থিমের বাইরে বেরোতেই পারছে না বাঙালির দুর্গাপুজো।

থিমের পূজা নিয়ে বাঙালির “ন যযৌ ন তস্থৌ” অবস্হা। না পারছে অতিক্রম করতে, না আছে থেমে! থিমে নতুনত্ব আনতে গেলে সনাতনী হিন্দু ধর্মকে বেইজ্জত করতেই হবে, যেমন জুতোর প্যাণ্ডেল নির্মাণ, যেমন মা দুর্গার অস্ত্রবিহীন মূর্তি। কথায় বলে, বাঙালির মনে ধরলে ৩৪ বছর লাগে তা দূর হতে। বাঙালির স্থিতিজাড্য প্রবল।

নানান জায়গায় আলোচনা করেছি থিম্পূজার মধ্যে আদৌও শাস্ত্রীয় আচরণ নেই। থিম্পূজায় হিন্দু সংস্কৃতির পরত নেই। মায়ের অস্ত্র ছাড়া কোনো পুজোই বৈধ নয়। তার উপর যোগ হচ্ছে পুরোহিত বিতর্ক। নীতিগত প্রশ্ন উঠছে, রাজনৈতিক দলগুলি দুর্গাপুজো করতে পারে কিনা? এটা তাদের কাজ কিনা!

আলোচনার শুরুতে গৌরচন্দ্রিকা না করে বলা ভাল, রাজনৈতিক দলের কাজ নয় দুর্গাপূজা করা। বামেরা তাই একটাও পূজা করে নি। অথচ রাজ্যের সিংহভাগ পুজোর দখল নিয়েছিল। এখন বামেরা যা করবে, তার কপি-পোস্ত রান্না (পড়ুন Copy-paste) অন্য দল হয়তো করবে না। পুজোর ফর্দ-তৈরি, শুরু থেকে শেষ অবধি বারোয়ারী তলায় চেয়ার পেতে বসে থাকা মানে বুঝে নিতে হবে, দলের কাছে করার মতো অন্য কোনো কাজ আপাতত হাতে নেই। পুজোর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিবিধ শাস্ত্রীয় আচার ভাঙতে হলে অথবা অতিক্রম করতে হলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আধ্যাত্মিক জগতের দিকপালেরা নানান দিক পর্যালোচনা করে শাস্ত্রীয় যুক্তিজাল বিস্তার করে তবেই এগোতে পারবেন। রামমোহন অথবা বিদ্যাসাগর মহোদয় সতীদাহ প্রথা রদ অথবা বিধবাবিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে শাস্ত্রীয় সলিলে অবগাহন করেছিলেন বলেই তা পেরেছেন। তাছাড়া তাঁরা উভয়েই ছিলেন ব্রাহ্মণ। সমাজ বরাবর এটা দেখতেই অভ্যস্ত, একজন শাস্ত্রজ্ঞ-ব্রাহ্মণ শাস্ত্রীয় বিচার বিশ্লেষণ করে ব্রাহ্মণ্য-বিধান অতিক্রমের নিদান দেবেন। তা না হলে সেটা জনযুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। রাজাই যদি রাজতন্ত্র ভাঙেন, সেটাই প্রজায় ধরে বেশি। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের রাজা নিজেই নিজের জাল কেটে বেরিয়ে আসেন। তবেই সমাজে সুদিন আসে।

যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে ‘ব্রাহ্মণ’ পদবাচ্য হন, অব্রাহ্মণেরও ব্রাহ্মণত্ব পাবার অধিকার আছে। তাই পূর্বে নিজেকে দ্বিজ সংস্কারের মাধ্যমে ‘ব্রাহ্মণ’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া চালাতে হবে। এটি একটি ধীর-ধারাবাহিক বহুমুখী প্রক্রিয়া। স্টেপ জাম্প করার ব্যাপার নেই। হালুম করে বাঘ পড়ার মতো ব্যাপার এটা নয়!

বাংলার বামপন্থী ‘বুদ্ধিজীবী’দের সম্পর্কে খোঁজ করে দেখেছি, তারা যাবতীয় দুর্বুদ্ধি কেবলমাত্র হিন্দু ধর্মের উপর প্রয়োগের সুযোগ খোঁজেন। কারণ এটা এক নিরাপদ প্রক্রিয়া। যারা বিপ্লব করেন, তারা বুঝে গিয়েছেন, হিন্দুরা “সাত চড়ে ‘রা কাটে না।”
তাই তাদের যত্ত এক্সপেরিমেন্ট হিন্দুদের নিয়ে। অথচ হিন্দু ধর্ম নিয়ে কোনো আবেগ তাদের নেই, সদর্থক অনুভূতিও নেই। ইসলাম সম্পর্কে ‘রা’ কাটার ক্ষমতা তাদের নেই, কোনোদিন ছিলও না, তারা অত বোকাও নন যে কাটবেন! ফলে ধর্মীয় বিপ্লবের জন্য পড়ে রইলো হিন্দুত্ব!

