পর্ব ১
দিব্যাং ভদ্রাসনযুতাং শিবিকাং স্যন্দনোপমাম্।
পক্ষিকর্মভিরাচিত্রাং দ্রুম কর্মবিভূষিতাম্।।
ভদ্রাসনযুক্ত , মনোরম রথের তুল্য শিবিকা আনীত হয়েছিল। সেটি পক্ষীর চিত্রের দ্বারা চিত্রিত এবং বৃক্ষ প্রতিকর্তির দ্বারা শোভিত ছিল।
হ্যাঁ , শিবিকা …রামায়ণে উল্লিখিত শিবিকা। আমাদের সুপ্রাচীন কালে ঘোড়া, ঘোড়ায় টানা রথ , গোশকট, ভারবাহী পশুদ্বারা চালিত শকটাদি ব্যতীত প্রাত্যহিক জীবনে নিকট দূরে চলাফেরা করার জন্য ব্যবহৃত হতো শিবিকা , যাকে এখন পাল্কীও বলা হয়। এছাড়াও ছিল দোল, চতুর্দোল, অষ্টদোল , দ্বাদশদোল , ষোড়শদোল ইত্যাদি যান । শিবিকার সঙ্গে রথের কোনরূপ সাদৃশ্য নেই এটা জানা কথা। তবে, রামায়ণে যে শিবিকার কথা বলা হয়েছে তা অধুনা পাল্কী থেকে কিছু স্বতন্ত্র বলেই অনুমান হয়। কারণ পাল্কীতে ভদ্রাসন সংস্থাপন করা সম্ভব হয় না।
অমরকোষে #শিবিকা ও #যাপ্যযান এই দুইটি শব্দের তুল্যার্থতা বিবেচিত হয়েছে। টিকাকার ভানুজীদীক্ষিত বলেন যে , শিবিকা শব্দের অর্থ – পাল্কী। রঘুনাথ চক্রবর্তী মহাশয় বলেছেন যে , শিবিকা এবং যাপ্যযান শব্দ চতুর্দোল বাচক। তবে, ভোজরাজ উহাকে #অষ্টদোল বিশেষরূপ অর্থে প্রযুক্ত করেছেন।
ভোজ বর্ণিত শিবিকাতে নবদন্ড ছত্রের রীত্যনুসারে মণি, কুম্ভ, মুখ প্রভৃতি নিধানের ব্যবস্থা দেখা যায় ।
মণিকুম্ভ – মুখদীনাং নিয়মো নবদন্ডবৎ।
ইহা ব্যতীত, দ্বাদশদোল , ষোড়শদোল এমনকি বিংশতিদোল ইত্যাদি যানও নির্মিত হতে পারে সে কথা উল্লিখিত হয়েছে। ভোজ বলেছেন যে, চতুর্বিংশতিদোলও নিৰ্মাণ করা সম্ভব। ব্যাস বলেছেন , বহুবাহকাদি সমন্নিত যান বহুগুণযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছে।
এবং দ্বাদশ- ষোড়শ – বিংশতি দোলাদিকাঃ।
বিংশতি দোলাৎপরতো ভোজমতে সম্ভবেদ্ যানং।
যানং বহবনুযোজ্যং বহুগুণমেতজ্জা বৈ ব্যাসঃ।।
প্রদর্শিত চতুর্দোলাদি নিৰ্মাণ পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য করলে মনে হয় , অতি পূর্বকালে যান ইত্যাদি ব্যবহার্য বস্তুতেই স্থান, কাল , পাত্র ভেদে র চিন্হ ব্যবহারের আবশ্যকতা বিবেচিত হয়েছিল। সুতরাং , যানাসন দেখিয়েই কোন্ জাতীয় রাজা এবং কোন্ প্রদেশে তাঁর বাস তা অনায়াসেই উপলব্ধি করা যেত।
যাক , তো সেই শিবিকা বা পাল্কী এবং সমগোত্রীয় যান নিয়ে আজ একবার সেই পুরাতন কলকাতায় ঘুরতে যাব । আপনারাও যাবেন…আপনাদের নিয়ে যাবার জন্যেও সুব্যবস্থা আছে। তো চলুন …শুরু করা যাক…
