গণেশ চতুর্থী – নষ্টচন্দ্র দর্শন পরিহার

মুখ্য চান্দ্র ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্থী তিথিতে শ্রীগণেশের পূজা ভারতবর্ষের সর্বত্রই প্রচলিত। বিশেষ করে দাক্ষিণাত্য প্রদেশে এই পূজার প্রচলন অধিক। ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক, গোয়া, গুজরাত প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে সাড়ম্বরে গণেশ চতুর্থী পালিত হয়ে থাকে। মহারাষ্ট্রে গণেশ চতুর্থীর পূজা প্রধান উৎসবের স্থান লাভ করেছে। মহারাষ্ট্রে দশ দিন ব্যাপী এই পূজা হয়ে থাকে।

শ্রীগণেশের পূর্বোক্ত রাজ্যগুলিতে শ্রীগণেশের পূজা মূলতঃ হয়ে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে। শ্রীগণেশের নিকট বিদ্যা প্রার্থনা করে ছাত্রছাত্রীরা ভক্তি সহকারে এই পূজাতে অংশগ্রহণ করে। উৎসবকে ঘিরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিসর ছেয়ে যায় রঙ্গবল্লী (আলপনা) সহ নানাবিধ সাজসজ্জায়। মূল পূজার অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা শ্রীগণেশকে নৃত্য, গীত, বাদ্য, গ্রন্থপাঠ, শাস্ত্রপারায়ণ, বেদ পারায়ণ প্রভৃতি নানা কলার প্রদর্শন। অর্থাৎ, কেবলমাত্র লৌকিক উপচার নয়, অন্তর্নিহিত শিল্প, কলা প্রভৃতির দ্বারাও গণেশের আরাধনা করা হয় এই দিনে।

এর পরে সন্ধ্যার সময়ে অত্যাবশ্যক কার্যক্রম হল স্যমন্তকোপাখ্যান শ্রবণ। সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি।

কিন্তু বাংলায় এই তিথিতে ঠিক কী করা হত সেই বিষয়ে আজ বাঙ্গালীরা অনেকেই অনভিজ্ঞ। বিশেষ করে যারা বাংলা ভাষা বা বাঙ্গালী সংস্কৃতির নাম নিয়ে জেহাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলার মৌলিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ব্রত গ্রহণ করেছে তারা তো এই বিষয়ে একেবারেই অন্ধকারে। আজকাল অনেক জায়গাতেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে সার্বজনীন গণেশ পূজার প্রবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেকে বাড়িতেও এই তিথিতে শ্রীগণেশের পূজার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু, বাস্তবে এই তিথির মূল তত্ত্বটি অধরা থেকে যাচ্ছে। বর্তমান প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে কিছু কথা আলোচনার চেষ্টা করা হবে। বলা হয়েছে–

পঞ্চাননগতে ভানৌ পক্ষয়োরুভয়োরপি

চতুর্থ্যাম্ উদিতশ্চন্দ্রো নেক্ষিতব্যঃ কদাচন

সূর্য যখন সিংহরাশিতে থাকে (অর্থাৎ ভাদ্র মাসে) তখন উভয় পক্ষে চতুর্থীতে চন্দ্র কখনওই দেখা চলবে না

বাংলায় (বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু সমাজে) এই তিথিতে নষ্টচন্দ্র দর্শন পরিহার ব্রত পালন করা হয়। ভাদ্র মাসের দুই পক্ষের চতুর্থী তিথিতে উদিত চন্দ্রকে নষ্টচন্দ্র বলা হয়। পুরাণ অনুসারে নষ্টচন্দ্র দর্শন করলে মিথ্যা কলঙ্কের ভাগী হতে হয়। এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনী পুরাণে বলা হয়েছে।

একবার কুবেরের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণের খাওয়া দাওয়া সেরে রাত্রিতে গণেশ কৈলাশে ফিরছিলেন। চাঁদের আলোয় একটি সাপকে দেখে ভয় পেয়ে গণেশের বাহন ইঁদুর লাফিয়ে ওঠার ফলে গণেশ পড়ে যান। তাকে দেখে চন্দ্র হেসে ওঠে। আসলে নিজের রূপের দর্পের বশেই চন্দ্র গণেশকে উপহাস করেছিলেন। গণেশ চন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে তার প্রকাশ লুপ্ত হবে। তৎক্ষণাৎ চন্দ্র প্রকাশহীন হয়ে গেলে চরাচর অন্ধকারে ব্যাপ্ত হয়। দেবতারা এবং চন্দ্রদেব চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং চন্দ্র ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তখন গণেশ পক্ষে পক্ষে চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধি হবে বলে শাপ লঘু করেন। কিন্তু তিনি বলেন যে, চতুর্থীতে চন্দ্র তার বিষয়ে পরিহাস করেছিলেন বলে চতুর্থীতে বিশেষতঃ ভাদ্র মাসের শুক্ল চতুর্থীতে চন্দ্রকে দর্শন করলে চন্দ্র দর্শনকারীর মিথ্যা কলঙ্ক হবে।

