কখনও যা কল্পকাহিনী বা স্রেফ গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় স্বঘোষিত যুক্তিবাদী শিবির থেকে, সময় সময় সেখান থেকেই ইতিহাস রচনার ইন্ধন খুঁজে নেন সেই একই যুক্তিবাদী ছাউনির মানুষগুলো। খুব জোরে ঝাঁকালে তেলে জলেও মিশ খায়, যেমন দুধ। জলের মধ্যে স্নেহ পদার্থের দুধ নামক কলয়ডীয় মিশ্রণটি যেমন রীতিমতো পুষ্টিদায়ী ও জনপ্রিয়, তেমনি আমাদের সমাজে ইতিহাসের সঙ্গে পুরাণ, বিজ্ঞানের সঙ্গে তন্ত্র, ঘটনার সঙ্গে রটনা, ডাক্তারির সঙ্গে তাবিজ-কবচ এমন চমৎকার মিলেমিশে থাকে, যে সত্যাসত্য তফাত করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
মাঝে মাঝেই বেশ শোরগোল পড়ে যায়, মানে তীব্র প্রতিবাদ শোনা যায়, বিজ্ঞানমঞ্চে বা অনত্র দাঁড়িয়ে গৈরিক শিবিরের তাবড় নেতারা রাবণ বিমান অর্থাৎ এরোপ্লেনে সীতা হরণ করেছিল, কিংবা গণেশের ধড়ে হস্তী-মস্তক স্থাপন প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ, পুরুষ ময়ূরের অশ্রুপান করে স্ত্রী ময়ুরের গর্ভবতী হওয়া, গোরুর কুঁজে স্বর্ণভাণ্ডার বা স্বর্ণ-সংশ্লেষ হওয়া ইত্যাদি দাবি করে শিক্ষাব্যবস্থা রসাতলে পাঠাচ্ছেন। নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গরিমা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান না জেনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করার এই প্রচারগুলো অনেকাংশে হাস্যকর। কিন্তু এই প্রয়াস হাস্যকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও উদ্দেশ্যটা অসৎ বলা যায় না। আবার বিপরীত দিকে ভারতীয় প্রাকবৈদিক ও বেদ পরবর্তী মৌখিক বা লিখিত সাহিত্যের অপব্যাখ্যা করে আর্যদের বহিরাগত ও হিন্দুধর্মকে ভারতবিরোধী সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কিন্তু সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি দুরভিসন্ধিমূলক।
দ্বিতীয় পক্ষের প্রচারাভিযানগুলো বেশ সুসংগঠিত এবং দেখা যায়, একসাথে বহু মানুষ হঠাৎ করে সেই তত্ত্বের সমর্থক ও প্রচারক হয়ে ওঠে এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মানুষরাও তাদের সেই ব্যাখ্যানগুলো বিশ্বাসও করতে শুরু করে। চৈতন্যদেবের খুনী হিন্দু পাণ্ডারা (যেন মহাপ্রভু অহিন্দু ছিলেন), বাংলা ক্যালেন্ডারের জনক বাদশা আকবর ইত্যাদি একের পর এক ষড়যন্ত্রী প্রচারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দানব ও দেবতার সংঘাতের ব্যাখ্যা, যা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর আদতে দানব বা অসুর বলে পরিচিতরাই ভারতবর্ষের বীর আদি ভূমিসন্তান, আর সুর বা দেবতারা হল বহিরাগত আর্য, যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে নানা ছলচাতুরি অত্যাচার দ্বারা এখানকার আদি বাসিন্দাদের উৎখাত ও প্রান্তিক করে দিয়েছে। এই ব্যাখ্যায় ছিটেফোঁটা যেটুকু সত্য তা হল, ক্ষমতা ও ভূমি অধিকারের সংগ্রামে আর্যরা অনার্যদের পরাজিত করে ভারতীয় জাতিসত্তার মূলস্রোত গঠন করেছিল, যেখানে অনার্যরা মূলত বনভূমিতে নিজেদের রাজত্ব ধরে রেখেছিল, অন্তত ব্রিটিশ আগমন ও বিশেষত বহুজাতিক সংস্থাগুলি আকরিকের সন্ধানে ভারতীয় বনভূমির দখল নেওয়ার আগে অবধি। তবে এই বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞানমনস্কদের কাছ থেকে বরাবর জেনে এসেছি এইসব পুরাণ-টুরাণ হল গালগল্প, তার মধ্যে ঐতিহাসিক সারবত্তা কিস্সু নেই। কিন্তু চলতি দশকে দেখছি পৌরাণিক গাঁজাখুরি গল্প বলে তাচ্ছিল্য করা সুরাসুরের লড়াইকে কেন্দ্র করেই সারা বছরই এক বা একাধিক গোষ্ঠী এই জাতীয় প্রচার চালাতে থাকে। তবে পুজোর আগেটায় মা দুর্গার অঙ্গবাস ধরে টানাটানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। উত্তরটা একে একে দেওয়া যাক।
আর্যরা কি বহিরাগত?
ব্রিটিশ ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার উৎপাদন যেসব ঐতিহাসিক, তাঁদের তত্ত্বে আর্যরা কৃষিকার্যে অনভিজ্ঞ যাযাবর জাতি হিসাবেই চিহ্নিত, যারা বর্তমান ভারত উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডে ঢুকে অনার্য সভ্যতাকে একই সঙ্গে অধিকার ও আত্মস্থ করে নেয়। একই সঙ্গে তাঁরা কিন্তু আর্যদের উন্নত ভাষা এবং বৈদিক সাহিত্য দর্শনেরও সদর্থক মূল্যায়ন করেছেন।
বর্ণহিন্দু দ্বারা নিম্নবর্ণের ওপর অত্যাচার ও বঞ্চনা যার ধারাবাহিকতা গোবলয়ে এখনও বহাল, তা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই। আধুনিক যুগে বিদ্যাসাগর, জোতিবা ফুলে, সাবিত্রী থেকে ডঃ আম্বেদকর অনেকেই এই সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য নিজের মতো করে চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে বিশেষত জাতপাতের ভিত্তিতে শিক্ষা ও চাকরীতে সংরক্ষণ দ্বারা পিছিয়ে পড়া সমাজকে মূলস্রোতের সমতুল্য করতে চাওয়ার মতো উদ্যোগ ভারতীয় ব্যালট রাজনীতির প্রভাবে তথাকথিত দলিত বা অস্পৃশ্য জাতের উন্নতি সাধনের বদলে তাদের মধ্যে কিছু সবিধাভোগীর বংশানুক্রমিক আজীবন সুবিধা ভোগের যন্ত্র হয়ে গেছে। কিন্তু এই মণীষীদের কাছে প্রগতিশীলতা ও স্বদেশ বিরোধিতা সমার্থক ছিল না। বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো যোদ্ধা ডঃ ভীমরাও আম্বেদকার নিজেই আর্যদের বহিরাগত মনে করতেন না।
