দুর্গাপুজো এলে মন ছোটোবেলামুখী হয়। প্রতিবছর পুজো সঙ্গে করে নিয়ে আসে ছোটোবেলার স্মৃতি। মন কেমন করা আঁজলা ভরা একরাশ শিউলির গন্ধের মতো— পুজো মানেই ছোটোবেলা। ছাতিম ফুলের গন্ধমাখা সন্ধ্যের ভেজা বাতাসে যখন একটু হিমেল ছোঁয়া, তখন কলকাতার ঝলমলে দুর্গাপ্রতিমার ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেও মনের মধ্যে পদ্মপাতায় বারিবিন্দুর মত টলটল করতে থাকে ছোটোবেলার পুজো। সহস্র ঝলমলে থিম-প্রতিমার ভিড়ের মধ্যে যা খুঁজে পাওয়া যায় না, তা থাকে মনের অলিন্দে। ছেলেবেলার সে ছায়াপথ ফিরে আসে গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে গাঢ় স্বপ্নের হালকা বুননে। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছোটোবেলার সেই পুজোকে একটিবার ছোঁয়ার আকুলতা মেটে না। আজকের পুজো তাই নিয়ে আসে আনন্দ-বিধুর এক বিমর্ষতা। বাইরের পুজোর সুর অন্তরের সুরের সঙ্গে মেলে না কিছুতে।
পাড়ার ক্লাবের এক নিতান্ত সাদামাটা প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়েই তখন কেটে যেত পাঁচ পাঁচটা দিন। ঘামতেল মাখানো মায়ের মুখে খেলা করত কত রকম ভাব। চতুর্থীর রাত্রে আসত না ঘুম। পঞ্চমীর ভোরেই প্যাণ্ডেলে এসে যাবে ঠাকুর। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় রাত কাটিয়ে ভোর না হতেই হাজির সেখানে। দুর্গাপ্রতিমার মুখে আলোছায়ার খেলার সেই শুরু। ষষ্ঠীর ঢাকের বোলের সঙ্গে ঠাকুরের মুখে আহ্লাদী আনন্দ, সপ্তমীর সকালে কলাবউ স্নানের সময় তাতে পরিপূর্ণ প্রসন্নতা আর অষ্টমীর অঞ্জলির সময়ে সে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠত ক্লান্তি। অষ্টমীতে মা যুদ্ধ করতে করতে একবার অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। তারপর সন্ধিপুজোর সময়ে মা দুর্গার মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। অষ্টমী ও নবমী তিথির এই সন্ধিক্ষণে শুধু এক মুহূর্তের জন্য খুলবে তাঁর চোখ। মোষের সিং এর উপর থেকে একটি সরষেদানা গড়িয়ে পড়তে যতটুকু সময়, ঠিক ততটুকু সময়ের জন্য। পাছে সেই সময় চোখের পলক পড়ে যায়! তাহলে তো এ বছর আর দেখাই হল না মায়ের সাথে! এই ছিল পলক না ফেলার আদত কারণ। এই সন্ধিক্ষণেই দুর্গা পরাস্ত করেছিলেন মহিষাসুরকে। মহিষাসুর পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেবী প্রতিমার দিকে চেয়ে কত চিত্রকল্প আর রূপকল্পের বিন্যাস, মায়ের তৃতীয় নয়ন আর শরত-প্রকৃতির রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ—সব মিশে যেত সমস্ত বিশ্বসত্তায়। সকালের হিমে ভেজা ঘাসের ওপর শিউলি ফুলের আলতো ছোঁয়া, নমনীয় আভায় ফুটে থাকা স্থলপদ্ম আর “পূজার ফুলের বনে ওঠে ঐ পূজার দিনের রবি”—সে ভাব বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত। সে কাজ সাহিত্যিকের।
