ছেটোবেলা বার বার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম- মা, বর্ষা কবে শেষ হবে ? মা বলত আর কদিন পরে। বর্ষার পরই তো শরৎ। মানে পূজা। কিছুদিন যেতেই আবার জিজ্ঞাসা করতাম পূজার আর কদিন বাকি? মা একটু রেগেই বলতো অতশত জানি না বাপু, এই আর কদিন পর। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সাদা সাদা মেঘ কবে ভেসে বেড়াবে। তারপর একদিন ভোরবেলা পাশের পাহানপাড়া, মূলাহাটের সাঁওতালপাড়া থেকে মাদলের ধাতিং ধিং তা… কিংবা ডাঙ্গাপাড়ার ঢাকিদের ঢাকের ও সানাইয়ের শব্দ শুনে মন বলে ওঠে পূজার আর বেশিদিন নেই। তারপরেই চোখ পড়ে আমাদের ছোটো নদীর দু’পাড় কাশফুলে ভরে উঠেছে। চারিদিক শুধু সাদা আর সাদা। সকালে দেখতাম শিউলিগাছের তলা শিশিরভেজা শিউলিতে ঢেকে আছে। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতাম – বাবা, পূজার আর কতদিন বাকি? বাবা একটু হেসে বলতেন আর কুড়িদিন। মনের মধ্যে যেন যেন আনন্দের ফোয়ারা শুরু হয়ে যেত। আমাদের পাড়ায় দুর্গাপূজা হয় না। পাশের পাড়া বসন্তায় হয়। পাড়ার কয়েকজন মিলে দেখে আসতাম প্রতিমায় দুবার মাটি লাগানো হয়ে গেছে। তারপর প্রতিদিন দিনে দুবার করে দেখে আসতাম আর কতখানি এগোল। রবিবারে সারাদিন বসে বসে প্রতিমা গড়া দেখতাম। বাবা দুপুরে গিয়ে কান ধরে নিয়ে আসতেন। বসে বসে প্রতিমা গড়া দেখার যে কী আনন্দ!
একদিন বাবা আমাদের সবাইকে ডাকতেন। সবাই মানে আমরা সাত ভাই-বোন, দুই ভাগনি আর কাজের টুনাদাদা। টুনা পাহান। ভাগনিদের বাড়ি পূর্ব পাকিস্তানে। ওখানে নাকি গণ্ডগোল শুরু হবে, তাই ওদের এপারে আমাদের বাড়িতে রেখেছে। দুই ভাগনি বড়দার থেকে ছোটো, আমাদের থেকে বড়ো। মা বলত দর্জি এসেছে, জামার মাপ নেবে। তা আমরা সবাই হাজির হতাম। দর্জিকাকু সবার মাপ নিত। মা ভাগনি আর বোনের ফ্রক এনে দিত। দর্জিকাকু সেই ফ্রক মাদুরের ওপর রেখে মাপ মাপ নিত। মা বলত ওরা মেয়েতো, তাই দর্জি ওদের মাপ নেবে না। মাপ নিয়ে দর্জিকাকু চলে যেত আর আমরা দিন গুনতে থাকতাম কবে নতুন জামা হাতে আসবে। বাবা বলতেন পঞ্চমীর দিন। আমরা অধীর অপেক্ষায় থাকতাম কবে পঞ্চমী আসবে।
মহালয়ার ভোরে মা আমাদের ডাকাডাকি করে তুলে দিত। বলত তাড়াতাড়ি ওঠ, মহালয়া শুরু হয়ে হয়ে গেছে। আমরা চোখেমুখে জল দিয়ে বড়ো ঘরে এসে বসতাম। রেডিয়োতে তখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী। কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু উদাত্তকণ্ঠে সংস্কৃত উচ্চারণ, ভাষ্যপাঠ আর মন মাতানো গানের সুরে যেন পাগল হয়ে যেতাম। মনে হতো পূজা বুঝি শুরু হয়ে গেছে।
এরমধ্যেই একদিন বাবা ১৪/১৫ টা নারকেল কিনে আনতেন। বাবার হাত থেকে নারকেল গুলো নিয়ে টুনাদাদা ছিবড়ে খুলতে শুরু করত। তারপর বাবা দায়ের পিঠের আঘাতে সমান দুভাগ করতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম এত সমান কীভাবে হচ্ছে। বাবা নারকেল ভাঙতেন আর আমরা ভাই-বোনেরা গেলাস নিয়ে নারকেলের জল নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দিতাম। বরাবর শারীরিক ভাবে দুর্বল বলে আমি জল ধরতে পারতাম না। কিন্তু বাবা আমাকে শেষ নারকেলটার পুরো জলটাই আমাকে দিতেন। সে মনে হতো যেন। অমৃত পান করছি।
