জনহীন ভাঙা ভবনে। তব জনহীন ভবনে
থেকে থেকে আসে ব্যাকুল গন্ধ
নববসন্তপবনে।
যে ফুলে রচেনি পূজার অর্ঘ্য,
রাখে নি ও রাঙা চরণে,
সে ফুল ফোটার আসে সমাচার
জনহীন ভাঙা ভবনে। জনহীন ভাঙা ভবনে।
ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির সরকার বংশ কর্তৃক ১৬৯৪ শকাব্দ বা ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার পরিবারের উত্তরাধিকারীগণ এখনও মন্দিরের নিত্যসেবা আয়োজন করে থাকেন। মন্দিরটির কার্নিশে অবস্থিত প্রতিষ্ঠালিপিটি , যদিও এখন মহাকালের নিয়মে ক্ষতিগ্রস্থ তবু তার প্রতিষ্ঠাকালটি এখনো দৃশ্যমান অবস্থায় আছে।
মন্দিরটি ত্রিখিলান যুক্ত প্রবেশদ্বারসহ দক্ষিণ মুখী অবস্থান করছে। দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট এবং প্রস্থে ২৩ ফুট। এই মন্দির গাত্র অলঙ্কৃত হয়েছে কৃষ্ণ কাহিনী, রামায়ন কাহিনী , দেবদেবী, দুর্গা ইত্যাদির সুন্দর সুন্দর পোড়ামাটির ফলক দ্বারা।
সড়ক পথে ভালিয়া যেতে গেলে তারকেশ্বর – আরামবাগ রাস্তায় এসে মুথা ডাঙা থেকে শ্যামসুন্দর যাবার রাস্তায় পরবে ভালিয়া।অন্যদিকে বর্ধমান আরামবাগ সড়কপথে পহলানপুরের পরেই রাস্তার ধারেই ভালিয়া গ্রাম। রেলপথে যেতে হাওড়া আরামবাগ রেলপথে মায়াপুর স্টেশনে নেমে যেতে হয়।
আলোচ্য ভালিয়ার আটচালা রঘুনাথ মন্দিরের উল্লেখ করেন David J McCutchion তাঁর Late Mediaeval Temples of Bengal গ্রন্থে। তিনি অষ্টাদশ শতক বা তার পূর্ববর্তীকালে প্রচলিত হুগলি বর্ধমান ধারার আটচালা মন্দির শৈলীতে ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দিরকে তালিকা ভুক্ত করেছেন।
Geogre Michell – এর সম্পাদনায় Brick Temples of Bengal : From the Archives of David McCutchion বইটিতে ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দিরের বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলকগুলির বর্ণনা পাওয়া যায়।
৭০ এর দশকে শ্ৰী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় হুগলি জেলার পুরাকীর্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত গ্রন্থ ” হুগলী জেলার পুরাকীর্তি ” । সেই গ্রন্থে তিনি ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দিরের সম্পর্কে আলোচনা করেন। এছাড়া সেভাবে এই মন্দির নিয়ে তেমন একটা আলোচনা বা চর্চা আর বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে না। এমনকি আজও যাঁরা বাংলার অন্ত মধ্যযুগীয় টেরাকোটার মন্দির নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের নিকটও এই মন্দির নিয়ে আলোচনা খুবই কম শোনা যায়।
তবে হ্যাঁ ,বিক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা চোখে পড়েছে শ্ৰী অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়, শ্ৰী অজয় কোনার , শ্ৰী অমিত গুহ প্রমুখের লেখায়। তুলনায় হুগলি জেলার অন্যান্য পোড়ামাটির বা টেরাকোটার মন্দির কিন্তু যথেষ্ট প্রচারের আলোয় রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ আঁটপুরের আটচালার রাধাগোবিন্দ জিউ এর মন্দির।
ষোড়শ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলার পোড়ামাটির ভাস্কর্য এক বিশিষ্ট উচ্চতার শিখর আরোহণ করেছিল। ষোড়শ শতকের বাংলার পোড়ামাটির ভাস্কর্যে যে শিল্পশৈলী দেখা যায় সেগুলি মূলত লো রিলিফ ভাস্কর্য। যেমন – বিষ্ণুপুর রাসমঞ্চ , পুরুলিয়ার আচকোদার রঘুনাথ মন্দির , বর্ধমানের বৈদ্যপুর দেউল।ভাস্কর্য লো রিলিফ হলেও শিল্পশৈলীর মধ্যে এক অদ্ভুত নান্দনিকতা রয়েছে টেরাকোটার মন্দিরগুলির কারুকাজের মধ্যে।
অন্য দিকে অষ্টাদশ শতকের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের মন্দিরের পোড়ামাটি বা টেরাকোটার ভাস্কর শৈলী ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে। সে পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় জ্ঞানের অভাবই হোক বা ভাস্কর্যের মধ্যে একটি আড়ষ্টভাবই হোক – বিষয় ভিত্তিক বিন্যাস থেকে শুরু করে শিল্পশৈলীর বিস্তার – সর্বত্রই এক অবক্ষয়ের ছবি দেখা যায়।
কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় যেসব পোড়ামাটির মন্দির নির্মাণ হয়েছে তাতে দেখা যায় ভাস্কর্যের লো রিলিফ এবং হাই বাস রিলিফ উভয়ই বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করেছে। যেমন – নদীয়ার দিগ্ নগরের রাঘবেশ্বর মন্দির , চাকদহের পালপাড়া শিব মন্দির ইত্যাদিতে লো রিলিফ ভাস্কর্য দেখা যায় তেমনই ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঘুড়িষার রঘুনাথজীর মন্দির হাই বাস রিলিফের উৎকর্ষতার একটি চমকপ্রদ নিদর্শন। এই সময়কালের পোড়ামাটির মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে শিল্পীর শাস্ত্র জ্ঞান ,শিল্প চেতনা নান্দনিক বোধ এবং পৌরাণিক সামাজিক চেতনার মেল বন্ধন ঘটেছিল।
অষ্টাদশ শতকে , বিশেষত মধ্য অষ্টাদশ শতকের নিকটবর্তী সময় ভাস্কর্যশৈলী রূপ নিয়েছে এক পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্যের। উক্ত ভালিয়া গ্রামের রঘুনাথ মন্দিরের ভাস্কর্যকে ঠিক রিলিফ ভাস্কর্য বলা চলে না। এগুলি সম্পূর্ন ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য। এই কারনেই অন্যান্য সব মন্দিরের থেকে রঘুনাথ মন্দিরটি আলাদা ও স্ব মহিমায় উজ্জ্বল।
রঘুনাথ মন্দিরের পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্যের সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত কালনার কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। সব থেকে অবাক করা কথা হল এই যে এই কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরটি নিয়েও কালনার অন্যান্য মন্দির গুলির তুলনায় কম আলোচনা হয়েছে। অথচ এই দুই মন্দিরেই এমন কিছু ফলক আছে যেখানে মন্দিরের ভিত্তিভূমি থেকে মূর্তিগুলি প্রায় সোয়া ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি , কোথাও কোথাও দুই ইঞ্চি অবধি উঠে এসেছে।
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির : একটি রচনা