ছেলেবেলার এই পুজো ছিল দেবীপূজা। সনাতন সংস্কৃতিতে দেবদেবীর রূপকল্প ও মূর্তি মানুষের সঙ্গে ঐশ্বরিকতার সমন্বয়-সাধনের সহজতার স্বার্থে। মরণশীল মানবদেহের অন্তঃস্থ মানবাত্মা অবিনশ্বর পরমাত্মার অংশ। আপন-মাঝে তা উপলব্ধি করাই মনুষ্য-জীবনের আদত উদ্দেশ্য। ঋষি অরবিন্দর ভাষায়, “spread your aspiration level to divinity”. নিরাকার পরমব্রহ্মকে অন্তরে উপলব্ধি করার দুরূহ কাজ সহজ করাই ঈশ্বরের রূপকল্পের ধারণার উৎস। দেবীমূর্তিতে ব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তির আরাধনা, নিজ অস্তিত্বকে পরমাপ্রকৃতির অংশরূপে উপলব্ধি করার জন্য। জীবনের প্রতিটি কর্ম নিজমধ্যে ঈশ্বরত্ব উপলব্ধির নিরলস প্রয়াস যা অসীম ও অনন্ত। অনাদি অতীত থেকে অনন্ত ভবিষ্যতের নিরন্তর যাত্রাপথে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, নক্ষত্রলোক থেকে নক্ষত্রলোকান্তরে সে প্রয়াস নিরবচ্ছিন্ন। গন্তব্য নয়, যাত্রাপথটিই মুখ্য। সাধারণ মানুষ দেবতা হয়ে ওঠে না। কিন্তু নিজমধ্যে দেবত্ব অনুভবের সাধনাই যে সার্থক মনুষ্যজীবন, তা উপলব্ধি করতে তাকে সাহায্য করাই প্রকৃত শিক্ষাদান। আজকের শহুরে দুর্গাপুজো আধ্যাত্মিকতা-বর্জিত। আড়ম্বর ও আত্মসর্বস্ব এই কার্ণিভালে ব্যবসা আছে, অর্থনীতির মঙ্গল আছে, কিন্তু ‘পুজো’ নেই, সমর্পণও নেই। পূজাহীনতার এই উৎসব বাঙালীর শরীর থেকে তার আত্মাকে পৃথক করার এক প্রকল্প। পুজোমণ্ডপগুলি উৎকৃষ্ট শিল্পপ্রদর্শনীর মঞ্চ সত্য, কিন্তু সে মঞ্চে ‘দেবী’ নেই। মূর্তির শিল্পসুষমা ও আঙ্গিক নিয়ে যথাবিধি, এমনকি বিধি-বহির্ভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে, পুজো শুরু হওয়ার আগে থেকে পুরষ্কারের উন্মাদনাও আছে, কিন্তু মূর্তিতে ব্রহ্মময়ীর প্রাণপ্রতিষ্ঠার আর্তি নেই। দেবী আরাধনার পথ থেকে বাঙালী বিচ্যুত হয়েছে।
শিল্পের খাতিরে, ক্রিয়েটিভিটির খাতিরে দেবীর মানবীকরণ করার চেষ্টা চলেছে। মানবীর দেবীতে উপনীত হওয়ার সাধনার প্রেরণায় ইতি টেনে বিজ্ঞাপন জগত ও পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা দেবী দুর্গাকে সাধারণ মানবীর রূপ দান করেছে। বিখ্যাত এক প্রকাশণীর নানা পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদে দেখতে পাওয়া যায় ব্রহ্মময়ীর উপাসনা নয়, বরং দেবীর মানবীকরণের প্রণোদনা। বিনা সাধনায় সাধারণ নারী নিজের অজান্তেই নিজেকে দেবীসম মনে করার ইন্ধন পাচ্ছে এমত পত্রপত্রিকা ও বিজ্ঞাপন জগত থেকে। তার দেবীত্বে উপনীত হওয়ার সত্য তাগিদ ও তদর্থে নিরলস প্রয়াস আর থাকছে না। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজের ভাষায় সহজ করে বলতে গেলে, তার achievement need কে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। সেজেগুজে দশখানি ফলস হাত লাগিয়ে পোস্টারে দাঁড়িয়ে গেলেই যদি দুর্গাঠাকুর সাজা যায়, তবে প্রকৃত দায়িত্ব নিয়ে সংসার প্রতিপালন, প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষার তাগিদ সে অনুভব করবে কিভাবে? সমষ্টিস্বার্থে নানা ত্যাগ স্বীকার ও কর্মপ্রণালীর মধ্যে দিয়ে সমাজ ও সন্তানের সামনে