সুপ্রাচীন ভারতবর্ষে সকল স্থানে ,একসময় পাল্কী বা শিবিকা এবং ঐ জাতীয় নানা যানের একসময় ছিল জমজমাট হাঁকডাক। অনেকেই আদর করে এর নাম দিয়েছিলেন #সুখাসন। বিদেশীরা বলত , প্যালানচিনো।
পুরোনো কলকাতার পথঘাট , গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে আমরা এখন আধুনিক। এখন আমাদের কাছে কত না যানবাহন। কিন্তু সেই পুরাতন কলকাতার যাত্রার একটি অন্যন্য এবং আদিম যান ছিল এই পাল্কী। আর ছিল ডুলি। এগুলো তো যান্ত্রিক শকট বা পশু শকট ছিল না। মানুষকেই এগুলিকে বহন করতে হতো। পাল্কী , ডুলি বা সমগোত্রীয় যান গুলির বাহকদের #বেহারা বা কাহার বলত। বেহারা লোকমুখে বেহারা বেয়ারা হয়ে গিয়েছিল ।
সুপ্রাচীন বিভিন্ন ভারতীয় সাহিত্য , গ্রন্থাদি ছাড়াও টমাস রো – এর দিনলিপিতেও এই পাল্কী সম্পর্কে বেশ রাজকীয় বর্ণনা প্রাপ্ত হয়।
” চলেছে রাজকীয় শোভাযাত্রা । প্রথমে সম্রাটের ঘোড়ায় টানা রথ। তার পিছনে সোনার গয়নায় সজ্জিত নয়টি অশ্ব। তার পিছনে পাল্কী। গুনতিতে তিন । তাদের পায়া এবং বসবার জায়গা সোনা দিয়ে মোড়া। হাতলের বাঁটে মণি – মুক্তো। দরজার দুপাশে ঝালর। তার গায়ে পান্না আর পদ্মরাগ মণি। “
বঙ্গ তথা আপামর ভারতের বাহন ছিল পাল্কী । বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা তার প্রজ্জ্বলিত উদাহরণ। কেবল কপালকুন্ডলা কেন ? ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেই পাল্কী। আবার কোনো কোনো উপন্যাসে পাল্কী যেন একটি চরিত্র। তাকে নিয়েই ঘটনা, দুর্ঘটনা, ঘাত – প্রতিঘাত, চরিত্রদের মরা বাঁচা।
এক ফরাসি মণিমুক্তো ব্যবসায়ী নাম তাভার্নিয়ের ভারত পর্যটনে এসেছিল সেই মোঘলদের পড়তির সময়। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনী থেকে মোঘলদের শেষ ইতিহাস কিছু জানা যায়। তবে হ্যাঁ , পাল্কীর প্রতাপ সম্পর্কেও জানা যায়। সে সময় পাল্কী বাহক বা বেহারাদের মাসিক মাইনে ছিল চার টাকা। তবে কিনা ….একা একা পাল্কী চেপে দূরদূরান্তে যাবার কথা ভাবলে মানুষের মন ভয়ে কম্পিত হত। একজন যদি পাল্কী চড়ত , তো সঙ্গে থাকত ছয় বেহারা এবং জন্য তিরিশ লোক লস্কর। তাদের কারো হাতে বর্শা , কেউবা বল্লম নিয়ে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে পথ পাহাড়া দিয়ে এগিয়ে যেত। কারুর হাতে থাকত তীর ধনুক। অনেক সময় রক্ষী কি লস্করের হাতে গাদা বন্দুকও থাকত।