দুপুরের পর কলাপাতা বিছিয়ে মা, বোন আর দুই ভাগনি নারকেল কুড়তে বসতো। সন্ধ্যায় নাড়ু তেরি হতো। সেইনাডুর গন্ধে সারা বাড়ি মম করত। আমরা নাড়ু নেওয়ার জন্য ঘুর ঘুর করতাম। মা বলতেন কেউ কাছে আসবে না। পুজো শুরু হলে সবাই পাবে। তারপর কয়েকদিন ধরে চলত নানারকম নাড়ু তৈরির পালা।
পঞ্চমীর দিন সকালে স্কুল হয়ে পুজোর এক মাসের ছুটি হয়ে যেত। সেদিন ছুটির পরে আমরা কয়েকজন মিলে ছ’সাতটা পুজোমণ্ডপ ঘুরে আসতাম। দেখতাম সব প্রতিমারই চোখ আঁকা চলছে। সব মণ্ডপই তৈরি হয়ে গেছে। সেদিন বিকেলে দর্জিকাকু নতুন জামা দিয়ে যেত। নিজের নিজের জামা আর ইজের হাতে নিয়ে নাকে চেপে ধরে গন্ধ শুকতাম। কী সুন্দর গন্ধ। নতুন জামা বলে কথা! পরদিন ষষ্ঠী। সকাল থেকেই আশেপাশের গ্রাম থেকে ঢাকের শব্দ শুনে মনটা আকুলিবিকুলি করে উঠত। সকালেই বাবা আমাদের সবাইকে ডেকে বলতেন, পুজোর কটা দিন কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই। কেননা বড়দা ছাড়া আমরা ভাইয়েরা প্রায় প্রতিদিনই পান থেকে চুন খসলেই দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দিতাম। দুপুরের একটু পরেই আমরা আর পাড়ার বন্ধুরা নতুন জামা পরে পুজো দেখতে বেরিয়ে পড়তাম। দশ-বারোটি মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে রাত্রি নটা-সাড়ে নটায় বাড়ি ফিরতাম। বাড়ি ফিরে কোথায় কেমন প্রতিমা দেখেছি তা বাবাকে বলতে হতো। এভাবে সপ্তমী-অষ্টমী বিভিন্ন গ্রামে পুজো দেখা চলত। নবমীর দিন সকালে দাদাদের সঙ্গে জেলা শহর বালুরঘাটে পুজো দেখতে যাওয়ার আনন্দই পুজোর সেরা আনন্দ। শহরে এক একটা পুজো মণ্ডপে দাঁড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। কত রকমের প্রতিমা। কত রকমের থিম। কত রকমের আলোর কারসাজি। আমাদের গ্রামের পুজোয় তো হ্যাজাকের আলো। সারাদিন হেঁটে হেঁটে পুজো দেখে ক্লান্ত হয়ে রাত্রি সাড়ে দশটায় বাড়ি ফিরতাম। বাস থেকে নেমে আর হাঁটতে পারতাম না। বড়দা কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসতো। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় পাড়ার বন্ধুরা মিলে হেঁটে ৭ কিলোমিটার দূরে হিলি শহরে পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময়। রাস্তার ধারের সব মণ্ডপের ঠাকুর দেখেছিলাম। আবার হেঁটেই বাড়ি ফিরেছিলাম। সে এক অ্যাডভেঞ্চার। সেই রাত্রিতে ভোরবেলা বড়দা বলেছিল নবমীর রাতটা নাকি একটু বড়ো। মা দুর্গার মা মেনকা নবমীনিশিকে কেঁদে কেঁদে বলছেন রাত যেন শেষ না হয়। সকাল হলেই যে মা দুর্গা কৈলাসে ফিরে যাবে। বড়দা আবৃত্তি করে বলত- “যেও না রজনী, আজি লয়ে তারাদলে/ গেলে তুমি দয়াময়ী, এ পরান যাবে। উদিলে নির্দয় রবি উদয়-অচলে/ নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে। শুনে ওই ছোটো বয়সেই মন ভারাক্রান্ত হয় যেত। মা মেনকার দুঃখে নয়, পুজোর আনন্দ শেষ হবার দুঃখে।