একটি দৃষ্টান্তমূলক জীবন যাপন করার ভারটি সে বইতে চাইবেই বা কেন? আর মা যদি তা না করেন, তবে পরবর্তী প্রজন্ম কার কাছ থেকে শিখবে? বিকৃতিটি অন্তর্জগতের। এবং এর সামাজিক প্রভাব অন্তহীন। উদারপন্থী জনগোষ্ঠী উদারতা মনে করে তার সাংস্কৃতিক ও ভাবজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। যে চিন্তনপ্রণালী মানবচরিত্র গঠন করার মাধ্যমে সমাজ গঠন করে, সেই চিন্তনকে উদারতার ‘ছলে’ ভাব ও দর্শনবিহীন করে তোলা হচ্ছে। এমন কাজ যে সচেতনভাবেই করা হচ্ছে না, সেকথা বলা যায় না। হিন্দু বাঙালীর সংস্কৃতিতে আঘাত করার ষড়যন্ত্রটি বাস্তবিকই চলছে। বহু হিন্দু বাঙালী তা বিশ্বাস করেন না। তাঁদের সে অবিশ্বাসকে জিইয়ে রাখার প্রয়াসও চলেছে অবিরত, আর সেমত অবিশ্বাস ষড়যন্ত্রের চক্রীদের জোগাচ্ছে বাড়তি অক্সিজেন। টালিগঞ্জের নায়িকারা পত্রপত্রিকায়, রাস্তার হোর্ডিং-এ দেবী দুর্গার বিভঙ্গে মডেলিং করছেন। ব্রহ্মময়ীর আরাধনা মাঠে মারা গিয়েছে আর পূজাহীন উৎসবের যন্ত্রণায় বিদ্ধ আমি কলকাতার আলো ঝলমলে রাস্তায় হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি ছোটোবেলার পুজো।
প্রতি বছর মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যখন “প্রসিদ বিশ্বেশ্বরী” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন, তখন সেই আর্তি গোটা জগত প্রকৃতির মধ্যে বিলীন হয়। জগন্মাতা প্রসন্ন না হলে পৃথিবীর মঙ্গল সাধন অসম্ভব। সন্তানকে আত্মসমর্পণ করতেই হয়। কিন্তু উৎসবের উন্মাদনা মাতৃপূজার সেই চেতনার জগতে আঘাত হেনেছে। গত বছর কলকাতার এক পুজোমণ্ডপ দেবীপ্রতিমার মুখে লাগিয়েছিল অক্সিজেন মাস্ক। শহরে ক্রমবর্ধমান দূষণের মাত্রা বোঝানোর তথাকথিত ক্রিয়েটিভ প্রকাশভঙ্গি ছিল এইটি। দেবী স্বয়ং মা বিপত্তারিণী, জগদ্ধাত্রী। তাঁর ইচ্ছে বিনা জগৎ সংসার অচল। কিন্তু শহর কলকাতার বর্তমান ক্রিয়েটিভ সমাজ সেই দেবীকেই অক্সিজেন মাস্ক পরিয়েছিল। ঈশ্বরের মানবীকরণের এ এক বেদনাদায়ক উদাহরণ। এই মানবীকরণ ভালো না মন্দ সে আলোচনা বিতর্কসাপেক্ষ। ঈশ্বরের মানবীকরণ করেছেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁর সহজিয়া ভঙ্গিতে অতি সহজে সাধারণ মানুষের অন্তরে পৌঁছেও দিয়েছেন সে কথা। তাঁর মৃত্যুর একশো চৌত্রিশ বছর পরও কোটি কোটি মানুষ তাঁর বাণীকে পাথেয় করে পথ চলেছে বিশ্বজুড়ে। সুতরাং দেবীর মানবীকরণ উচিত কি অনুচিত সে বিতর্কে না গিয়েও বিতর্কহীনভাবে বলা যায় যে পরমহংসের অনুভূতি ও উপলব্ধির গভীরতা অর্জন না করে, ঈশ্বরের মানবীকরণ সাধারণ মানুষকে অসহায়, দুর্বল, সমর্পণহীন এবং সেই হেতু আত্মপ্রবঞ্চক করে তোলে। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাবদর্শনক্ষমতা ব্যতীত ঈশ্বরের মানবীকরণ করতে যাওয়া আত্মঘাতী পদক্ষেপ। স্বয়ং আদ্যাশক্তির কাছে জাগতিক পৃথিবীর দৈনন্দিন সমস্যা থেকে মুক্তির পথ প্রার্থনা করাই সাধারণ মনুষ্যের কর্তব্য। “দেব ও মানব এক হয় না”—এক কালের অতি প্রচলিত প্রবচন। মানুষ যে সমস্যায় জর্জরিত, দেবীও সেই একই সমস্যায় কাবু হবেন, এমন প্রদর্শনের মাধ্যমে ঈশ্বরকে অসহায়, নিরুপায় এক সামান্য মানব মাত্র বলে উপস্থাপন করা শৈল্পিক ক্রিয়েটিভিটি নয়, চিন্তার আত্মঘাতী অগভীরতা। ব্রহ্মময়ী মায়ের পায়ে সমর্পণের ক্ষমতা থেকে যে বিপুল আত্মশক্তি লাভ করা যায়, সে শক্তিই সাফল্য আনে, দৈনন্দিনতার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। ঈশ্বরকে হৃদয়ে ধারণ করে মাটিতে নামে মানুষ। ঈশ্বর সেখানে আসেন স্বয়ং। তাঁকে মাটিতে টেনে নামানো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কলকাতার পুজোগুলো সে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছে অতি দ্রুত। দুর্গাপুজোকে ‘কার্ণিভাল’ করে তুলে আত্মপরিচয় বিনাশের অবিমৃশ্যকারিতা প্রদর্শন করছে তারা। আমি তাই ছুটে বেড়াই পথে পথে, পুজো দেখব বলে। হয় না।
কথা বলছিলাম অতি বিখ্যাত এক শিল্পীর সঙ্গে। তিনি দেবীপ্রতিমার সঙ্গে অসুর গড়েন না। কেবল রেখে দেন অসুরের একটি চিহ্ন। তাঁর মতে অসুরবধ দলিতের ওপর আর্যের অত্যাচারের প্রতীক, আজকের দিনে সে ভাব অচল। শুভ ও অশুভের মধ্যেকার সংঘাতের ধারণাটিকে এবং যাঁরা দুর্গাপুজো করছেন, তাঁদের মূল বিশ্বাসটিকেও যে এর ফলে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করা হল, সেটি শিল্পী ভাবেন নি। পুরাণকথা অনুযায়ী যে মহিষাসুরকে পরাস্ত করছেন দেবী দুর্গা, তিনি নিজেও কম মহিমান্বিত চরিত্র নন। মহিষাসুর শিবের অংশজাত। যুদ্ধে তাঁকে পরাস্ত করার পর দেবী ক্ষমাপ্রার্থনাও করেন মহিষাসুরের কাছে। অর্থাৎ একতরফা অত্যাচারের কাহিনী এ নয়। কিন্তু “দলিত-আর্য” রাজনৈতিক ন্যারেটিভের চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে সেই ভাবধারা ও সংস্কৃতি—সে খেয়াল কারও নেই। পুজো কমিটির উদ্যোক্তারাও কিছু বলছেন না। ফলে এমন সব রাজনৈতিক ন্যারেটিভ ক্রমেই গ্রাস করছে আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে। এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতা তাঁদের প্রতিও একইরকম সংবেদনশীল যাঁরা দেবীপক্ষে উৎসব করেন না। অর্থাৎ রাঢ় বঙ্গের সেই মানুষেরা, যাঁরা অসুরের উপাসক। কিন্তু যাঁরা অসুরদলনী দেবী দুর্গার পুজো করেন, তাঁদের ভাবদর্শনকে অবদমিত করার সাংস্কৃতিক প্রয়াস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবশ্যই। পুজো-উদ্যোক্তারা এমন সব শিল্পীদের স্বাধীনতা দেন কারণ বিখ্যাত শিল্পীর নিজস্ব ব্র্যাণ্ড ইকুয়িটির ভাগ পুজোটিও পায়। ফলে বাড়ে নাম ও দর্শক, আসে পুরষ্কার, এমনকি সরকারি অনুগ্রহও। অর্থাৎ অর্থমূল্যের বিনিময়ে পরিবর্তিত হচ্ছে ভাবধারা। এ পরিবর্তন স্বতঃস্ফূর্ত নয়। এমত পরিবর্তন ঠেকানোর চেষ্টা মাত্র করার উদ্যোগ কি শহরের দুর্গাপুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের নেওয়া উচিত নয়? অর্থের বিনিময়ে কি কি দিতে পারা যায় আর কি দেওয়া যায় না, তার কি বিচার হবে না?