এক সন্তানের জনক-জননী যেমন তাদের সন্তানকে একই সঙ্গে লেখাপড়া, কুইজ, গান, যন্ত্র-সঙ্গীত, আবৃত্তি, অঙ্কন, সাঁতার, ক্যারাটে, দাবা, ব্যাডমিন্টন সবেতেই ‘বৃহস্পতি’ বানাতে চান, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদেরও যাবতীয় নিদান হিন্দু ধর্মের উপর। সময়ে-অসময়ে বিপ্রতীপ বার্তা, বিপ্লবী-বাণী হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে তারা উগরান। এ এক দারুণ মনস্তাত্ত্বিক ও মজার ব্যাপার! নিন্দুকেরা বলেন “ঝি-কে মেরে বউকে শাসন করে পুরুষ”, তেমনই হিন্দুধর্মে গাল পেড়ে, বিপ্লবী হয়ে আগ্রাসী-অহিন্দুকে সহবত শেখাতে চান ‘দুর্বুদ্ধিজীবী’। তবুও “সে গুড়ে বালি”! যে মতামত শোনার অপেক্ষায় নেই, বিধির বিধান মানবে না, তাকে কীভাবে শোনাবেন? বিপ্লবী, বুদ্ধিজীবী বাঙালি চান বাংলায় পূজার মন্ত্রে অঞ্জলি হোক বাংলায়, কিন্তু আজান হোক বাংলায়, এটা চান না। বুদ্ধিজীবীরা ধর্মকে ‘আফিম’ বলেন, কিন্তু মন্ত্রের বঙ্গানুবাদ করেন ‘ঘেটে ঘ’ করার জন্য। এটাই বাঙালির ‘গর্গল’ পক্ষ।

এরাই হিন্দু নারীকে স্বাধীনতার নামে প্রথার বিরুদ্ধে বসিয়ে দেন। কিন্তু মুসলিম মহিলাদের ব্যাপারে অসম্ভব রকমের নীরব। হিন্দু দেবদেবীর ন্যাংটো ছবিকে শিল্প বলেন, কিন্তু প্রতিবেশী-ধর্মের পয়গম্বরের ছবি নিয়ে নীরব। এই ‘শিষ্ট বাঙালি’-র একটি ধারা আবারও বাংলায় পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র আওড়াবেন। অপর শাখাটি হয়তো অব্রাহ্মণ মহিলাকে দিয়ে দুর্গাপূজা করাবেন।

চিন্তাশীল শাস্ত্রজ্ঞরা বলছেন, এগুলি পুরোটাই ‘স্টাণ্টবাজি’। সমাজ সংস্কারের যে গতি ও প্রকৃতি, সেই অনুসারে অন্দরমহল থেকে প্রেক্ষাপট রচনা না করিয়ে সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিলে চলে না। ব্রহ্মজ্ঞ-অব্রাহ্মণ অথবা বিদুষী নারীর জন্য উপবীত ধারণের সংস্কার কাজের আয়োজন না করে, চটজলদি দুর্গাপূজায় পৌরোহিত্যের ডাক দেওয়া দীর্ঘদিনের বামপন্থী মস্তিষ্ক। এর ক্রেডিট যদি নিতে হয়, তবে তা নাম-না-জানা অজস্র বামপন্থী বুদ্ধিজীবীকে দেওয়া উচিত। নতুন বোতলে পুরনো মদ নয়!

বাংলা ভাষার জননী ‘সংস্কৃত’। পরিবারে পিতামহ-পিতামহী জীবিত থাকতে পারিবারিক শুভকাজের আমন্ত্রণ পত্রে যেমন পিতা-মাতার নামে আমন্ত্রণ চলে না, তেমনই সংস্কৃত ভাষা জীবিত থাকতে, বাংলা ভাষায় পুজোর কাজও হয় না, হতে পারে না। ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সমস্ত ভাষাভাষী, গোষ্ঠী ও রাজ্যগুলিকে যেমন এক সাংস্কৃতিক-মাল্যে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে সংস্কৃত ভাষা, এক অখণ্ড চৈতন্য বিস্তারের সহায়ক হয়েছে, তাই সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলা মন্ত্রোচ্চারণ সেই কাঠামোকে ভেঙে ফেলার নামান্তর হবে। এটা বাট্টুবাজ বামপন্থী ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। ব্যাকফুটে থাকা সিপিএম ও তার দোসরেরা এই ন্যারেটিভের পিছনে রয়েছে। কিছু সনাতনীরা না বুঝেই চিল চিৎকার দিচ্ছেন, পক্ষ-বিপক্ষ করছেন। আরে, সময়টা খুব খারাপ! পচা শামুকে যাতে পা না কাটে দেখতে হবে বৈকি!