রোমিলা থাপর, ইরফান হাবিব প্রমুখদের দৌলতে বর্ণাশ্রম বৈদিক সমাজের বৈশিষ্ট্য বলে জানলেও জনৈক বন্দিত কমিউনিস্ট ও হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকারী লেখক রাহুল সাংকৃত্যায়ন কিন্তু অন্য কথা বলেছেন। তাঁর ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইয়ের কয়েকটি গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, আর্যরা যাযাবর ছিল বলে তাদের সবাইকে এমনকি মেয়েদেরও অশ্বারোহণ শিখতে হত এবং স্ত্রী পরুষ সবাইকেই কমবেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হত। রাহুলজীর মতে বেদভাষা ছাড়া আর্যরা বিশেষ কোনও শিল্প ও স্থাপত্য হয়তো বয়ে আনতে পারেনি, বরং তাদের সেনানায়ক ইন্দ্র বা ইন্দ্ররা ছিল অনার্যবিরোধী ‘পুরন্দর’, যাদের নেশা ছিল পুরী তথা নগর সভ্যতা ধ্বংস করা; কিন্তু মানুষ নিয়ে দাসব্যবসা বা দেহব্যবসার ধারণা ছিল আর্যদের কাছে অকল্পনীয়, এমনকি সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসও পরিযায়ী আর্যসমাজের ছিল না। তারা যুদ্ধবন্দীদের দাস-দাসী না বানিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাই করত। দাস ব্যবসা বেশ্যাবৃত্তি ও বর্ণভেদ– রাহুলজীর মতে এগুলো ছিল উন্নত নাগরিক সিন্ধুসভ্যতারই বৈশিষ্ট্য। যেখানেই স্থাবর সম্পত্তির ধারণা গড়ে উঠেছে, নারীকে গৃহবন্দী ও দাসী বানিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। ব্যাবিলন, মেসোপটামিয়া, এমনকি মিশর যেখানে দু-একজন রানীর সৌজন্যে মেয়েদের অবস্থা সম্মানজনক ভাবা হত– সর্বত্রই কিন্তু নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল গৃহকাজ ও পুরুষানুরঞ্জন। কৃষক ও নারীকে শোষণ করেই প্রতিটি সভ্যতার বিকাশ।
তিনি পুরোপুরি অভ্রান্ত বলছি না, তবে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রসহ অনেক গবেষকের লেখনীতেও প্রকাশ, নারী নির্যাতনের নৃশংস ও কদর্যতম উপায়গুলো অনার্য সমাজ থেকেই বৈদিক সমাজে অনুপ্রবিষ্ট। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভণ্ডামির তীব্র নিন্দা, এমনকি বেদান্ত ও ব্রহ্মজ্ঞানের ধারণাকেও কঠোর বিদ্রূপে বাপান্ত করলেও তার পাশাপাশি আরব-তুর্কিস্তান থেকে আগত বহিরাগত শাসকদের দ্বারা এই দেশবাসীর ওপর, বিশেষত মেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার, গণধর্ষণ বা হারেমবন্দী করার কথা লিখতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হননি। বৌদ্ধসমাজ সম্পর্কে যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব থাকলেও তাঁর সেই ইতিহাসবীক্ষণে আমি দুরভিসন্ধি খুঁজে পাইনি, বরং হিন্দুরা কেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের রক্ষা করল না, রাজপুত মেয়েদের জওহরে তালিম দেওয়ার বদলে শস্ত্রবিদ্যা দান করে কেন শত্রুনাশে ব্যবহার করা হয়নি, কেন ক্ষত্রিয় ছাড়া বাহ্মণ ও শূদ্রদের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য মেনে অস্ত্র হাতে রণক্ষেত্রে মুসলিম হামলাবাজদের মোকাবিলা করা থেকে দূরে রাখা হয়েছিল – এই নিয়ে এক কথায় হাহাকার করেছেন। প্রসঙ্গত_ সীতারাম গোয়েলের ‘The Hindu Society under Siege’ বইটি থেকে জানা যায়, স্বাধীন ভারতে জাতীয় ভাষা প্রসঙ্গে রাহুল সাংকৃত্যায়ন হিন্দী-উর্দু দ্বৈরথে দেবনাগরী লিপিতে হিন্দীকে সমর্থন করায় নিজেদের কমিউনিস্ট শিবিরে রীতিমতো অপদস্থ হন। তবে তিনিও হয়তো নিজ শিবিরের সহজাত রাশিয়া প্রেমের কারণে আর্যদের ভোলগা তীর থেকে আগত স্বর্ণকেশী জাতিগোষ্ঠী ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। আর্যত্ব নিয়ে গৌরব করার উপাদান না থাকলে তাদের জন্মভূমি কি রাশিয়ায় আবিস্কার করতেন?
কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ‘জনস্বার্থে প্রচারিত’ অজ্ঞাতপরিচয় প্রগতিশীলদের লেখার ভণিতাতেই দাবি থাকে – “মহিষাসুরের বীরত্ব ও আর্যদের নীচতার প্রকৃত কাহিনী জানুন”। সেই গবেষণাপত্র শুরু হয়েছে সুর ও অসুর শব্দের প্রকৃতি প্রত্যয় নির্ণয় দ্বারা যাতে স্পষ্ট ‘অসুর’ বা অনার্যরা ছিল অসিচালনায় পারদর্শী বীর ভূমিপুত্র এবং ‘সুর’ অর্থাৎ “আর্যরা ছিল অত্যাচারী, লুন্ঠনকারী, সুরা পানকারী, নারী ধর্ষণকারী, বর্বর যাযাবর” (বানানগুলো সংশোধিত)। কৃষিকার্যে ও স্থাপত্যে অনুপাৎপাদী আর্য গোষ্ঠীর আগমণ নাকি ‘ইন্দো-ইওরোপ থেকে’, যদিও এমন কোনও জায়গা নেই, এটি বৃহত্তর ভাষাগোষ্ঠীর নাম। “খাদ্যের সন্ধানে এরা ধীরে ধীরে ভারতের উত্তর-পশ্চিমে বিন্ধপর্বতের পাশ দিয়ে, মতান্তরে সিন্ধু নদীর উপত্যকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে..” এবং “সরলমতি অনার্যদের খুন-হত্যা-ধর্ষন ও সম্পদ লুন্ঠন করে দাসত্ব স্বীকার করাতে বাধ্য করে।” লোহার ব্যবহার ও ঘোড়ায় চড়া ছাড়া আর্যদের আর কোনও গুণ ছিল না এবং সেটাও তারা প্রয়োগ করত অনার্যদের খুন ধর্ষণ ও অত্যাচার করার উদ্দেশ্যে, যার ধারাবাহিকতা এখনও বহতা। অসুর সমাজে নাকি নারীর স্থান খুব উচ্চে ছিল। হরপ্পা-মহেঞ্জদারো ‘অসুরীয় সভ্যতা’ বলেও পরিচিত।
কিন্তু ‘অসুর’ ভারতীয় মূল বাসিন্দা বলেই ‘সুর’ বা এদের তত্ত্বানুসারে ‘আর্য’রা যে ভিনদেশী সেটা সাব্যস্ত হয় কী করে? এখানেই তো আমার প্রশ্ন, আর্যরা যদি বহিরাগত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কোনও সাহিত্যে কোনও বেদমন্ত্রে জম্বুদ্বীপ (বর্তমান ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল) ছাড়া আর কোনও জায়গার উল্লেখ নেই কেন? তাদের পবিত্রতম নদীগুলি যা সপ্তসিন্ধু নামে পরিচিত সেই ঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা, কাবেরী ও সিন্ধু– এইগুলি সবকটিই কেন ভারতভূমিতেই? দেবাদিদেব মহাদেব, গিরিরাজ যক্ষ, ও অন্যান্য একাধিক দেবতা ও গন্ধর্বরা কেন কৈলাস বা হিমালয়বাসী? স্বর্গের পথটাও কেন তুষারাবৃত হিমালয়ের মধ্যে দিয়েই? পতিতপাবণী গঙ্গার পৌরাণিক উৎস কেন হিমালয় পর্বতেরই অংশ কৈলাসে স্থিত শিবের জটায়? কেন তার ভৌগোলিক উৎস গঙ্গোত্রী হিমবাহও হিন্দু তীর্থ? কোথায় ইওরোপ, কোথায় মধ্যপ্রাচ্য, কোথায় অন্য কোনও দেশ বা মহাদেশের উল্লেখ? এদেশের সত্যিকারের বহিরাগতদের আসল তীর্থস্থানগুলো কিন্তু সবই মক্কা মদিনা জেরুজ়ালেম বেথলেহেম ইত্যাদি পশ্চিম এশীয় মরুদেশে। আর হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনীর সতীর একান্নটি দেহাংশও পড়েছে এই ভারতীয় উপমহাদেশেই, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক সীমানায় আবদ্ধ ভারতবর্ষ ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তিব্বত, নেপাল, মায়ানমার, চীনের অংশবিশেষ ও শ্রীলঙ্কা? পুরাণ তো প্রতীকী। তাই ত্রিভুবন কাঁপিয়ে শিব তাণ্ডব করলেও আর্যাবর্ত্যের কূপমণ্ডুক মানুষগুলো কিন্তু কল্পনাতেও বিশ্বভুবন বলতে ভারত উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডের বাইরে যেতে পারেনি। জানি না আর্যদের ভারতীয়ত্বের এর চেয়ে অকাট্য প্রমাণ আর কী হতে পারে?