গত বছর দুয়েক যাবৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে দেবী দুর্গার হাতে অস্ত্র না দেওয়ার নির্দেশ এসেছে পুজো কমিটিগুলির কাছে এবং শহরের বহু পুজো সে নির্দেশ মেনেও নিয়েছে। দেবী দুর্গা কিভাবে অস্ত্রহীন হবেন, সে প্রশ্ন তোলা হয় নি। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা রামচন্দ্রের অকালবোধনের অনুসরণে। রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পূর্বে যুদ্ধের দেবীর আরাধনা করেছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র। বর প্রার্থনা করেছিলেন জয়লাভের জন্য। দেবী দুর্গার কাছে রক্ষিত ছিল রাবণের মৃত্যুবাণ। দেবী রাবণকে কথা দিয়েছিলেন যে রাবণ নিজে না চাইলে সে মৃত্যুবাণ তিনি কাউকে দেবেন না। তাই বিজয়াকাঙ্খায় শ্রী রামচন্দ্র যখন দেবীপূজা করতে বসলেন, তখন রাবণকেই আহ্বান জানালেন সে পূজার পৌরোহিত্য করতে। পরম ব্রাহ্মণ রাবণ রাজী হলেন। প্রকৃত ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্যের আহ্বান কদাচ অস্বীকার করতে পারে না। পুরোহিত হিসেবে নিজের মৃত্যুবাণ দেবীর কাছ থেকে চেয়ে নিলেন রাবণ নিজেই। শ্রী রামচন্দ্রের হয়ে, শ্রী রামচন্দ্রের পুরোহিত হিসেবে। দেবীও দিলেন সে মৃত্যুবাণ তাঁর হাতে তুলে। রামচন্দ্রকে দিলেন বিজয়ের আশীর্বাদ। অর্থাৎ এই পুজো যুদ্ধের দেবীরই পুজো। অসুরদলনী দুর্গা। রাবণ বধের দুর্গা। তাঁকে আমরা “ঘরের মেয়ে”র রূপ দিয়েছি সত্য, কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণে পুজো হয় দুর্গারই। দেবীর এই রূপ কদাচ অস্ত্রহীন হতে পারে না। কিন্তু রাজ্যের বহু পুজো কমিটি দেবী দুর্গাকে অস্ত্রহীন করেছে। সম্প্রীতির জন্য একটি জাতির নিবীর্য হওয়া কি আবশ্যক? যে বঙ্গপ্রদেশে অনুশীলন সমিতির জন্ম হয়েছিল, যে বঙ্গভূমি সন্ন্যাসীবিদ্রোহের ভূমি, যে বঙ্গপ্রদেশে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেছেন “আনন্দমঠ”, বাঙালী কি সেই বঙ্গভূমিতে দেবী দুর্গার নিরস্ত্রীকরণের রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতে না পারার মত শীতল রক্তের নির্বুদ্ধি জীব?
এ যন্ত্রণার শেষ নেই, কারণ সমস্যা বহিরঙ্গের নয়। গত বৎসর কলকাতার এক অতি বিখ্যাত স্বর্ণব্যবসা-প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনে হীরের গহনায় সজ্জিতা এক আধুনিকা নারীর হাতে লক্ষ্মীর পট দিয়ে ফোটোশুট করেছিল। বিজ্ঞাপনশিল্পীর বক্তব্য ছিল সহজ ও সুন্দর। নারীকে সেখানে লক্ষ্মীরূপিনী, সমৃদ্ধি-স্বরূপিনী দেখানো হয়েছিল। সেক্ষেত্রেও লক্ষ্মীদেবীর মানবীকরণ করা হয়েছিল। মডেলের হাতে লক্ষ্মীর পট ধরিয়ে মডেলকেই চিত্রায়িত করতে চাওয়া হয়েছিল স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী হিসেবে। যে পটে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা হয়, মডেলের হাতে ছিল সেই পট। কিন্তু যে ভঙ্গিমায় এবং দেহের যে স্থানে লক্ষ্মীর সরা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মডেল, তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছিল। লক্ষ্মীর পট ঐভাবে প্রদর্শন করা অনাচার। অশালীন বিজ্ঞাপন বানানো স্বর্ণব্যবসায়ী বা বিজ্ঞাপন-শিল্পীর উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তথাকথিত উদার চেতনা ও শিল্পভাবনা এ রাজ্যে সমাজ-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও শালীনতা-চেতনাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে প্রায়শঃ। শৈল্পিক সাহসিকতা প্রদর্শনের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে হিন্দু বাঙালীর সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব। যে সব সাধারণ মানুষ ঐসব তথাকথিত শিল্পকর্ম দেখছেন, তাঁদের অনেকেই বিষয়টিকে শৈল্পিক নির্লিপ্তির সঙ্গে দেখতে পারছেন না। তাঁদের মনুষ্যদৃষ্টিতে ছোট হচ্ছে হিন্দু বাঙালীর আত্মসম্মানবোধ, যদিও এমনভাবে চিন্তা বহু হিন্দু বাঙালীই করেন না।
চেতনাচ্ছন্ন হিন্দু বাঙালীকে তার সকল শিল্পবোধ ও মেধা নিয়ে, সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করেই পা বাড়াতে হবে পুনর্জাগরণের পথে। সুদীর্ঘ সে যাত্রাপথে ইতিমধ্যেই বিলম্ব হয়েছে অনেকখানি। বাঙালী ফিরলেই ফিরবে আমার ছোটবেলার সেই দুর্গাপুজো। সে আশা পূরণ না হলে ফুরোবে না দিন।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya