ঔপনিবেশিক ১৪ ফেব্রুয়ারি: কল্পতরুর মতই অতিক্রম করে ভারতীয়করণ হোক।

#কল্যাণ গৌতম 


প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনে ১৪ ই ফেব্রুয়ারির বিরোধিতা একেবারেই করা হয় নি, বরং প্রচেষ্টা হয়েছে তা অবলীলায় অতিক্রমণের। এই নিয়েই প্রস্তুত আলোচনা —
বিদেশী শাসন ও বিধর্মী-সংস্কৃতির বিপ্রতীপে সারাবিশ্বে ত্রিবিধ প্রতিক্রিয়া ঘটে। # প্রথম

তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ ও তীব্র অশান্তি সংঘটিত হয়, # দ্বিতীয় পরানুকরণের ঢল নামে এবং বিধর্মী রাজার ধর্মকে আপন ধর্ম করে তোলার সক্রিয় প্রয়াস চলে, # তৃতীয় বিধর্মী সংস্কৃতিকে অতিক্রম করতে চাওয়ার স্পর্ধা দেখানো নীরব ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলে।
খ্রিস্টান-ইংরেজ আমলে ভারতীয় মুসলমানেরা সামরিকভাবে পরাজয়ের পর সর্বতোভাবে বিরোধিতার পথে গিয়ে ক্রমে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো এবং শিক্ষাদীক্ষায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়লো। বিপ্রতীপে ভারতীয় হিন্দুদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইংরেজদের সঙ্গে প্রাণঢালা মিতালি করলো, তাদের অনুকরণ করলো এবং ইউরোপীয় শিক্ষার সুযোগে এগিয়ে চললো, যার-ই ফলশ্রুতিতে দেখা গেলো নবজাগরণ। তৃতীয় যে জাতীয়তাবাদী ধর্মীয়-ধারা, যার নেতৃত্বে শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দ, তারা খ্রিস্টান-সম্পৃক্ত ধর্মীয় ও সংস্কৃতির দিনগুলিকে বেছে বেছে হিন্দুত্ববাদের পরত মাখিয়ে দিলেন, হিন্দুত্বের নতুনভাবে জয় সাধিত হল। ১ লা জানুয়ারি যত না খ্রিস্টীয় উৎসব, তার চাইতেও কল্পতরু-র সুগন্ধি আরও আরও প্রকট হচ্ছে। ১৮৮৬ সালের এই দিনটিতেই শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়েছিলেন। নিঃশব্দে একটি ধর্মীয় বিপ্লব এনে দিলেন তিনি খ্রিস্টীয় দুনিয়ায়। এর যে কতটা শক্তি, তা আগামী দিনে খ্রিস্ট-সমাজ বুঝতে পারবে, ততদিনে ধর্মনদী ধর্মতলা পেরিয়ে অনেক দূরে বয়ে যাবে। একইভাবে স্বামী বিবেকানন্দ ২৫ শে ডিসেম্বরকে অতিক্রম করে কন্যাকুমারীর শেষ শিলায় ধ্যানে বসে (১৮৯২) অখণ্ড ভারত দিবস করে তুলেলেন, যখন সমগ্র ব্রিটিশ ভারত যীশুর ভজনায় উৎসব-মুখর। ভাবা যায়! স্বামী বিবেকানন্দ এই কাজটি খুবই চিন্তা ভাবনা নিয়েই করেছেন। এর আগেও তার সূচনা দিয়ে গেছেন, এই দিনটিকে তিনি নতুনভাবে গড়ে তুলছেন। ১৮৮৬ সালেরই ২৪ শে ডিসেম্বর রাতে ধুনি জ্বালিয়ে সন্ন্যাস নেবার শপথ নিলেন হুগলি জেলার আঁটপুর গ্রামে স্বামী প্রেমেশানন্দের বাড়িতে। কয়েকজন গুরুভাইকে সঙ্গে করে একটি খ্রিস্ট-ধর্মীয় দিবসকে এককথায় অতিক্রম করে চলে গেলেন তিনি। অন্য দিনও তো ছিল! কই বাছলেন না তো সেই সব দিন! আঁটপুরেরও তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন তার আগেই। যতদিন যাবে বিশ্ববাসী দেখতে পাবেন কন্যাকুমারীর পাষান শিলার স্বামীজি জীবন্ত হয়ে সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছেন। এবং ঘটনাচক্রে ওই দিনটি হবে ২৫ শে ডিসেম্বরের বড়দিন। কী ব্যতিক্রমী প্রতিস্পর্ধা! বিবেকানন্দ কেন্দ্র ওই দিনটি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পাষানের মধ্যেই স্বামীজিকে বোধন করে খ্রিস্ট-ধর্মকে অতিক্রম করে গেলো, এক নীরব বিপ্লবের মধ্যে, এবার তারই সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। একেই বলে সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদ। বড়দিন আর ইংরেজি বছরের প্রথমদিনটি যথাক্রমে স্বামীজি ও পরমহংসময় হয়েই থাকবে!

সেভাবেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের দিনটিকেও অতিক্রম করে সনাতনী পরত মাখিয়ে দিন। কে আছেন সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী কার্যকর্তা? যে ভালোবাসা চিরন্তন, যে ভালোবাসা হতে পারে নিখাদ, যে ভালোবাসা হতে পারে একেবারেই নিঃস্বার্থ — তাই ১৪ ই ফেব্রুয়ারি জুড়ে বসুক ভারতবর্ষে, পিতৃমাতৃ পূজন দিবস হিসাবে। আর দেহবাদের ভালোবাসার দিনটি হোক ১ লা ফাল্গুন।
১৪ ই ফেব্রুয়ারিকে আমরা অস্বীকার না করেই দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে পারি পিতামাতার স্নেহাশীর্বাদের অকৃত্রিমতা। ভালোবাসার জয় এভাবেই হোক ভারতীয় রীতিতে। পিতামাতাকে ভালোবাসার দিন; পুত্র-কন্যা, পৌত্র-পৌত্রীকে ভালোবাসার দিন হোক ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। ঔপনিবেশিকতার পরাজয় এভাবেই ঘটুক। তার পরই ১ লা ফাল্গুন অশোক ফুলের মঞ্জরী দিয়ে পালিত হবে ভারতীয় প্রেমের দিবস, বসন্তোৎসব।

গোলাপ দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়, অশোক-পরশে ১ ফাগুন হবে।
ভারতবর্ষ প্রেমের উৎসব আদি-অনন্ত কাল ধরে করে এসেছে — ফাগুনের অশোক রঙের নেশায়। ভ্যালেনটাইন’স ডে আমাদের কাছে দেশীয়-সংস্কৃতি-ভোলানো পাশ্চাত্য-মদিরা মাত্র। আমাদের চির যৌবন চাঞ্চল্য নিয়ে আসে অশোকে রাঙিয়ে — আমরা তাই অদ্ভুত আনন্দে বেড়া ভাঙ্গি, ঝঞ্ঝায় বাঁধন ছিন্ন করে দিই, জীবন-যুদ্ধে মরণ-পণ লড়তে প্রেরণা পাই। আমাদের সেই দিনগুলি ফিরিয়ে দিক অশোক মঞ্জরীর পুষ্পার্ঘ্য নিয়ে আসা প্রেমিক/প্রেমিকারা। Rose-Day -র পেলবতা, অপর-সংস্কৃতি নয়। চাই অশোক-পরশ।

“আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।
আমরা বেড়া ভাঙি,
আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি,
ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই– আমরা বিদ্যুৎ॥
আমরা করি ভুল–
অগাধ জলে ঝাঁপ দিয়ে যুঝিয়ে পাই কূল।
যেখানে ডাক পড়ে জীবন-মরণ-ঝড়ে আমরা প্রস্তুত॥”

অশোকপরশ কেন, রোজ-ডে কেন নয়!

“সেকালে মেয়েদের পায়ের ছোঁয়া লেগে ফুল ধরত অশোকে, মুখমদের ছিটে পেলে বকুল উঠত ফুটে, আমার বাগানে সেই কালিদাসের কাল দিয়েছে ধরা” (মালঞ্চ উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। ভারতীয় সংস্কৃতিতে অশোক ফুল হচ্ছে প্রেমের প্রতীক, তাই কামদেবের পঞ্চশরের অন্যতম শর অশোক মঞ্জরী, যে বাণে বিদ্ধ করা যায় নারী অথবা পুরুষের প্রেম-মনন। অশোকের ফুলের অনবদ্য রঙ কখন নিজের মনকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়,
‘তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার
অকারণের সুখে।’
ফাগুনের বসন্তে অশোকের ফুল ফোটে, তাই ১ লা ফাল্গুন হোক ভারতীয় প্রেমের দিন, অশোকপরশ, Asoca Day। অশোক ফুলের আদিনিবাস ভারতবর্ষ। এটি ভারতবর্ষের স্বাভাবিক উদ্ভিদ। ভারতের কুসুমোদ্যানে তার অমল উপস্থিতি।
অশোক গাছের উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Saraca asoca, এটি Fabaceae গোত্রের উদ্ভিদ। এরই অন্য নাম হেমাপুষ্প কিংবা মধুপুষ্প। রামায়ণে উল্লেখ্য আছে রাবণ সীতাকে বিবাহ করবার উদ্দেশ্যে হরণ করে অশোক কাননে রেখেছিল, যাতে সীতার হৃদয়ে প্রেমের উদ্রেক ঘটে। হিন্দু বিশ্বাস, অশোক ফুল শোক নাশ করে, তাই এর নাম অশোক। অশোক গুচ্ছ উপহার দিয়েই তাই প্রেমের জোয়ারে ভাসুন, প্রেমের আনন্দের সঙ্গে দূরে যাক যাবতীয় দুঃখ-শোক। প্রেম জয়ী হোক, সফল হোক, চিরস্থায়ী হোক। আর প্রেমসম্ভোগের কারণে আবির্ভূত সন্তানের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হোক। তাই তো চৈত্র মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে মায়েরা সন্তানের কল্যাণ কামনা করে অশোক ফুল দিয়ে পূজা করেন, একে অশোকষষ্ঠী বলে। চৈত্রের শুক্লাঅষ্টমীতে পালিত হয় অশোকাষ্টমী। দু’টি দিনই বসন্তের ঋতুতে।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.