যাত্রী যদি হতো রাজপুরুষ বা রাজবংশ জাত তবে কেউ হাতে নিত পতাকা ,কেউবা রাজছত্র। রাতের আঁধারে সেই সব রক্ষীদের হাতের আরো একটি অস্ত্র হতো লাল আগুন মশাল।
কোন রাজা কুটমন্ত্রনা করতে দূরে গোপন কোনো স্থানে যাবেন, রাজার কাছে ভেট যাবে সঙ্গে যাবে একজন প্রধান রাজ ব্যক্তি, রাণী যাবেন মন্দিরে , এখান থেকে রাজঅর্থ ও অস্ত্র যাবে সেখানে…..কিন্তু যাবেন কিসে ? কিসে আবার…ছয় কাহার বেহারা নিয়ে পাল্কী কোমর বেঁধেছে।
সাহেব যাবে অফিসে …, তার বিবি যাবেন হাওয়া খেতে। আরে আরে অমুক জমিদার , ওরে ওরে তমুক সাহেব চাঁদপাল ঘাটে নেমেছে। তা তাঁরা শহরে আসবেন কিসে ? তমুক জমিদার বাড়ির বড় গিন্নী মেয়ে বউ নিয়ে যাবেন কালীঘাটে পুজো দিতে । যাবেন কিসে? কিসে আবার ? পাল্কী চড়ে…. গঙ্গা স্নানের দিনও গিন্নীরা পাল্কীর ভিতরে করে গঙ্গায় ডুবে আসতেন। পাল্কীর আদর দেশীয় এবং বিদেশীয় উভয় পাড়াতেই ছিল পাল্কীর মান্যিগন্যি।
মিসেস ফে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন –
” সম্প্রতি এক ধনী হিন্দু পরিবারের বিবাহের শোভাযাত্রা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। শুনলাম পাত্রের সঙ্গে পাত্রীও চলেছে এক পাল্কীতে। পাল্কীটি চমৎকারভাবে সজ্জিত। তাদের সঙ্গে চলেছে পাত্র এবং পাত্রী দুপক্ষের আত্মীয় – স্বজন , যথেষ্ট সাজগোজ করে। তাদের কেউ চলেছে ঘোড়ার পিঠে , কেউ বা হাতির পিঠে, কেউ বা পাল্কীতে। “
বিদেশীদের কাছে পাল্কী একটি অভিনব জিনিস মনে হতো। যেমন – ফ্যানি পার্কসের রচনায় তার উল্লেখ আছে।
পাল্কী বা শিবিকা বা সমগোত্রীয় যান গুলোর বালকদের চলার গতিটাও ছিল বেশ সুন্দর , না হাঁটা আর না দৌড়ানোর মাঝামাঝি। দুপেয়ে মানুষের চার পেয়ে ঘোড়ার দুলকি চাল। ওই যে দেশি ঘোড়া হাঁটে যেভাবে। বেহারাদের চলার সঙ্গে এঁটে থাকতো একটা নিঃশ্বাসের ঘোঁতঘোঁত শব্দ। এইটা তাদের এগিয়ে চলার শক্তি যোগাত। দক্ষ বেহারাদের কাঁধে কোনোদিন পাল্কী কাঁপত না।
পাল্কী বহনের মধ্যে ছিল একটা ছন্দ। বেহারারা পাল্কী বহনের সময় গান গাইত। সে সব পাল্কীর গান তাদের কেবল পথশ্রমের শক্তিই যোগাত না , তার সঙ্গে পথের নানা দৃশ্য, গ্রাম, পরিবেশ , সমাজ ইত্যাদির কথাও সুন্দর করে ব্যক্ত হতো।
“কর্তাবাবুর রঙটি কালো, গিন্নি মায়ের মনটি ভাল। সামলে চলো হেঁইও।”
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতায় সেই ছন্দ , সেই বালকদের শ্রম, পাল্কী বয়ে যাওয়া পথের দৃশ্য সুন্দর করে তুলে ধরছিলেন।
পাল্কী চলে!
পাল্কী চলে!
গগন-তলেআগুন জ্বলে!
স্তব্ধ গাঁয়েআদুল গায়ে
যাচ্ছে কারারৌদ্রে সারা
ময়রামুদিচক্ষু মুদি’
পাটায় ব’সে
ঢুলছে ক’ষে।
হিকির রচনায় এই পাল্কীর কথা সবথেকে বেশি পাওয়া যায়। কানে শোনা এবং চোখে দেখার অভিজ্ঞতা ছাড়াও তার ছিল চেপে দেখার অভিজ্ঞতা । প্রথমবার স্বদেশে চার বছর কাটিয়ে আবার সে যখন ,ভারতে মানে কলকাতায় ফিরল তখন পুরনো বেনিয়ান দুর্গাচরণ মুখুজ্যে তাকে একটা সুন্দর পাল্কী কিনে দিয়েছিলেন। এমনকি জোগাড় দিয়েছিলেন চার কাহার – বেহারা।
তো এহেন হিকির স্মৃতি কথা পাল্কী নিয়ে বেশ কিছু মজার মজার কাহিনী আছে । যেমন –
“ক্লিভল্যান্ড সক্কাল বেলাই সবেমাত্র কলকাতা পৌঁছেছে। একটা পাল্কী চেপে চলেছে নিজ গন্তব্যে। সে প্রথম বার এমন চার কাহার – বেহারা বাহিত যানে উঠেছে। বেহারারা সুর করে পাল্কীর গান ধরেছে।
‘‘হেঁইও জোয়ান, সরু আল, চলো ধরে। কর্তাবাবুর, দরাজ দিল, দেবে ধরে।’’
সেসব শুনে ক্লিভল্যান্ড তো ভয়েই আধমরা । ভাবল , এ নির্ঘাত ওই বেহারাদের কাতরানি। তাকে বহন করতে হয়তো লোকগুলোর খুব কষ্ট হচ্ছে। ক্লিভল্যান্ড তখনই পাল্কী থেকে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ভাবল, না হলে পরে তার বহনের ভারে লোকগুলো মারা পড়বে আর দেশিয় মানুষ বা সরকার কেউই তাকে ছাড়বে না । তার উপর লাগবে নরহত্যার পাপ। তাই তড়িঘড়ি পাল্কী থামাতে বলল ক্লিভল্যান্ড। ভেবেছিল পাল্কী থেকে নেমেই দেখবে মাটিতে এক এক করে সব লোকগুলো মুখ থুবড়ে মরে পড়বে। কিন্তু ওমা ওমা ….কি কান্ড ? সব্বাই মনের আনন্দে হাঁসছে, কথা কইছে। এসব দেখে সাহস পেয়ে আবার ক্লিভল্যান্ড পাল্কীতে বসল। আবার , সেই গোঙানির শব্দ …লাল মুখো সাহেব অজানা অলৌকিক ভয় পেল। এবার নির্ঘাত কোনো ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটবে। ভয়ে নীল লালমুখো ক্লিভল্যান্ড পাল্কী থামিয়ে, নেমে বেহারাদের হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়ে দুড়দার দৌড় দিল।”
পুরনো কলকাতা , সেখানে কেবল পাল্কী , ডুলি এগুলোই চলত তেমন নয় সেটা পূর্বেই বলেছি। গোশকট বা গোরুর গাড়ির রমরমা কিছু কম ছিল না। যে সময়ের কলকাতার কথা বলছি সে সময় কালীঘাট ছিল প্রাচীন তীর্থ এবং জমজমাট কিন্তু এখনের ঝাঁ চকচকে কুলীন চৌরঙ্গী ছিল ঘুটঘুটে আঁধার আর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সে চৌরঙ্গীর বিকট রূপ একবার যদি কেউ ওই ডিজিটাল, থ্রিডি এসব করে দেখতে চায় তবে বেশ আতঁকে উঠবে। যাক, কেন চৌরঙ্গী নিয়ে বললাম , সে কথায় পরে আসছি … তো, যা বলছিলাম, সকলের তো আর পাল্কী, ডুলি এসব রাখা বা চড়ার সাধ্য হতো না । ফলে, অসংখ্য ম্যাংগো পিপিল ইয়ে আম লোক ইয়ে সাধারণ জনগণ চড়তেন এই গোরুর গাড়ি। তাই গোরুর গাড়ি বেশ জনপ্রিয় ছিল। নিত্য যাত্রীরা প্রায় বাদুড় ঝোলা হয়ে যাতায়াত করছে , পথে এমন দৃশ্যও বিরল ছিল না। সরকারি কাজেও গোরুর গাড়ি ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া মালবাহী হিসাবে গোরুর গাড়ির জুড়ি মেলা ভার ছিল।
তবে গোরুর গাড়ি খুব শ্লথগতির যান ছিল না। তাই কলকাতায় পাল্কী এবং অন্য সব রকম যান প্রচলন হওয়ার পরেও গোরুর গাড়ি চলা বন্ধ হয় নি। ফলে সেই প্রাচীন কলকাতায় কলকাতায় যানজট হতো ব্যাপক। দুর্ঘটনাও ঘটত। শোনা যায় , গোরুর গাড়ি চাপা পড়ে অনেক মানুষ মারা যায় বহুক্ষেত্রে ।
