞ্জিকা শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, মনিপুর, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, নেপাল, কেরল, ত্রিপুরা, তামিলনাডু প্রভৃতি ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য সহ বাইরের নানা স্থানে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার জন্য পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, অতীতে এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ‘আর্তব উৎসব’ তথা ‘ঋতুধর্মী’ উৎসব হিসেবে পালিত হত। সেই সময় এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। কারণ প্রযুক্তিগত উন্নতি ও প্রয়োগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।
পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় ‘বাংলা নববর্ষ’ তথা ‘পয়লা বৈশাখ’। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিমবাংলায়। বাংলার গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় ‘চড়কপূজা’ অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এই দিনেই সূর্যদেব মীনরাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করেন। এই দিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে ব্রত পালন করে থাকেন। বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় ‘গাজন’। ভক্তদের এই শারীরিক কসরৎ দেখাতে মানুষের ঢল নামে।
বর্ষশেষের দিন বাঙালির বহু পরিবারে ‘টক’ এবং ‘তিতো’ ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা প্রাতঃকালে স্নান সেরে দেব-দেবীর মন্দিরে পুজো দিয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এই দিন থেকেই তাদের ব্যবসায়িক হিসাবের নতুন খাতা উদ্বোধন করে থাকে, যাকে বলা হয় ‘হালখাতা’। গ্রামেগঞ্জে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পহেলা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় ‘বৈশাখী মেলা’। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়।
নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরী আয়োজিত হয়। চৈত্র মাসে দোকানে কেনাকাটার উপরে দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত নাম হল ‘চৈত্রসেল’। তাই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাজারে মানুষজন একমাস ধরে নতুন জামা কাপড় ইত্যাদি ক্রয় করে থাকেন।
পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্যভাবে ভিড় দেখা যায় কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর সহ বাংলার বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেব-দেবীকে পুজো নিবেদন করে ‘হালখাতা’ আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেব-দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে মন্দিরে গিয়ে থাকেন। এই দিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি, পাজামা, পাঞ্জাবী এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। আসলে বাঙালি হিন্দুর মনেপ্রাণে যে ধর্ম বাসা বেঁধে আছে , এই সব উৎসব তারই প্রমাণ দেয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্রিয়াকর্মেই হিন্দুরা স্মরণ করে থাকেন তাঁদের আরাধ্য ঈশ্বরকে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-শোক জীবনের প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি ভাবনা চিন্তা অথবা প্রতিটি কেন্দ্রে রয়েছে ধর্ম, রয়েছেন ঈশ্বর। তাই প্রতিটি অনুষ্ঠানের আগেই হিন্দুরা ভক্তি সহকারে দেবতার আরাধনায় মেতে ওঠেন।
এদিক থেকে বলা যায়, পুজো প্রার্থনা হোমযজ্ঞ রয়েছে হিন্দুর নিঃশ্বাসে ও প্রশ্বাসে। আর সেই কারণেই পয়লা বৈশাখ ও নববর্ষের দিনে হিন্দুরা মেতে ওঠেন নানা পুজো বা যাগযজ্ঞে। নববর্ষে বঙ্গদেশে যেসব দেব-দেবীর পূজা হয় তার মধ্যে রয়েছে গণেশ-লক্ষ্মী ও মা ভগবতীর আরাধনা। এছাড়া গৃহদেবতা বা গৃহদেবীর বিশেষ পুজো এই দিনে হয়ে থাকে। গৃহদেবতা বা গ্রাম্য দেবতা হিসাবে শিব, কৃষ্ণ, গোকুলচাঁদ, গোবিন্দ, নারায়ণ, বিষ্ণু, ধর্মরাজ, ধর্মঠাকুর, গোপাল প্রভৃতির পূজা হয়। আবার গৃহদেবী, কুলদেবী বা গ্রাম্যদেবী হিসেবে মা চন্ডী, শীতলা, মনসা মাতারও পুজোর আয়োজন করা হয়। যাই হোক হিন্দুর উপাস্য দেবদেবীর সংখ্যা বড় কম নয়।