উল্লিখিত দেশগুলি যে একটি সাধারণ ধর্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি দ্বারাও সংযুক্ত ছিল, এই একান্নটি শক্তিপীঠই কি তার অনস্বীকার্য প্রমাণ নয়? সবটাই গুলতাপ্পি হলে দেবীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে পীঠস্থানগুলির মধ্যে মতভেদ বা বিভ্রান্তি থাকত। তা কিন্তু নেই। কোনও দুটি পীঠে একই অঙ্গ পড়েছে বলে ধন্দ নেই। এই সুবিশাল ভূখণ্ড যে আধ্যাত্মিক চেতনায় একীভূত ছিল তা হল সনাতন হিন্দু ধর্ম, স্থানীয় জীবনযাত্রা ও জলবায়ু ভেদে কিছু রীতিনীতির পার্থক্য থাকলেও ভূমিটি ছিল প্রকৃত অর্থে হিন্দুভূমি বা হিন্দুস্থান। এই কারণেই উপজাতি বা জনজাতিদের আমি ‘আদিবাসী’ বলার পক্ষপাতী নই, কারণ ভারতভূমির আদিবাসী বা মূলনিবাসী আর্য অনার্য সবাই। উপরন্তু আর্য জিন বহন করছে আফগানিস্তান ও কাশ্মীরের আদি বাসিন্দারাও, যদিও আজ তারা ভিনদেশী ধর্ষক হামলাবাজেরই ধর্ম অনুসরণ করছে। কিন্তু কখনই আদিবাসী নয় চতুর্থ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে আগত গ্রীক বা যবনরা এবং মধ্যযুগে আসা আরব তুর্কী মোঙ্গল মুঘল ইত্যাদিরা। একমাত্র শক ও দু একটি জাতি এসে হিন্দুত্ব আপন করে এই দেশবাসীর সঙ্গে মিশে গিয়ে ভারতের মূল নিবাসীর মর্যাদা নিজগুণে আদায় করে নিয়েছে।
হুদুড় দুর্গা বনাম মাদুর্গা
এবার ফিরি মা দুর্গার কথায়। দেবী দুর্গার এই বস্ত্রহরণ ও চরিত্রহনন আয়োজনে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সূত্রানুযায়ী ব্রহ্মার আশীর্বাদে জম্ভাবসুরের ত্রিভুবন জয়ী পুত্রলাভের ভবিষ্যৎবাণী এবং দেবতাদের আক্রমণের মুখে পড়ে জম্ভাসুরের মহিষীর (স্ত্রী মহিষ) সঙ্গে সঙ্গম দ্বারা মহিষাসুর নামক পুত্রের জন্মদানের মতো বিচিত্র আষাঢ়ে গল্পকেও মান্যতা দিয়েছে এই সমাজ সংস্কারকরা। গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারির দাবি হল বিজ্ঞানের নামে হিন্দুত্ববাদী কুসংস্কার ছড়ানো, বিমান যা বর্তমানকালে বাস্তব, পৌরাণিক যুগে তার অস্তিত্ব কল্পনাও গৈরিক শিবিরের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার, বৃহন্নলা বা শিখণ্ডীর কাহিনী থেকে প্রাচীন ভারতে লিঙ্গান্তরণ চিকিৎসা বা ভগীরথের জন্ম থেকে জিন ক্লোনিং প্রযুক্তি কল্পনা হল ইতিহাস বিকৃতি। কিন্তু একই বা অনুরূপ উৎস থেকে সংগৃহীত মহিষাসুরের জন্মবৃত্তান্ত ও তার শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী যার দ্বারা আর্যদের বা হিন্দু দেবদেবীদের হীনতা সাব্যস্ত করতে পারলে, তা হয়ে যায় আদি ভারতীয় সমাজের মান্য ইতিহাস!! পশুর সঙ্গে যে বিকৃত যৌনাচারের মাধ্যমে মহিষাসুরের জন্ম, তা বাস্তবে অসম্ভব হলেও যুক্তিবাদীদের কাছে অসুর জাতির বীরত্ব ও গরিমার অকাট্য প্রমাণ!
পূর্বোক্ত সামাজিক মাধ্যমে চাউর লেখাটি “… অসুর নিধনকারী দুর্গোৎসবের আসল তাৎপর্য” নির্ধারণ করতে বসে প্রথমেই একেকটি পুরাণে একেক রকম বর্ণনার জন্য সেগুলির মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু ঋগবেদের ১.১০৮.৮ নং শ্লোক থেকে পুরু, যদু, তরুবাসা, অনু ও দ্রুহয়ু নামে যে মূল পাঁচটি আর্যগোষ্ঠীর উল্লেখ করেছে, পৌরাণিক সূত্র ধরেই দাবি করেছে সেই সবকটি গোষ্ঠীই মহিষাসুরের মতো রূপকথার রাক্ষসসদৃশ অসম্ভব প্রাণীর কাছে পরাজিত হয়েছিল। একই সঙ্গে কখনও সূত্র ছাড়া কখনও বা ডঃ মতিন মূর্মূ, ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, নলিনী রঞ্জন মুর্মু, বাজার হেমব্রম, ঐতিহাসিক ডঃ হ্যান্স মার্কেন প্রমুখ তপশিলি গবেষকের গবেষণাকে সূত্র হিসাবে খাড়া করে পেশ করেছে ‘হুদুড় দুর্গা’ নামে এক মহিষাধিপতিকে ছলনাময়ী দুর্গা দ্বারা প্রলুব্ধ করে শয়নকক্ষে নিয়ে গিয়ে গুপ্তহত্যার কাহিনী। দেবতারা হুদুড় দুর্গাকে নাকি ‘অহুর’ নাম দিয়েছিল। মারাংবুরুর কাছে গোপনে অহুর-বধের কৌশল জেনে তাকে ছলনার দ্বারা হত্যা করার পরই নাকি পাবর্তীর নাম ‘দুর্গা’ হয়।
২০১৮ সালে প্রথম এর বিরুদ্ধে কলম থুড়ি কিবোর্ড ধরতে গিয়েই বুঝেছিলাম, উপরোক্ত ন্যারেটিভের সোজা কথা হল, কোটি কোটি হিন্দু যাঁকে মাতৃরূপে পুজো করে, যুক্তিবাদ এতদিন তাঁকে কাল্পনিক নারী চরিত্র, শক্তির প্রতীক বলে ক্ষান্ত ছিল; কিন্তু বর্তমানে মূর্তিপূজা বিরোধী মুমিনীয় প্রভাবে মাদুর্গা কল্পিত নারীশক্তি থেকে ছলাকলাময়ী বেশ্যায় পর্যবসিত। মহম্মদ হেলালউদ্দিন নামের এক বাংলাদেশী একটি প্রচারপুস্তিকায় প্রচার শুরু করে, দুর্গাপূজা বাংলার মূলনিবাসীদের উৎসব নয়, এর শুরু হয়েছিল প্রধানতঃ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায়। নব্য জমিদাররা নাকি পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপূজার আয়োজন করতে আরম্ভ করেন। ‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’, ‘চেপে রাখা ইতিহাস’-এর লেখক গোলাম মোর্তাজাও শুনিয়েছে বাঙালীর প্রধান ধর্মীয় পার্বণ দুর্গাপুজোর উৎপত্তির এক কলঙ্কিত ইতিহাস ।
বর্তমানে মূর্তিপূজা বিরোধী মুমিনীয় প্রভাবে মাদুর্গা কল্পিত নারীশক্তি থেকে ছলাকলাময়ী বেশ্যায় পর্যবসিত। মহম্মদ হেলালউদ্দিন নামের এক বাংলাদেশী একটি প্রচারপুস্তিকায় প্রচার শুরু করে, দুর্গাপূজা বাংলার মূলনিবাসীদের উৎসব নয়, এর শুরু হয়েছিল প্রধানতঃ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায়। নব্য জমিদাররা নাকি পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপূজার আয়োজন করতে আরম্ভ করেন। ‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’, ‘চেপে রাখা ইতিহাস’-এর লেখক গোলাম মোর্তাজাও শুনিয়েছে বাঙালীর প্রধান ধর্মীয় পার্বণ দুর্গাপুজোর উৎপত্তির এক কলঙ্কিত ইতিহাস ।
আর এবার তো চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর হওয়া জনৈক গায়ক গোমাংসের মান রেখে স্পষ্ট লিখেই ফেললেন (ফেসবুক থেকে পরে অপসৃত), ১) আর্যরা “কৃষিকাজ না জানা বহিরাগত দস্যু” যাদের “সবকিছু কদাকার”। ২) “বিভেদের ভাষা সংস্কৃত”। ৩) মা দুর্গা মহিষাসুরের “রূপ” আর “দেহসৌষ্ঠব” দেখে “কামনায় পাগল হয়ে গিয়েছিল”। ৪) মা দুর্গা মহিষাসুরকে “বলল এই মাটিতে শোও, আমি আরোহণ করব।” ৫) মা দুর্গা মহিষাসুরের “পৌরুষের স্বাদ নিল বারবার।” ৬) মা দুর্গা “ঠুনকো প্লাস্টিকের পুতুলের মতো” আর তাঁকে যাঁরা বানিয়েছেন, অর্থাৎ দেবতারা হলেন সবাই “নপুংসক কারিগর।” ২০২০-তে এসে কুমনের কুবচনে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। কারণ তাৎক্ষণিক তিন তালাক বা হালালার মতো ন্যাক্কারজনক প্রথাকে যারা জলজ্যান্ত নারীর মানবাধিকার হরণ মনে করে না, মৃণ্ময়ী মায়ের শাড়ি সায়া ধরে টান দিতে যে তাদের বাধবে না তাতে আর আশ্চর্য কী?
