বসন্তের বাহার বাহা দ্বিতীয় পর্ব

চিত্রাঙ্গদা।

  তুমি পঞ্চশর?

মদন।

                       আমি সেই মনসিজ,

             টেনে আনি নিখিলের নরনারী-হিয়া

              বেদনাবন্ধনে।

চিত্রাঙ্গদা।

                           কী বেদনা কী বন্ধন

              জানে তাহা দাসী। প্রণমি তোমার পদে।

              প্রভু, তুমি কোন্‌ দেব?

বসন্ত।

                                   আমি ঋতুরাজ।

              জরা মৃত্যু দৈত্য নিমেষে নিমেষে

              বাহির করিতে চাহে বিশ্বের কঙ্কাল;

              আমি পিছে পিছে ফিরে পদে পদে তারে

              করি আক্রমণ; রাত্রিদিন সে সংগ্রাম।

              আমি অখিলের সেই অনন্ত যৌবন।  

বাহা উৎসব, রঙের উৎসব, প্রকৃতির রঙের উৎসব। বাহা উৎসব ফুলের উৎসব। বাহা উৎসব ঈশ্বর প্রদত্ত ভেষজ ওষধির উৎসব। বাহা পরব পালিত হয় তিনটি বসন্ত দিন….প্রথম দিনকে #উম বলে । উম অর্থাৎ স্নান করা।অর্থাৎ , গৃহবাস , বস্ত্রাদি মার্জনা করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা। পরিছন্নতা নিয়ে আসে শুচিতা। শুচিতা বহন করে আনে শুভের বার্তা। সে সদা মঙ্গলময়।

আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

দ্বিতীয়দিনকে বলা হয় #সারদি । এটি মূল বাহা পরবের দিন। তৃতীয় দিনকে বলা হয় #সেন্দরা।

উমের দিন গ্রাম্য যুবকরা ” জাহের থানে ” চারিটি খুঁটি পুঁতে ছাউনি দেওয়া হয়। জাহের থান সাধারণত শাল কুঞ্জ বেষ্টিত একটি ফাঁকা থান। এখানে রাঢ়ের জনজাতি সম্প্রদায় পূজার সময় দুইটি ছাউনি বাঁধে।একটি জাহের এরা মা, মারাংবুরু এবং মারেক তুরুয়ক এর উদ্দেশ্যে আর একটি গোঁসাই- এর উদ্দ্যেশ্যে।নায়কে বা লায়া সমস্ত দেবস্থান গোবর নিকিয়ে আসে। এইদিন বাড়ির ভিতর সব কিছু যেমন – কুলা, কাঁচি, তীরধনুক , তরবারি , ঝাঁটা ,ঝুড়ি ইত্যাদি ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। নায়কে বা লায়া সাত্ত্বিক আচারে থাকেন। রাতে মাদুর বা খড় পেতে মাটিতে শুয়ে রাত্রি যাপন করেন।