কোন ব্যক্তি যদি ভুল করে নষ্টচন্দ্র দর্শন করে তবে অবশ্যম্ভাবী মিথ্যা কলঙ্ক ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি মজার উপায় বলা হয়। সেটি হল, নষ্টচন্দ্র দর্শনকারী ব্যক্তি নিকটবর্তী কোন প্রতিবেশীকে অতর্কিতে একটি জুতো ছুঁড়ে মারবেন। তখন সেই প্রতিবেশী যদি তাকে জমিয়ে গালাগালি দেন তবে নষ্টচন্দ্র দর্শন জনিত দোষ খণ্ডিত হয় বলে মজা করে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু নষ্টচন্দ্র দর্শন জনিত অপরাধ ক্ষালনের শাস্ত্রীয় উপায় হল স্যমন্তক উপাখ্যান শ্রবণ। এই উপাখ্যান শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে বলা হয়েছে।

স্যমন্তক উপাখ্যান

 ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বন্ধু সত্রাজিৎ নামক রাজা সূর্যদেবের কাছ থেকে স্যমন্তক নামক একটি সুন্দর মণি পেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ একবার সেই মণিটিকে দেখে সেটির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কয়েকদিনের জন্য মণিটি চেয়ে বসেন। সত্রাজিৎ সেই মণিটির প্রতি এত আসক্ত ছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণকে মণিটি দিতে অস্বাকীর করেন। পরে কখনও একবার সত্রাজিতের ভাই প্রসেন সেই মণিটি ধারণ করে অরণ্যে মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। এই সময়ে প্রসেনকে একটি সিংহ হত্যা করে এবং সেই সিংহ স্যমন্তক মণিটি নিয়ে চলে যায়। জাম্ববান এই সিংহের নিকট মণিটি দেখে সিংহটিকে হত্যা করেন এবং সিংহের কাছ থেকে মণিটি নিয়ে নেন।

এদিকে প্রসেনের মৃত্যু এবং মণি অপহরণের খবর পেয়ে সত্রাজিৎ প্রসেনের হত্যাকারী এবং মণি অপহরণকারী রূপে শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করেন। চতুর্দিকে শ্রীকৃষ্ণের নামে মিথ্যা কলঙ্ক প্রচারিত হতে থাকে। এই মিথ্যা কলঙ্কের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণ অরণ্যে যান। সেখানে বহু অন্বেষণের পরে জাম্ববানের নিকট মণিটি দেখতে পান এবং জাম্ববানের কাছ থেকে মণিটি চান। কিন্তু জাম্ববান শ্রীকৃষ্ণকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেন। শ্রীকৃষ্ণ ও জাম্ববানের এই লড়াই বহু দিন ধরে চলতে থাকে। জাম্ববান ছিলেন মহাবীর। শোনা যায়, ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র জাম্ববানকে কিছু উপহার বা বর দিতে চাইলে জাম্ববান বলেছিলেন যে, তিনি প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে চান। শ্রীরামচন্দ্র তখন জাম্ববানকে বলেছিলেন যে, দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণাবতারে তিনি জাম্ববানের এই ইচ্ছা পূরণ করবেন। জাম্ববানের সঙ্গে যুদ্ধে অবশেষে জাম্ববান পরাজিত হন। জাম্ববান উপলব্ধি করেন যে, শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরামচন্দ্র। নিজের কন্যা জাম্ববতীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিবাহ দিয়ে তিনি স্যমন্তক মণিটি শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে দেন।

শ্রীকৃষ্ণ স্যমন্তক উদ্ধার করে সত্রাজিৎকে ফেরত দিলে শ্রীকৃষ্ণের কলঙ্কমোচন হয়। তিনি সত্রাজিৎকে নিম্নলিখিত শ্লোকটি বলেন–