জনজাতিদের সংস্করণে গল্পটা সংক্ষেপে শোনা যাক। সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোল, অসুর, কুড়মি, মাহালী, কোড়াদের নিয়ে খেরোয়াল জাতি। সেই জাতির রাজা হুদুড় দুর্গা কিস্কু বা ঘোড়াসুর সমস্ত পাহাড়, জঙ্গল, নদী ও চারণভূমির অধিপতি ছিলেন। আর্যরা বারবার তাঁর রাজ্যকে আক্রমণ করেও হুদুড় রাজার পরাক্রমের কাছে হেরে যেতে থাকে। তখন তারা এক সুন্দরী নারীকে হুদুড় দূর্গার কাছে পাঠাল। সেই যুবতী ছিল গণিকাপ্রধানা ও আর্যদের ‘হানিট্র্যাপ’। তার সৌন্দর্য্য ও ছলাকলায় মুগ্ধ হয়ে হুদুড় তাকে বিয়ে করে। নয়দিন উদ্দাম মধুচন্দ্রিমার পরে নববধূ হুদুড়কে মেরে ফেলে। বলা হচ্ছে যে এই হুদুড় দুর্গাই হলেন দেবী দুর্গার বধ্য মহিষাসুর। আর হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করার পর সেই ছলনাময়ী দেহোপজীবিনীই পরিচিত হন দেবী দুর্গা হিসেবে। আর্যরা অতঃপর নেতৃত্বহীন ভূমিপুত্রদের সুবিশাল সাম্রাজ্য দখল করে তাদের তাড়িয়ে দেয়, যার ফলে তারা পালিয়ে বেড়াতে থাকে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বাংলা ও ছত্তিশগড়ের পাহাড়ে জঙ্গলে। সেই ধাক্কা ও শোক আজও ভূমিপুত্ররা বা মূলনিবাসীরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই নাকি আদ্যিকাল থেকে প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময় দুর্গাসপ্তমীর দিন থেকে শোকের প্রতীক হিসাবে ‘দাঁশাই’ বা ‘ভুয়াং’’ নাচের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় মধ্য ভারতের আদিবাসীদের শোকার্ত পদযাত্রা, যার দ্বারা মহিষাসুরের হত্যা ও তার ফলে আদিবাসীদের ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়নের করুণ ইতিহাস স্মরণ করা হয়।
এবার এই উপাখ্যান ও তত্ত্বের একটু ময়না তদন্ত করি। স্বীকার করি, সূত্রগুলো পেয়েছি মূলত ঋতুপর্ণ বসুর রচনা থেকে।*
প্রথমত, মহিষাসুরের পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় দেবী ভাগবত, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ ও কালিকাপু্রাণে। ব্রহ্মার পুত্র মরীচি, মরীচির পুত্র কশ্যপ এক বিখ্যাত মুনি। এই কশ্যপমুনির পুত্র রম্ভ যার পুত্র অর্থাৎ কশ্যপের পৌত্র হল মহিষ। মহিষ শিবের পরম উপাসক। তবে সে অনার্য কোথায় হল? শিব যদি হরপ্পা সভ্যতার অবদান হয়েও থাকে, পুরাণ রচনাকালে তো তাঁর বৈদিক দেবতাদের আসনে সসম্মানে অভিষেক হয়ে গেছে। বেদে অসুর ও দেব – দুটি শব্দের অর্থই শুভ। ‘দেব’ মানে যেখানে দীপ্তিমান বা প্রকাশমান, সেখানে ‘অসুর’ অর্থ প্রাণবান। ব্রহ্মার পৌত্র কশ্যপের দুই স্ত্রী দিতি ও অদিতি। দিতি হলে দৈত্য বা অসুরদের আদি জননী, আর অদিতি হলেন দেবতাদের আদি জননী। লক্ষ্যণীয় দেব ও অসুর উভয়কুলই কিন্তু মাতৃপরিচয় অনুযায়ী বংশ লাভ করেছে, যা আধুনিক নৃতাত্ত্বিক ও জিনবিজ্ঞানীদের জিন ম্যাপিং করে সব মানুষের আদি মাতা ‘মাইকন্ড্রিয়াল ইভ’ আবিষ্কার করার অনুরূপ। সেই বিশদে যাচ্ছি না। আপাতত যেটুকু জানানোর তা হল, ঋগ্বেদে ইন্দ্র, বরুণ ও রুদ্রকেও অসুর মহস বলা হয়েছে। “ত্বম অগ্ৰে রুদ্র অসুরঃ মহস দিবঃ।।”(ঋগ্বেদ ২-১-৬)। ঋগ্বেদেই আছে দেব ও অসুর দুজনেই উপাসনা দ্বারা সৌমনস (জ্ঞান) লাভ করছেন। “যক্ষা মহে সৌমনসায় রুদ্রম।/ নমোভির্ দেবং অসুরং দুবস্য।।” (ঋগ্বেদ ৫-৪২- ১১)।* এগুলো কি অসুরের অনার্য হওয়ার প্রমাণ?
মহিষাসুরের পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় দেবী ভাগবত, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ ও কালিকাপু্রাণে। ব্রহ্মার পুত্র মরীচি, মরীচির পুত্র কশ্যপ এক বিখ্যাত মুনি। এই কশ্যপমুনির পুত্র রম্ভ যার পুত্র অর্থাৎ কশ্যপের পৌত্র হল মহিষ। মহিষ শিবের পরম উপাসক। তবে সে অনার্য কোথায় হল?
কাজেই ‘পৌরাণিক অসুর’ আর ‘উপজাতীয় অসুর’ এক নয়। চিরাচরিত ও মূল দুর্গাপুজো হয় বসন্তকালে। তাই একে বাসন্তীপুজোও বলা হয়। আরেক নাম ‘অন্নপূর্ণা পূজা’। প্রচার চলছে ট্র্যাজিক নায়ক হুদুড় দুর্গাকে নাকি আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে দুর্গাপুজোর সময় স্মরণ করে আসছে। কিন্তু বাংলায় দুর্গাপুজা ব্যাপারটাই তো অকালবোধন যার প্রচলন খুব বেশিদিনের নয়। এই শিবিরের দোসররাই তো বাঙালীর দুর্গা পুজো সূচনার কৃতিত্ব ব্রিটিশ শাসনকে দিতে চায়। তাহলে তার আগে কোথায় ছিলেন হুদুড় দুর্গা? পুরাণে দেবতাদের দোষেগুণেই চিত্রায়িত করা হয়েছে, কিন্তু তাঁদের বহিরাগত হওয়ার কোনও প্রমাণ নেই।
দ্বিতীয়ত, সাঁওতালী ভাষায় ‘হুদুড়’ বা ‘হুদুর’ শব্দের অর্থ মেঘের গর্জন বা বাজের শব্দ। সাঁওতালী লোককথাতে এক বিশাল প্রতাপশালী ও প্রজাদরদী রাজার উল্লেখ আছে। কিন্ত তিনিই হুদুড় দুর্গা বা মাদুর্গা দ্বারা নিহত মহিষাসুর, এমন কোথাও উল্লেখ নেই। দাঁশায়, সোহরাই, কারাম, লাগড়ে, দং-এর মত লৌকিক পরম্পরার মধ্যে আর্য-অনার্য সংঘাত ঢুকিয়ে দেওয়া নিয়ে বৃদ্ধ সাঁওতালদেরও অনেকেই ক্ষুব্ধ। তারা নিজেদের বলে ‘খুৎকাঠিদার’ যারা দুর্গম ও কৃষিকাজের অযোগ্য ভূমিকেও কঠোর পরিশ্রমে চাষের উপযোগী করে তুলেছিল। যুগ যুগ করে প্রকৃতি উপাসক এই হড় (সাঁওতাল) জাতির সৃষ্টিতত্ত্বে আছে ‘পিলচু হড়াম’ আর ‘পিলচু বুড়ি’র কাহিনী। হুদুড় দুর্গার উপাসনা ছিল না।*
তৃতীয়ত, আশ্বিন মাসকে সাঁওতালরা বলে দাঁশায় মাস। দুর্গাপুজোর সময় সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে পুরুষরা নারীবেশে সজ্জিত হয়ে এক গ্ৰাম থেকে অন্য গ্ৰামে দাঁশায় নাচ নেচে বেড়ায়। তাঁদের হাতে থাকে লাউয়ের খোল দিয়ে বানানো ভূয়াং নামে এক বাদ্যযন্ত্র। এই দাঁশায় সম্পূর্ণরূপে কৃষিভিত্তিক পরব ও প্রকৃতিবন্দনার উৎসব। ইদানিং এটিকেই হুদুড় দুর্গার কাহিনীর সাথে জুড়ে নাকি আদিম জনজাতির পক্ষে শোকপালনের উপলক্ষ্য করে তোলা হয়েছে। নিজেদের মহান রাজা ও দেশ হারানোর ব্যাথা নিয়ে আদিবাসীরা পিতৃপুরুষের স্মরণেই নাকি ‘হায় রে, হায় রে’ করতে করতে নারীর বেশে গ্ৰাম প্রদক্ষিণ করে। অথচ গানে ‘হায়রে হায়রে’ ধ্বনি দেওয়া হয় জলের জন্য প্রকৃতির কাছে আর্তি থেকে। পূজার সময় নাকে, নাভিতে, বুকে করঞ্জার তেল লাগাতে হয়, কারণ ওই জায়গাগুলি থেকেই মহিষাসুরের রক্তক্ষরণ হয়েছিল। আগে যেখানে কুড়মি মাহাতোরা গড়ামথানে মাটির হাতি ঘোড়া রেখে দিত, সেখানে ইদানিং মহিষাসুরের মূর্তি গড়ে হাতজোড় করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নতুন রীতি চালু হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুজোর ক’দিন দুয়োর এঁটে শোকপালন করার প্রবণতাও চালু হয়েছে।*