এই পুজোর দিনে দেবতা বা দেবীর অভিষেকের মাধ্যমে নতুন শস্য দিয়ে তৈরি বিভিন্ন উপাচারে ভোগ নিবেদন করা হয়। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেশি গুরুত্ব পায় লক্ষ্মী-গণেশ পুজো। গণেশ হলেন সিদ্ধিদাতা। যে কোনো দেবতারই পুজোয় প্রথম গণেশের পূজা করা হয়। সে শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব কিংবা গৌড়ীয় যে সম্প্রদায়েরই পুজোর আয়োজন করা হোক না কেন, সকলের শুরুতেই গণেশের আরাধনা করতে হয়। ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসার সর্বসিদ্ধি লাভের আশায় নববর্ষের এই শুভদিনে গণেশ পুজো করে ‘হালখাতা’ বা ব্যবসায় নতুন হিসাব খাতা সূচনা করেন। ওই ‘হালখাতা’য় সিঁদুর দিয়ে ‘গণেশায় নমঃ’ লিখে টাকার ছাপ ও স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হয়৷
গণেশের মতই নববর্ষের প্রথম দিনে লক্ষ্মীপুজো করা হয়ে থাকে। লক্ষ্মীর অপর নাম ‘শ্রী’। লক্ষ্মী অপূর্ব সুন্দরী এবং সমৃদ্ধি ও সম্পদের দেবী। তিনি পদ্মাসনা বা পদ্মহস্তা। সাধারণত দুটি বা চারটি হাত, কখনও বহু বাহু লক্ষ্মীর সন্ধান পাওয়া যায়। সাধারণত লক্ষ্মী হলেন তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। তবে চন্দ্রপ্রভার মতো শ্বেতবর্ণা লক্ষ্মীরও ধ্যানমন্ত্র রয়েছে। লক্ষ্মী হলেন সৌন্দর্যের প্রতীক। ধন সম্পদের দেবী হিসেবে লক্ষ্মীমাতার আরাধনা করা হয়, যাতে লক্ষ্মীদেবীর কৃপা পাওয়া যায়। সেই কারণেই ব্যবসায়ী ও কারবারিরা আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য পহেলা বৈশাখে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করে থাকেন৷
পয়লা বৈশাখের দিন বাংলার গৃহস্থরা অনেকেই ভগবতীর পুজা-অর্চনা করে থাকেন। গরুকে কল্পনা করা হয় মাতা ভগবতী হিসেবে। এই কারণেই এদিন গোয়াল পরিষ্কার করে গরুকে ভালো করে তেল হলুদ দিয়ে স্নান করিয়ে গৃহস্থ ভগবতীমাতার পুজো করে থাকেন। সব মিলিয়ে পহেলা বৈশাখ হিন্দুর জীবনে শুধু একটি দিন নয়, সকলের কাছে মঙ্গল ও শ্রী’র প্রতীক৷
আধুনিক ভারতের নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পহেলা বৈশাখে হোম-যজ্ঞ, কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ এই রকমই কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সালেও ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়, তবে এই উৎসব সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। বহু ঐতিহাসিক বাংলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেছেন সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষিপণ্যের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হত। খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে সুষ্ঠুতা আনার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন৷
বাংলা চৈত্রমাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করার নিয়ম চালু ছিল। এরপরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এই উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তবে বাংলা দিনপঞ্জি অস্তিত্ব আকবরের সময়ের পূর্বেও ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, ‘পয়লা বৈশাখ’ উৎসব ঐতিহ্যগত হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সাথে সম্পর্কিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই দিনে এই উৎসব পালিত হয় যা বৈশাখী নামে পরিচিত। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের নববর্ষের উৎসবগুলি হিন্দু ‘বিক্রমী দিনপঞ্জি’-র সাথে সম্পর্কিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে এই দিনপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছে। তবে বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি। বরং ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল রাজা শশাঙ্কের শাসনকাল থেকে৷
বাংলা নববর্ষ তথা ‘পহেলা বৈশাখ’ পালনের সঙ্গে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধ লিখেছেন ‘অহোরাত্রান্যার্ধমাসা মাসা ঋতবঃ সম্বৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি’ অর্থাৎ ‘যে অক্ষর পুরুষকে আশ্রয় করিয়া দিন ও রাত্রি, পক্ষ ও মাস, ঋতু ও সংবৎসর বিধৃত হইয়া অবস্থিতি করিতেছে, তিনি অদ্য নববর্ষের প্রথম প্রাতঃ সূর্যকিরণে আমাদিগকে স্পর্শ করিলেন৷ এই স্পর্শের দ্বারা তিনি তাঁহার জ্যোতির্লোকে তাঁহার আনন্দলোকে আমাদিগকে নববর্ষের আহ্বান প্রেরণ করিলেন৷’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নববর্ষের আবাহন মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন এই প্রবন্ধে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। নানা জ্বালা যন্ত্রণা সংকটের মধ্যেও বাঙালি হিন্দুর জীবনে নববর্ষের এই দিন ধর্মীয় ও আনন্দের আবহে শঙ্খধ্বনির আহ্বানে তাই হয়ে ওঠে শুভ ও মঙ্গলময়৷
সরোজ চক্রবর্তী