সিংহঃ প্রসেনম্ অবধীৎ সিংহো জাম্ববতা হতঃ

সুকুমারক মা রোদীস্তব হ্যেষ স্যমন্তকঃ

অর্থ – সিংহ প্রসেনকে হত্যা করেছিল। জাম্ববান আবার সিংহকে হত্যা করেছিল। হে সুকুমার (কোমলমতি সম্পন্ন সত্রাজিৎ) তুমি কেঁদো না। এই স্যমন্তক তোমারই।

এই কাহিনীটি শ্রবণ করে এবং এই শ্লোকটি পাঠ করে নষ্টচন্দ্র দর্শন জনিত অপরাধ ক্ষালন হয় বলে কথিত আছে। গণেশ চতুর্থীর দিন সন্ধ্যাবেলায় শ্রীগণেশের সন্ধ্যারতির পরে সকলে একত্রিত হয়ে আড়ম্বরের সাথে এই কাহিনী শ্রবণের পরম্পরা প্রচলিত রয়েছে প্রায় সারা ভারতেই। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও এই পরম্পরা প্রচলিত ছিল। সেই সঙ্গে এই তিথিতে আরও একটি লোকপরম্পরা ছিল। নষ্টচন্দ্র দর্শনের ভয়ে সেই রাত্রিতে বড়রা সাধারণতঃ, বাড়ির বাইরে পা রাখতেন না। সেই সুযোগে ছেলে ছোকরারা বিভিন্ন বাগান থেকে নানাবিধ ফল চুরি করত। সেই দিন যেহেতু কেউ বাড়ির বাইরে বেরোবেন না সেজন্য কে চুরি করছে সেটি দেখাও সম্ভব নয় বলে ছেলে ছোকরারা নির্ভয়ে ফল চুরি করত সেইদিন। এটি নিছকই একটি আনন্দদায়ক লোক পরম্পরা।

যাই হোক, এই তিথিতে শ্রীগণেশের আরাধনা এবং নষ্টচন্দ্র সংক্রান্ত কাহিনীটির বিশেষ সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে।

শ্রীগণেশ লোকশক্তির প্রতীক। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র গণেশকে কার্যসিদ্ধির প্রতীক রূপে দেখিয়েছেন। আমাদের পরম্পরাতে শ্রীগণেশ সিদ্ধিদাতা রূপে স্বীকৃত। তিনি বিঘ্ননিবারক রূপেও বর্ণিত। তিনি সমস্ত কর্মে আদি বন্দনীয়। তিনি গণপতি অর্থাৎ, সংগঠনের দেবতা। সংগঠনে পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিহীন বহু মানুষ একাত্ম ভাবে এক লক্ষ্যপূরণের জন্য যুক্ত থাকেন। গণেশের শরীরেই সেটি পরিস্ফুট। মনুষ্য শরীরে হস্তীর মুণ্ড এই সামঞ্জস্য বিহীনতার মধ্যে একাত্মতার প্রতীক। গণেশ অহঙ্কারহীনতারও প্রতীক। পরশুরাম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত পাশুপত অস্ত্রকে ব্যর্থ করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি অস্ত্রের সম্মান রক্ষার্থে নিজের দাঁত বিসর্জন দিয়েছিলেন। এর দ্বারা তিনি অহঙ্কারহীনতার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এমন অদ্ভুত রূপের অধিকারী হয়েও তিনি সর্বজ্ঞ। বেদব্যাস মহাভারত রচনার সময়ে শ্রীগণপতিকেই স্মরণ করেছিলেন। শ্রীগণেশই মহাভারতকে প্রথম লিপিবদ্ধ করেন। সেজন্যই বিদ্যার্থীরা তাঁর উপাসনা করেন

এই ভাবে গণশেের পূজা সঙ্ঘশক্তির সামর্থ্য, সঙ্ঘ রচনার উপায় শিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের উৎকর্ষ ঘোষণা করে।

গণেশের চন্দ্রকে শাপ দেওয়ার কাহিনীটি এই শিক্ষা দেয় যে, ঐহিক সম্পদ নিয়ে দর্প করা অনুচিত। চন্দ্রের কলাক্ষয়ের মাধ্যমে ঐহিক সম্পদের ক্ষণস্থায়িত্বের কথা মনে করানো হয়

অন্যদিকে স্যমন্তকোপাখ্যানের দ্বারা শিক্ষা দেওয়া হয় যে, অন্যের সম্পদে অনর্থক লোভ আখেরে কলঙ্কের কারণ হয়। এমনকি ভগবান শ্রীকৃষ্ণও এই কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। এই শিক্ষার কথা পুনঃপুনঃ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এই প্রথাটি প্রতি বছর পালন করা হয়

লেখক – রাকেশ দাশ (Rakesh Das)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.