চতুর্থত, আদ্যপান্ত কৃষি উৎসব সোহরাই পরবেও মহিষাসুরের অনুষঙ্গ ঢোকানো হচ্ছে। অথচ সেখানে গো-বন্দনাই মূল উপজীব্য। সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা অনেকেই সিংহবাহিনীর মন্দিরে পুজো দেয়, স্কুলের সরস্বতী পূজোতেও শামিল হয়। আবার সোৎসাহে বড় বাঁধনা, ছোট বাঁধনা পরবেও মেতে ওঠে। কিন্তু এই ব্যাপারটাই আদিবাসী জাতিসত্ত্বার নবীন রক্ষকদের অপছন্দ। এরাই হুদুড়ের প্রবক্তা।
পঞ্চমত, হুদুড় দুর্গার সপক্ষে ঐতিহাসিক সমাজবৈজ্ঞানিক বা নৃতাত্ত্বিক – কোনও প্রমাণই পাওয়া যায় না। আদিবাসী অঞ্চলে যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন, সেইসব বিশেষজ্ঞরাও কোনও সুত্র দিতে পারেননি। ১৯২১ সালে শরৎচন্দ্র দে লেখেন ‘Mundas and their Country’ যাতে হুদুড় দুর্গার কোনও উল্লেখ নেই। ১৯২৮ সালে John Baptist Hoffman রচিত পনেরো খণ্ডের ‘Encyclopedia Mundarica’ গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়, যেখানে মুন্ডা জনজাতির সামাজিক নিয়ম, রূপকথা, কিংবদন্তী, ভূতপ্রেত, সৃষ্টিতত্ত্ব, ওঝা, পরব ইত্যাদি প্রায় সবটাই ধরা আছে লেখকের অক্লান্ত পরিশ্রমে। সেখানেও এই হুদুড় দুর্গার কাহিনী নেই। নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক K. K. Leuva ছিলেন রাঁচীর Assistant Commissioner of Scheduled Castes and Scheduled Tribes। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফল The Asur – A study of Primitive Iron Smelters. সেখানে কোথায় এই হুদুড় দুর্গার কাহিনী?*
হুদুড় দুর্গার সপক্ষে ঐতিহাসিক সমাজবৈজ্ঞানিক বা নৃতাত্ত্বিক – কোনও প্রমাণই পাওয়া যায় না। আদিবাসী অঞ্চলে যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন, সেইসব বিশেষজ্ঞরাও কোনও সুত্র দিতে পারেননি। ১৯২১ সালে শরৎচন্দ্র দে লেখেন ‘MUNDAS AND THEIR COUNTRY’ যাতে হুদুড় দুর্গার কোনও উল্লেখ নেই। ১৯২৮ সালে JOHN BAPTIST HOFFMAN রচিত পনেরো খণ্ডের ‘ENCYCLOPEDIA MUNDARICA’ গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়, যেখানে মুন্ডা জনজাতির সামাজিক নিয়ম, রূপকথা, কিংবদন্তী, ভূতপ্রেত, সৃষ্টিতত্ত্ব, ওঝা, পরব ইত্যাদি প্রায় সবটাই ধরা আছে লেখকের অক্লান্ত পরিশ্রমে। সেখানেও এই হুদুড় দুর্গার কাহিনী নেই। নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক K. K. LEUVA ছিলেন রাঁচীর ASSISTANT COMMISSIONER OF SCHEDULED CASTES AND SCHEDULED TRIBES। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফল THE ASUR – A STUDY OF PRIMITIVE IRON SMELTERS. সেখানে কোথায় এই হুদুড় দুর্গার কাহিনী?
এছাড়া রয়েছে ‘Bulletin of Bihar Tribal Research Institute’ (1964), নর্মদেশ্বর প্রসাদের ‘Tribal people of Bihar’ (1961), K. S. Singh-এর ‘Tribes of India’ (1994), J. M. Kujur-এর ‘Asurs and their Dancers’ (1996) এইসব অতি বিশদ বইগুলিতেও হুদুড় দুর্গা নিরুদ্দেশ। নাদিম হাসনাইনের “Tribal India” বইটি ভারতীয় জনজাতিদের বিষয়ে একটি আকরগ্ৰন্থ। সেখানে অসুরসহ বিভিন্ন উপজাতি ও তাদের সংস্কৃতির বিস্তারিত বিবরণ আছে। সেখানে ঘুনাক্ষরেও উচ্চারিত হয়নি এই হুদুড় দুর্গা।*
এইসব সুত্রগুলি থেকে জানা যায়, অস্ট্রো-এশিয়াটিক অসুর গোষ্ঠীকে দেখা যায় ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায়। এই অসুরদের মধ্যে তিনটি উপশাখা– বীর অসুর, বীরজা অসুর, আগারী অসুর। এই অসুররা ‘লোহাপাথর’ দেখলেই চিনতে পারে। একসময় এরা অতুলনীয় দক্ষতায় নিজস্ব লোকপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পাথর থেকে লোহা গলিয়ে নিষ্কাষণ করাতে এবং নানারকমের আয়ুধ ও যন্ত্রপাতি বানাতে সিদ্ধহস্ত ছিল। মনে করা হয়, মৌর্য সাম্রাজ্যের সাফল্যের পেছনে তাদের তৈরী লোহার অস্ত্র ও যন্ত্র একটি বড় ভূমিকা ছিল। তাদের উৎপাদিত লোহার সামগ্ৰীতে জং ধরত না। কিন্তু ১৯০৭ সালে তাদের বিচরণভূমির ওপরেই টাটা স্টীল কারখানা গড়ে ওঠার পর ব্লাস্ট ফার্নেস পদ্ধতির ব্যাপক উৎপাদনের কাছে তাদের প্রযুক্তি মার খায়। এখন তারা তাদের বংশপরম্পরায় চলে আসা দ্রব্যজ্ঞান ও দক্ষতা প্রায় ভুলেই গেছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে অসুর জনজাতির সংখ্যা প্রায় ৩৩,০০০। পশ্চিমবঙ্গে ৪৯৮৭, ঝাড়খণ্ডে ২২,৪৫৯ ও বিহারে ৪১২৯। এদের ‘আসুরী’ ভাষা মুন্ডারী উপভাষার মধ্যে গণ্য। কিন্তু এটি বলার লোক এখন বিরল।*
জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা বাগানের ১০১টি অসুর পরিবারের মধ্যে ৯০টি পরিবারই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেছে মিশনারীদের লাগাতার প্রচেষ্টায়। এছাড়া অসুর উপজাতিদের দেখা মেলে ডুয়ার্সের বানারহাট, চালসা ইত্যাদি জায়গায়। এরা নিজেরা অবশ্য বলে তারা ঝাড়খণ্ডের গুমলা ও লোহারডাগা থেকে এসেছে, আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এদের বংশের আদিপুরুষ হলেন মহিষাসুর।*
কান্যকুব্জের ব্রাহ্মণদের একটি শাখা দাবি করে রাবণ তাদের পূর্বপুরুষ। যাদবরা মনে করেন তাঁরা কৃষ্ণের বংশধর। হিমাচল প্রদেশে আবার দূর্যোধনের মন্দির আছে, যেখানে কিছু স্থানীয় মানুষ মহাভারতের এই খলনায়ককেও রীতিমতো পুজো করে।* বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী পুরাণ ও কিংবদন্তীর সঙ্গে নিজেদের জুড়তে চায়। মুশকিল হয় যখন সেইসূত্রে কিছু অসৎ লোক অর্বাচীন quasi academic তত্ত্ব নির্মাণ করে সরল মানুষদের জাতিসত্ত্বার নাম করে মূলস্রোতের বিরুদ্ধে উসকে দেয়।
ষষ্ঠত, আদিবাসী গবেষকদের একাংশই এর দুরভিসন্ধি সামনে এনেছেন। আদিবাসী সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষকের লেখক মৃদুলকান্তি ঘোষ এই বিষয়ে কলম ধরেছেন কৃষিকথা পত্রিকায়:*
“দাঁশায় উৎসব সম্পূর্ণরূপে কৃষিভিত্তিক ও প্রকৃতি বন্দনার উৎসব। অনেকে এটাকে যুদ্ধের কাহিনী বা হুদুড় দুর্গা কিস্কুর লড়াইয়ের কাহিনী বলে প্রচার করে। সেটা ইচ্ছাকৃত না অজ্ঞতার কারণে– আমার জানা নেই। কিছু প্রচারপ্রিয় বাঙালী তাতে উৎসাহ জোগাচ্ছে – মহিষাসুরকে কখনও অসুরদের রাজা, কখনও সাঁওতালদের রাজা বলে দাবী করছে। মাত্র দু একটা লাইন যেখান সেখান থেকে জুড়ে দিয়ে নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে। “দাঁশায়” অর্থ দাঃ + আঁশ + আয়, (কারো কারো মতে দাঃ + সাঁওহায়)। “ইতিহাসের খোঁজে নয় জলের আশায় প্রকৃতি দেবীকে পুজা করাই দাঁশায়ের মুল উদ্দেশ্য ছিল।”
“দাঁশায় উৎসব সম্পূর্ণরূপে কৃষিভিত্তিক ও প্রকৃতি বন্দনার উৎসব। অনেকে এটাকে যুদ্ধের কাহিনী বা হুদুড় দুর্গা কিস্কুর লড়াইয়ের কাহিনী বলে প্রচার করে। সেটা ইচ্ছাকৃত না অজ্ঞতার কারণে– আমার জানা নেই। কিছু প্রচারপ্রিয় বাঙালী তাতে উৎসাহ জোগাচ্ছে – মহিষাসুরকে কখনও অসুরদের রাজা, কখনও সাঁওতালদের রাজা বলে দাবী করছে। মাত্র দু একটা লাইন যেখান সেখান থেকে জুড়ে দিয়ে নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে। “দাঁশায়” অর্থ দাঃ + আঁশ + আয়, (কারো কারো মতে দাঃ + সাঁওহায়)। “ইতিহাসের খোঁজে নয় জলের আশায় প্রকৃতি দেবীকে পুজো করাই দাঁশায়ের মুল উদ্দেশ্য ছিল।”
আর হুদুড় বা হুডুর শব্দটা মেঘ বা মেঘমন্দ্র শব্দের তুল্য। দাঁশায় উৎসবের প্রথম গানটা শুনলেই তা সহজে বোঝা যায়। আর ‘হায়রে হায়রে’ করাটাও জলের জন্য দেবী দুর্গার কাছেই আর্তি, নেতৃত্বহীন হওয়ার শোক প্রকাশ নয়।
হায়রে হায়রে দিবি দুর্গা দয় ওডোক এনা রে/ আয়নম কাজল দকিন বাহের এনা রে/ হায়রে হায়রে চেতে লাগিদ দয় ওডোক এনা রে/ চেতে লাগিদ দ কিন বাহের এনা রে/ হায়রে হায়রে দেশ লাগিদ দয় ওডোক এনা রে/ দিশম লাগিদ দ কিন বাহের এনা রে/ হায়রে হায়রে সুনুম সিঁদুর লাগিদ ওডোক এনা রে/ বাহা টুসৗ লাগিদ দ কিন বাহের এনা রে/ হায়রে হায়রে দেলা সে দিবি দুর্গা হয় লেকাতে/ দেলাসে আয়নম কাজল বার্ডু লেকাতে/ হায়রে হায়রে অটাং হিজু পেসে সেরমা সাগিন খন/ ঘুরলাউ হিজু: পেসে সরগ পুরী খন/ বঠেল বঠেল সেকরেজ সেকরেজ।
অর্থাৎ, দেবী দুর্গা বাহির হলো, আয়নম, কাজল (আয়নম ও কাজল দেবীর সহচর, লক্ষ্মী, সরস্বতীর প্রতিরূপ ও বলা যেতে পারে) বাইরে এল, দেশের জন্য, দিশমের জন্য এবং সিঁদুর-তেল-পুষ্পের জন্য। অর্থাৎ পূজা পাবার জন্য এরা বাহির হলো, এসো দুর্গা বাতাস হয়ে, এসো আয়নম কাজল ঘুর্ণি হয়ে সুদূর মহাকাশের স্বর্গপুরী থেকে। এটা দেবী আবাহনও বলা যেতে পারে। এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে দেবী বন্দনা বা পুজো করার ফলে ভালো বৃষ্টি হয়েছিল- তাই “বঠেল বঠেল” আনন্দসূচক ধ্বনি প্রয়োগ হয়েছে।
কিন্তু মহিষাসুরবাদীদের উপমায় গানের অংশবিশেষ তুলে অপব্যাখ্যা করা হয়।
হায়রে হায়রে/চেতে লাগিদ ভুয়ৗং এম জানাম লেনা রে/ চেতে লাগিদ ভুয়ৗং এম হারা লেনা রে/ দেশ দাড়ান লাগিদ ভুয়ৗং এম জানাম লেনা রে/ দিশম সাগাড লাগিদ ভুয়ৗং এম জানাম লেনা রে।
এই লাইনগুলোর মানে করা হয় যেন দেশ রক্ষার জন্য লড়াইয়ের ডাক দিতেই ভুয়ৗং। কিন্তু আসলে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করার উদ্দেশ্যে দেশ বা দিশম পরিভ্রমণ বোঝানো হয়েছে, যেহেতু ঠাকুর দেবতাদের মাহাত্ম্য প্রচার করলে মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় বলে একটা বিশ্বাস আছে। কিন্তু পরের লাইনটা যে ইচ্ছা করে উহ্য থাকে তা হল –
সুনুমে সিঁদুর লাগিদ ভুয়ৗং এম জানাম লেনা রে/ বাহা টুসৗ লাগিদ ভুয়ৗং এম হারা লেনা রে
পুরোটার শব্দার্থ হল: কেন ভুয়ৗং জন্ম নিয়ে ছিলে/কেন ভুয়ৗং বেড়ে উঠেছিলে/ দেশ ঘোরার জন্য ভুয়ৗং জন্ম নিয়েছিলে/ দিশম ভ্রমণ করার জন্য ভুয়ৗং বেড়ে উঠেছিলে/ তেল সিঁদুর পাওয়ার জন্য ভুয়ৗং জন্ম নিয়েছিলে/ পুস্প স্তবক পাওয়ার জন্য ভুয়ৗং বেড়ে উঠেছিলে। আর দাবি করা হয়, ভুয়ৗং নাকি তীর রাখার আধার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভুয়ৗং হল ভূমির প্রতীক, আর ছিলার মতো ব্যবহৃত রুজুটাকে বলে তড়ে সূতাম।
তাগিঞ মেসে ভায়রো তাগিঞ মেসে হো/ ভুয়ৗং ডান্টিজ ভায়রো রচদ আকান তিঞ/ তড়ে সুতৗম ভায়রো তপা: আকান তিঞ।
আর একটা ভুল ব্যাখ্যা করে ‘হুদুড়রে’, ‘দুর্গারে’ শব্দের, যেন হুদুড় আর দুর্গা শব্দটা আলাদা বোঝায় | যদি কোন গানে থাকেও, ওটা দ্বিত্ব সম্বোধন অর্থে ব্যবহৃত শব্দ। যেমন “মাণিকরে সোনারে” অথবা “সোনা অমার মানিক অমার” একই সন্তানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কোথায় মহিষাসুর? এখানে তো প্রকৃতি দেবী বা দেবী দুর্গারই বন্দনা করা হচ্ছে। এটাই প্রকৃত সত্য।’”
[কৃষিকথা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭]*
হুদুড় দুর্গার জন্ম
২০০৩ সালে প্রথম এই বাংলারই বুকে পুরুলিয়ার ভুলুরডিতে হুদুড় দুর্গাকে নিয়ে প্রথম অনুষ্ঠান হয় ২০০৩ সালে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পা রাখে হুদুড় দুর্গা। ২০১০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় হুদুড় দুর্গা নিয়ে আর্যভট্ট খানের একটি বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আরও আলোকিত হয়। ২০১১ সালে কাশীপুর থানার সোনাইজুড়ি গ্ৰামে বেশ বড় করে ‘হুদুড় দুর্গা স্মরণ দিবস’ অনুষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তা “দিশম খেরওয়াল বীর কালচার” কমিটি। অমিত হেমব্রম ও চারিয়ান মাহাতো ছিলেন অন্যতম সংগঠক। এরপর থেকে বাংলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে প্রতিবছর শারদোৎসবে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুর স্মরণ উৎসব। এই উপলক্ষ্যে পাতা সেলাই, ছোট ছেলেমেয়েদের বিস্কুট দৌড়, সূঁচে সূতো পরানো, ফুটবল ম্যাচ, স্লো সাইকেল রেস ইত্যাদি ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। হয় দাঁশাই, সাড়পা ও কাঠি নাচের আয়োজন। বহু ক্ষেত্রে দুর্গামন্ডপের দুশো মিটারের মধ্যেই চলে হুদুড় দুর্গা নিয়ে জমকালো অনুষ্ঠান। আর সাধারণ মানুষ তলিয়ে না ভেবে দুটিতেই শামিল হয়েছে।*