দশমীর দিন সকালে সবাই মিলে গেরস্থালির ছোটো ছোটো জিনিস দা, কুড়ুল, কোদাল, কাস্তে, শাবল,লাঠি,বল্লম বটি,,চাষের সরঞ্জাম সব কিছু জলে ধুয়ে নিকানো তুলসীতলায় রাখতাম। গাই-বাছুর, বলদজোড়াকে টুনাদাদা স্নান করিয়ে বাইরে সারি সারি বেঁধে রেখে। কপালে সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে, শিঙে তেল মাখিয়ে দিয়ে টাটকা ঘাস খেতে দিত। তারপর। সবাই স্নান সেরে তুলসীতলায় এসে দাঁড়াতাম। মা, বোন, ভাগনি গাই-বাছুর ও বলদদুটোকে ধান-দূর্বা দিয়ে পুজো করে আতপচাল, পাকাকলা খাইয়ে তুলসীতলায় এসে দাঁড়তো। বাবা স্নান করে নতুন ধুতি পরে এসে দাঁড়াতেই আমরা ধুয়ে রাখা জিনিসগুলেকে সিঁদুরের টিপ লাগাতাম। ওগুলোর মধ্যে সকালেই পুকুর থেকে ধরা একটা বড়ো পুঁটিমাছে সিঁদুর লাগিয়ে রাখা থাকতো। মা জিনিসগুলিকে ধান-দূর্বা দিয়ে পুজো করার পর বাবা সিঁদুর লাগানো পুঁটিমাছটি দিয়ে সবার কপালে সিঁদুর লাগিয়ে দিতেন। আমরা সবাই বাবা-মকে প্রণাম করতাম। বাবা বলতেন বিজয়া শুরু হয়ে গেল। গ্রামে সবার বাড়িতেই এই আচার পালন করা হতো। এখন হয় কী না জানি না।
সেদিন বিকেলে আমরা পাশের গ্রাম ত্রিমোহিনীর দাপটকালীর মাঠে দশমীর মেলায় যেতাম। বিভিন্ন গ্রামের প্রতিমা ওখানে জমা করা হতো।বৃষ্টি এলে প্রতিমার রং উঠে ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাতো। সন্ধ্যার আগে দিঘিতে একে একে সব প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো। পুজোর আনন্দ শেষ। আমরা বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরে আসতাম।
বাড়িতে ফিরে বাড়ি বাড়ি বড়োদের প্রণাম করতে বেরোতাম। লক্ষ্মীপুজোর আগেরদিন পর্যন্ত চলত। প্রণাম করার পর সব বাড়িতেই বিভিন্ন রকমের নাড়ু দিত। ইজেরের পকেট বোঝাই করে নিয়ে আসতাম। সে এক বিশাল আনন্দ। মনে হতো সারা বছর যদি পুজো থাকতো।
আজ আমি ষাটের কোটায়। এখন কলকাতায় থাকি। আজও আমি ছোটোবেলার পুজোর সেই আনন্দ, আবেগ, অনুভূতি একই ভাবে উপভোগ করি। সঙ্ প্রচারক জীবনে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় থাকার সময়ও কোনো ছেদ পড়েনি। ছোটোদের সঙ্গে আমি থাকতে ভালোবাসি।তাই আজও পুজোর কটাদিন তাদের সঙ্গেই ঘুরে ঘুরে পুজো দেখি। তাদের সঙ্গেই অষ্টমীর অঞ্জলি দিই। আজও বর্ষাশেষেশরতের ছানাকাটা মেঘের অপেক্ষায় থাকি। কাশফুলের দোলা ও শিশিরভেজা শিউলি দেখার জন্য আজও আমি সাঁতরাগাছি, বাউরিয়া, ফুলেশ্বরের খোলা মাঠে বা নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকি। আজও আমি সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে নির্মীয়মান দুর্গাপ্রতিমার সামনে একবার করে দাঁড়াই। তার কারণ হলো আমি যে ছোটোবেলাটা এখনও হারিয়ে ফেলিনি। ছোটোবেলার স্মৃতি রোমন্থন করি না। আমি ছোটোবেলাতেই আছি। আমি আজও ছোটোবেলার মন নিয়ে দুর্গাপুজো উপভোগ করি।
সুকেশচন্দ্র মণ্ডল
2019-09-30