যদি ব্রহ্মজ্ঞানী বিশিষ্ট অব্রাহ্মণকে দিয়ে মাতৃশক্তির আরাধনা করাতে চান, তবে আগে ম্যারাপ বেঁধে বেশ কয়েকটি গণ-উপনয়ণের ব্যবস্থা করুন মশাই। সামাজিক আন্দোলন হোক না, সাহস আছে? আর এ কাজ সরাসরি দলের নয়, বিবিধ সংগঠনের। দয়া করে স্টেপ জাম্প করবেন না, পা ভাঙার সমূহ সম্ভাবনা তবে। আমিও চাই যোগ্য, উপযুক্ত জ্ঞানী মানুষ উপবীত ধারণ করুন। যদি উপবীত ধারণেই আপত্তি থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আয়োজকেরা আদতে উপবীতধারীদের বিরোধী। সেখানে যুক্তি-তর্ক-গল্প নিষ্প্রয়োজন।

মনে রাখবেন দেবী দুর্গা এক মাতৃশক্তি। মাতৃদেবীর পূজায় বসেন, পৌরোহিত্য করেন পুরুষ। এখানে নারীকেই সম্মানিত করা হল। নারীর জয়গান গাওয়া হল। তাছাড়া মায়েরা হিন্দু বাড়িতে নিত্যই পূজার্চনা করেন। সেখানে নতুন করে তাদের অধিকার দেওয়ারও কিছু নেই। ব্রতপালনের ক্ষেত্রে ব্রতিনীরা নিজেরাই পুজো করে এসেছেন হাজার হাজার বছর ধরে। পৌরোহিত্যের প্রথম শর্তই হল উপবীত নিতে হবে! পৈতা থাকতে হবে। সেই পৈতে পরার আয়োজনের ডাক কেন দিচ্ছেন না? আসল বিরূপতা কী পৈতেতে? যা বামপন্থীদেরও মূল আলোচ্য! মহিলারা পুজো করতে পারেন কিনা, অব্রাহ্মণ পুজো করতে পারেন কিনা, তা নিয়ে মনুস্মৃতি ১/৮৮, কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে ১/৩/৫ আলোচনা আছে। পৈতা ছাড়া বৈদিক, স্মার্ত, পৌরাণিক ক্রিয়া করা যায় না। সেইজন্য মঠে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী পূজা সন্ন্যাসীরা করেন না! সন্ন্যাসীর পূর্বাশ্রমে দ্বিজ সংস্থার থাকলেও করেন না, নিজের পিণ্ডি দান করেই তাঁকে সন্ন্যাসী হতে হয়। তাই পুজো ও পৌরোহিত্য করা যায় না।

আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, পুজো এলেই সেকুলার ও বামপন্থী কিছু লোক দুর্গাপূজার নানান আচারকে বিকৃত করার চেষ্টা করছেন। মণ্ডপ অপবিত্র করছেন, অনাচার করছেন। মণ্ডপ জুতো দিয়ে সাজিয়ে তার পবিত্রতা নষ্ট করছেন। পবিত্রতা নষ্ট হলে মন থেকে শ্রদ্ধা বোধও নষ্ট হয়। সেকুলারি হিসেব ওটাই! এ এক গভীর এবং সুদূর প্রসারী চক্রান্ত। কেউ মণ্ডপে আজান বাজানোর বায়না করেন, কিন্তু বিপরীত দাবী তোলেন না! দেবীর প্রতিমা বিকৃতি করা বাঙালি শিল্পীর এক বহু পুরাতন রোগ। এরকম নানান রোগে ভুগছে বাঙালি হিন্দু। তারমধ্যে রোগের তীব্রতা বাড়াতে কেউ কেউ ‘ঘেঁটে ঘ’ করছেন৷ তারা কি জেনে বুঝে করছেন, নাকি তারা বামপন্থী; পন্থা-বীজের অঙ্কুর বার করাচ্ছেন! এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন!

দুর্গাপূজায় মানুষের সঙ্গে মিশতে চান? স্টল খুলে বসুন, হিন্দুধর্মের বই রাখুন, সরকারের কাজের ফিরিস্তি দিয়ে বড় বড় ব্যানারে দর্শনার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করুন, লিফলেট বিলি করুন, ঘোষণা করুন দুর্গাপূজার গাম্ভীর্য নষ্ট হতে দেবেন না। লড়াই হোক ‘গাম্ভীর্য-বিনাশ’ বনাম ‘গাম্ভীর্য-দলন’ এর মধ্যে? আপনি কোন দলে? এমন আচরণ করবেন না, যাতে হিন্দুদের দুর্গাপূজার প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ঘোরার বদলে প্যাণ্ডেল-পাহাড়া দেবার দিন আসে!

কল্যাণ গৌতম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.