অসুর সম্প্রদায় একটি প্রাচীন জনজাতি হলেও লক্ষ্যণীয়, তাদের নিয়ে আলোচনা বিগত ৬-৭ বছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে একটি অসুর রমণীর নিরলস উদ্যোগ। ঝাড়খণ্ডের সাখুয়াপানির সুষমা অসুর একজন অসুর অ্যাকটিভিস্ট। গড়ে তুলেছেন “ঝাড়খণ্ডী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি আখড়া” যার উদ্দেশ্য প্রান্তিক ও মৃতপ্রায় উপজাতি সংস্কৃতি ও ভাষার চর্চা ও সংরক্ষণ। ওই প্রত্যন্ত গ্ৰামগুলিতে অসুর ভাষায় একটি গোষ্ঠীর রেডিও সার্ভিসের প্রধান চালিকাশক্তি সুষমা। দিল্লির ‘Indian Language Festival’-এ তাঁর রচিত “অসুর সিরিং” বেশ সমাদৃত হয়েছিল। ফেসবুকে “Asur Adibasi Documentation Centre” নামে একটি পেজ চালান সুষমা ও তাঁর অনুগামীরা। সেখানে একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে কলকাতা, পাটনা ও রাঁচীতে চলে আসা দুর্গোৎসব বন্ধ করে দেবার আবেদন করছেন তিনি। সুষমার সাথে যোগ আছে শহুরে র্যাডিকাল বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী, গ্ৰুপ থিয়েটার, লিটল ম্যাগের তথাকথিত প্রগতিশীলদের।*
২০১৩ সালের ১৭ই অক্টোবর দিল্লীর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ক্যাম্পাসের SSS-1 প্রেক্ষাগৃহে “মহিষাসুর শাহাদাত দিবস” পালন করে। অনুষ্ঠানটির আহ্বায়ক ছিল All India Backward Students Forum। সেই উৎসবের প্রস্তাবনায় বলা হয়, দুর্গা কোনও নারীশক্তির প্রকাশ নয়। দুর্গা ও তার আখ্যান হল আরও একটা ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রকল্প, যার মজ্জায় মজ্জায় মিশে আছে পুরুষতন্ত্র। “Durga Puja is the most controversial racial festival, where a fair skinned beautiful Goddess is depicted brutally killing a dark skinned native called Mahishashura.” আর মহিষাসুর কোনও অশুভ শক্তির প্রতীক নন, তিনি শহীদ। দুর্গোৎসব হল আদিবাসী গণহত্যার উদযাপন। এটি অবিলম্বে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। “The festival is a celebration of genocide of natives. ….. It’s a celebration of murder unlike in any other religion. …. It must be banned.” দেবী দুর্গা হলেন দেবতাদের ভাড়া করা এক যৌনকর্মী। “They hired a sex – worker called Durga, who enticed Mahishashura into marriage and killed him after nine nights of honeymooning, during sleep.” (Pamphlet by AIBSF, Mahishashur Martyrdom Day, 17th October, 2013)*
২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সালে বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানী সংসদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এই বিতর্কিত প্রচারপুস্তিকাটির অংশবিশেষ সংসদে পড়েও শোনান তিনি। ২০১৩ সালে জে.এন.ইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত অসুর নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন প্রচারের ফসল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দলিত আ্যকাডেমিশিয়ান কাঞ্চা এলাইয়া, যিনি Christian Solidarity Network এর সাথে যুক্ত। আম্বেদকরবাদী বামসেফ পার্টির বামন মেশরাম বক্তা ছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। তাঁর প্রচুর বক্তৃতা আছে ইউটিউবে। একটি ভিডিওতে শোনা যায় তিনি রামচন্দ্রকে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির ছেলে বলছেন। এই রামচন্দ্রই নাকি ইতিহাসের পূষ্যমিত্র শুঙ্গ। আবার উনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবা ফুলের বিখ্যাত বই ‘গোলামগিরি’-তেও আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের লড়াইয়ের কল্পকাহিনী। দলিতরা নাকি অসুরদেরই বংশধর। রাক্ষস, অসুর এরাই মেহনতী মানুষের প্রতিনিধি। দক্ষিণের পেরিয়ারের চোখে রাবণই নায়ক। জোর করে আর্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার প্রতিবাদে দ্রাবিড় কাজাঘাম শ্রীরামচন্দ্রের ছবি ও মূর্তিতে জুতোর মালা পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাত।*
অবদান আছে সাঁওতাল খেরোয়াল সমাজকর্মী একটিভিস্ট অজিত হেমব্রমেরও যিনি ২০১৬ সাল থেকেই ‘হুদুড় দুর্গা স্মরণ উৎসব’-এর প্রধান সংগঠক। “আয়নানগর” পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ; “আমাদের একটি প্রধান উৎসব হলো দশানি। এটাকে দুঃখ উদযাপনের দিন বলা যেতে পারে। কেননা এই দিনে আমরা আমাদের সবকিছু হারিয়েছি। প্রাচীন কালে খেরোয়ালদের একজন মহান নেতা ছিলেন। যিনি বিদেশি আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তাকে বিদেশিরা নানা ছলাকলায় যুদ্ধে পরাজিত করে। আমরা তার মতো এমন নেতৃত্ব আর পাইনি। তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি এবং হুদুড় দুর্গা বলে ডাকি। দশানি তার স্মরণেই পালন করা হয়ে থাকে।” “যখন ঝাড়খণ্ড আন্দোলন এবং আদিবাসী ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যখন যুক্ত হয়েছি তখন থেকে আমরা আমাদের আত্ম পরিচয় নিয়ে সচেতন হতে শুরু করেছি। আমরা জানতে পারি যে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী আমরা আসলে হিন্দু নই। আমাদের পূর্বপুরুষদের হিন্দুরা অসুর, দানব এবং রাক্ষস বলেই জানে। ২০১১ সালের দিকে বিজেপি ক্ষমতা আসার পূর্বে বাবা রামদেব ঘোষণা দিয়েছিলেন ভারতবর্ষকে পুনরায় তিনি রামরাজ্য, কৃষ্ণরাজ্যে পরিণত করতে চান। যখন আমি টিভিতে বাবা রামদেবের নির্বাচনী প্রচারণা দেখছিলাম, তখন মনে হলো যদি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে খুব দ্রুত আমাদের জাতিসত্তা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে বিজেপি আবার ক্ষমতায় চলে আসে। তখনো আমি এ রকমভাবে এই উৎসব উদযাপনের কথা চিন্তা করিনি। আমাদের গ্রামে নানা উপজাতি এবং সম্প্রদায়ের লোকজন আছে। আমরা সাঁওতালরা হিন্দুদের মন্দিরে কখনো যাই না। আমরা তাদের রীতিনীতিও অনুসরণ করি না। কিন্তু আমাদের স্ত্রীরা দুর্গাপূজা করেন। তবে সেদিন আমি বাড়িতেই থাকি এবং আমার কাছে এই বিষয়গুলো ভেবে অদ্ভুত লাগে। আসলে আমাদের লোকজন তাদের আত্মপরিচয় এবং ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। যারা অল্প বিস্তর জানে, তারাও দেখা যায় অন্যান্যদের মধ্যে সেটির কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। আমি একটা উপায় খুঁজছিলাম। অনেক আগে পরিমল হেমব্রমের লেখা একটি বই পড়ে মহিষাসুর সম্পর্কে জানতে পারি যে, মূলত দুর্গা ছিলেন আর্য শক্তি। তারপরেই আমি এই উৎসবটির কথা ভাবি। মূলত অসুর এবং দেবতা কী? ইতিহাসের কোথায় তারা মিথ্যে কথা বলেছে? অসুর এবং দেবতার বংশধর কিন্তু এখনও রয়েছে। তাহলে তারা কারা? আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারিনি। এই দশানি আমাদের ইতিহাসকে জানার একটি বড় উপায় তাই আমি এটি শুরু করি।” (আয়নানগর, ২০শে মে, ২০২০) এঁর বক্তব্যেই পরিষ্কার হুদুড় দুর্গা উপজাতি সত্তা তৈরির প্রয়াসে একটি নির্মিত চরিত্র।
বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় মূর্মু ৬ই অক্টোবর, ২০১৯ সালে বাঁকুড়ার রায়পুর সবুজ বাজারের সিধু কানু মোড়ে “রায়পুর হুদুড় দুর্গা” স্মরণসভা কমিটির অনুষ্ঠানে বললেন “এটা মামুলি ব্যাপার নয়। এটা জাতিসত্ত্বার ব্যাপার। এটা নিজস্ব কালচারে উদ্ধুদ্ধ হবার একটা নিশানা। …. ইতিহাসটা আর্যরা লিখেছেন, তাদের পক্ষে। আর্যরা সেদিন সামনে আনতে দেননি, রামচন্দ্র কেন শম্বুককে হত্যা করেছিল। আপনারা সামনে আনতে দেননি একলব্যের আঙুল কাটা হয়েছিল কেন?” । উপস্থিত ছিলেন রায়পুর বিধানসভার বিধায়ক বীরেন্দ্রনাথ টুডু, ভারত জাকাত মাঝি পরগণা মহলের বাঁকুড়া জেলার বিপ্লব সরেন। (সারসগুন পত্রিকা, ৮ই অক্টোবর, ২০১৯)*। ২০১৭ সালে খোদ কলকাতার কাছে গড়িয়ায় প্রকৃতি সেবাশ্রম সংঘ নামে একটি সংগঠন আয়োজন করেছিল মহিষাসুর স্মরণ দিবস।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ২০১৩-১৪ সালেও রাঁচি শহরের অদূরে রাতুর রাজবাড়িতে আদিবাসীদের দুর্গাপুজো দেখেছি। একটা নির্ভেজাল বন্য গন্ধ ছাড়া মা দুর্গাকে অসম্মান করে অসুর নিয়ে আদিখ্যেতার কোনও আয়োজন তো চোখে পড়েনি। এবার থেকে হয়তো পড়বে – অসুরের প্রতি তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী অর্থাৎ দেশ ও মানবতার গুপ্ত শত্রুদের বিশেষ পক্ষপাতের কারণে নব্য অসুরপুজোর কাল্ট ক্রমশ যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে! এর প্রচার ও প্রসারের জন্য অসুর অ্যাকটিভিস্ট সুষমাকে সারা দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। বর্তমানে ভারতের প্রায় ৫০০ টি জায়গায় ঐ মহিষাসুর স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। ওরা চাইছেন ব্রাহ্মণ্যবাদের কাউন্টার ন্যারেটিভ হিসাবে অসুর স্মরণ অনুষ্ঠানকে আরও তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে দিতে।
অসুরপন্থীদের বৃহত্তর লক্ষ্য হল জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে ভারতের বুকে ছোট ছোট স্বাধীন সার্বভৌম কনফেডারেশন গড়ে তোলা। যে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ, তার চেয়েও কদর্য পুরুষতন্ত্র কিন্তু উত্তরপূর্ব ভারত ছাড়া এইসব অসুরপন্থী জনজাতি সমাজেই বিদ্যমান। জানগুরুর আদেশে ডাইনি সন্দেহে হত্যা বা বিষ্ঠা খাওয়ানো কি নারীর মর্যাদার প্রতীক? নাকি পুত্র সন্তান না থাকলে পুরুষের সম্পত্তি নিজের স্ত্রী বা কন্যার বদলে অন্য পুরুষ আত্মীয়কে দিয়ে দেওয়ার নাম নারীপ্রাধান্য? নাকি চিরাচরিত প্রথানুসারে বিয়ের প্রথম বছরটা টানা নির্যাতন সহ্য করার পরীক্ষার নাম মাতৃতন্ত্র? এই সবকটি রীতিই কিন্তু সাঁওতাল সমাজের ঐতিহ্য। বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা শুধু তাদের হাড়িয়া পান করে নাচা ও তুলনায় মুক্ত যৌনতা দেখেই নারী স্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা আবিষ্কার করে ফেলেছে। অসুরকে মহাপুরুষ আর দুর্গাকে বেশ্যা প্রমাণ করতে গিয়েও নিজেদের সমাজের চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিকতাকেই মূল স্রোতের সমাজে বহমান অন্তঃসলিলা নারীশক্তির জয়গানের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিকতার চেয়ে এটি আরও ভয়াবহ হতে পারে, কারণ প্রথমটির সংস্কার সাধন সম্ভব, কিন্তু দ্বিতীয়টি অনমনীয় যা নানা ন্যারেটিভের ছদ্মবেশে নিরবিচ্ছিন্ন প্রবহমান।
আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টানদের যা আধিপত্য, তাতে এই জাতীয় তত্ত্বের অন্যতম অনুপ্রেরণা যে খ্রিস্টান মিশনারিরা হতে পারে, সে বিষয়ে একটা সন্দেহ ছিলই। জেএনইউ চত্বরের অনুষ্ঠানে কাঞ্চা এলাইয়ার উপস্থিতি সম্পর্কে জানার পর সেটা প্রত্যয়ে পরিণত হল। সারা দেশ জুড়েই জেহাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বা তার সঙ্গে যোগশাযোসে এক ইতালীয় মহিলার গুপ্ত নেতৃত্বে যে ‘জেসুয়া প্রজেক্ট’ চলেছে তার বহিঃপ্রকাশ দেখলাম পালঘরে সাধু হত্যার মধ্যে। অসুর চর্চা তথা হুদুড় দুর্গার কাহিনী সম্ভবত সেই খ্রিস্টানীকরণ প্রকল্পেরই অঙ্গ যা এতদিন বোঝা যায়নি। আর যেকোনও নাশকতা ও নেতিবাচক কর্মসূচীর পক্ষে লাল ঝাণ্ডা তো সব সময় মজুদ।
এই জম্বুদ্বীপ ৮০০ বছর পশ্চিম এশীয় ও পর্তুগীজ় আগ্রাসন ধরলে ৪০০ বছর ইওরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের জেরে ইতিমধ্যে তার আদি হিন্দু বাসভূমির চরিত্র হারিয়ে একটি মিশ্র সংস্কৃতির ও পরস্পর সংঘাতরত জাতিসত্তার উপমহাদেশে পরিণত আগেই হয়েই গেছে, যে উপমহাদেশীয় চরিত্র নিয়ে আমরা ‘শক হুন দল মোগল পাঠান এক দেহে হল লীন’ ভেবে বরাবর বেশ গর্ব করতে শিখেছি। আর এখন সেই উপমহাদেশে তার আদিবাসী বা মূল নিবাসীদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি লাগিয়ে আব্রাহামিক ও কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যবাদ সব ছিঁড়েখুঁটে তছনছ করে দিচ্ছে। যে মহিষাসুর দুর্গাপুজোর সময় দেবীর চরণতলে তাঁর শত্রুরূপী ভক্ত হিসাবে পূজিত হয়, তাকে অসুরদরদীরা মাতৃসঙ্গমী বানিয়ে কোন মর্যাদার আসলে বসিয়েছে কে জানে? তবে প্রশ্নটা যদি জনজাতি গোষ্ঢীগুলোর মধ্যেও জেগে ওঠে, তাহলে হিন্দু মহাসাগর মন্থন করে পুনরায় অমৃতকুম্ভ উঠে আসতে পারে যা নিয়ে হয়তো সুরাসুরের দ্বন্দ্ব বাধবে না।
৫১টি শক্তিপীঠের আজ অনেকগুলিই বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সীমানায়, যার মধ্যে নেপাল ছাড়া আর কোথাও হিন্দু সংস্কৃতির ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই এবং সেটাও চীনপন্থী মাওবাদী সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অবলুপ্ত হতেই পারে। লুণ্ঠিত সতীপীঠগুলির স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠাই একমাত্র হারিয়ে যাওয়া সনাতন চেতনা ও ভূমিকে পুনরুদ্ধার করতে পারে।
*ঋণস্বীকার: বিভিন্ন সূত্র এবং রচনার কিয়দংশের তথ্য ঋতুপর্ণ বসু-র রচনা থেকে সংগৃহীত।
লেখিকা প্রখ্যাত সাহিত্যিক। মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত। বঙ্গদেশ পত্রিকা দায়ী নয়।