১৮৬২ সাল নাগাদ , কলকাতার পথে গোরুর গাড়ি কৌলিন্যতা ও গর্ব নিয়ে পাল্কী এবং ঘোড়ার গাড়ি সঙ্গে চমৎকার তাল মিলিয়ে চলত। ওইসময় কলকাতায় গোরুর গাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০ শতের মতো। কিন্তু এখানেই গোরুর গাড়ি হারিয়ে যায় নি কলকাতার বুক থেকে। বিশ শতকের গোড়ায় গোরুর গাড়ির সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ১৬০০ – এরও অধিক। বিশ শতকের মাঝামাঝিও কলকাতার রাজপথে গোরুর গাড়ি চোখে পড়ত। কলকাতা পুরসভার একটি বিশেষ বিভাগ গড়ে উঠেছিল কেবলমাত্র গোরুর গাড়ির জন্য।
কলকাতার রাস্তায় গোরুর গাড়ির আধিক্য নিয়ে বলতে গিয়ে বলে পড়ে গেল রডা কোম্পানির মাউজার পিস্তল লুন্ঠনের সেই শিহরিত করা বৈপ্লবিক কার্যকলাপ যুক্ত ঘটনা। বিহারী গাড়োয়ান সেজেছিলেন বিপ্লবী হরিদাস দত্ত…গাড়ির অদূরে কোমরে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্রীশ পাল ও খগেন দাস….সুরেশ চক্রবর্তী , বিমান ঘোষ, আশুতোষ রায়, জগৎ ঘোষ সাদা পোশাকে নজর রেখেছিলেন পথ ও পুলিশের উপর…..। আর মাউজার পিস্তলের খবর ও গোরুর গাড়ি করে সরানোয় মূল মাথা ছিলেন রডা কোম্পানির কর্মচারী শ্রীশচন্দ্র মিত্র , যিনি হাবু নামেও পরিচিত ছিলেন। গুদাম থেকে অস্ত্র লুন্ঠন করে গাড়িটি সবার অলক্ষ্যে সোজা চলে গেছিল পূব দিকে। ম্যাংগো লেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট , বেন্টিং স্ট্রিট পেরিয়ে চাঁদনী চক এর পাশ দিয়ে ওয়েলিংটনের নিকটস্থ মলঙ্গা লেনে। মিশন রো অথবা গনেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ এর অস্তিত্ব তখন ছিল না ।
পরে কালের নিয়মে সেই গোরুর গাড়ি কলকাতার পথ থেকে হারিয়ে যায়।
কলকাতা, গোবিন্দপুর আর সুতানুটি এই তিন গ্রাম নিয়েই তো আজকের প্রাণেরই শহর কলকাতা। তাই সেই আদি কালের পাল্কী , ডুলি ছিল গাঁ জঙ্গলের পথ দিয়ে দূরে যাবার ভরসা যোগ্য যান। তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আভিজাত্যের ছাপ কিয়ে নিঃশব্দ প্রতিযোগিতা চলত। ডুলির চেয়ে পাল্কীর কাহার বেহারা একটু অধিক লাগত, তাই খরচও ছিল বেশি। চৌরঙ্গীর জঙ্গল ভেদ করে সরু সিঁথি কাটা রাস্তা দিয়ে দিনের আলোতেও কালীঘাটে যেতে গেলে বুক ধুকপুক করত। যাত্রীদের সাড়াশব্দ পেলেই চৌরঙ্গীর জঙ্গল দিয়ে বেরিয়ে আসত …..লাল ভাঁটার মতো চোখ করে, পাগড়ি আঁটা বল্লম , সড়কি হাতে …হা রে রে রে রে …ইয়া তাদের পাকানো গোঁফ , হাতে বালা, বিশাল চেহারা….
এইসব দুর্গম পথে তো আর গোরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি যেত না। অগত্যা পাল্কী ছিল ভরসা। অনেক রাস্তা ঘাট এমন ছিল যে সেসব জায়গার পাল্কী পাওয়াটা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক সময় ডবল ভাড়া দিলেও রাজী হতো না বেহারারা। কেউ রাজী হলে ভাড়ার মা বাপ থাকত না। ভাড়া নিয়ে বাহকরা একসময় বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করল। তখন কি হল ? কি হল ? বলব না হয় পরের পর্বে!
ক্রমশঃ
@দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত )
তথ্যঃ ১ ) প্রাচীন শিল্প পরিচয়
২) কলিকাতার কাহিনী
৩) পালকি থেকে পাতাল রেল
৪) এক যে ছিল কলকাতা