মোর অঙ্গে অঙ্গে যেন আজি বসন্ত-উদয়

      কত        পত্রপুষ্পময়।

           যেন মধুপের মেলা

           গুঞ্জরিছে সারাবেলা,

           হেলাভরে করে খেলা

                  অলস মলয়।

           ছায়া আলো অশ্রু হাসি

           নৃত্য গীত বীণা বাঁশি,

           যেন মোর অঙ্গে আসি

                  বসন্ত-উদয়

      কত           পত্রপুষ্পময়।

সন্ধ্যায় নায়েকের বাড়িতে নাগাড়া বাজে , শিঙ্গা বাজে।লোকবিশ্বাস যে , এই নাগাড়া এবং শিঙ্গার শব্দ শুনে কিছু লোকের উপর দেবতা ভর করেন। সাঁওতালিতে একে #রুমবঁগা বলা হয়। তিনজন সাধারণত রুমবঁগার ভর পায়। একজন জাহের , দ্বিতীয়জন মারেক তুরুয়ক, তৃতীয়জন মারাংবুরুর ছদ্মবেশ। জাহের ছদ্মবেশে যে ব্যক্তি রুমবঁগার ভর পায় সে তাড়াতাড়ি চুরি পরে, খাঁচি মাথায় নেয় ও হাতে ঝাঁটা নেয়। যে ব্যক্তি মারেক তুরুয়ক ছদ্মবেশে দেবতার ভর পায় সে তীর ধনুক ধারণ করে, আর যে মারাং বুরু ছদ্মবেশে দেবতার ভর পায় সে তরবারি ধরে।এই ভর পাওয়া ছদ্মবেশী দেবতারা জাহের থানে দৌড়ে চলে যায়।নায়কে ছদ্মবেশী দেবতাদের হাতে এক মুঠো করে আতপ চাল দিয়ে গাঁয়ের সুখ দুঃখের খবর নেয়।গ্রামের কোনো অমঙ্গল হবে কিনা বা অমঙ্গলের কোনো রূপ আশঙ্কা থাকলে তাও জানিয়ে দেয়।

এইভাবে গাঁয়ের সুখ দুঃখের খবর নেবার পরে আতপ চাল ফেরত নেওয়া হয়। নায়কে ছদ্মবেশী দেবতাদের পা ধুইয়ে দেন।অবশিষ্ট জল সকলকে ছিটিয়ে দিলে দেবতারা চেঁচিয়ে ওঠে। নায়কে তখন তাদের শান্ত করায় – ” ওগো গোঁসাই এবার বেলা হল। বাতি ধরেছে। ঘোড়া এবার ক্লান্ত হল। এবার তোমরা শান্ত হও। আমাদের এই সামান্য নৈবেদ্য নিয়ে শান্ত হও।”

নাগাড়া, শিঙ্গা বেজে ওঠে। দেবতারা শান্ত হয়। ঠিক তখনই দ্রিধিম দ্রিম দ্রিম ….. হো হো হো …নাচ গানের আসর শুরু হয়। নির্জন অরণ্যের সুগভীর কেন্দ্রস্থলে একটা সুনিবিড় সম্মোহন আছে যেখানে চলছে তার বুড়ো বুড়ো গাছপালার কানে কানে চক্রান্ত, যেখানে ভিতরে ভিতরে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে সৃষ্টির আদিম প্রাণের মন্ত্রগুঞ্জরণ। দিনে দুপুরে ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে তার সুর উদাত্ত পর্দায়, রাতে দুপুরে তার মন্ত্রগম্ভীর ধ্বনি স্পন্দিত হতে থাকে জীবচেতনায়, বুদ্ধিকে দেয় আবিষ্ট করে। জিয়লজি-চর্চার ভিতরে ভিতরেই মনের আন্তর্ভৌম প্রদেশে ব্যাপ্ত হচ্ছিল এই আরণ্যক মায়ার কাজ। হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠে সে এক মুহূর্তে আমার দেহমনকে আবিষ্ট করে দিল যখনই দেখলুম অচিরাকে কুসুমিত ছায়ালোকের পরিবেষ্টনে।

যায় যাক্‌, যায় যাক্‌, আসুক দূরের ডাক,

            যাক ছিঁড়ে সকল বন্ধন--

চলার সংঘাত-বেগে সংগীত উঠুক জেগে

            আকাশের হৃদয়-নন্দন।

       মুহূর্তের নৃত্যচ্ছন্দে ক্ষণিকের দল

       যাক পথে মত্ত হয়ে বাজায়ে মাদল।

অনিত্যের স্রোত বেয়ে যাক ভেসে হাসি ও ক্রন্দন,

                 যাক ছিঁড়ে সকল বন্ধন।

আদিম জনজাতির ধামসা মাদলের তালে তালে নাচের সঙ্গে গান শুরু হয় সুর বাহাতে-

হেসাঃ মা চটেরে
জা গোঁসায় তুদে দয় রাগে কান
বাড়ে মা লাওয়ের রে
জা গোঁসাই গুতরুৎ দয় সাঁহেদা।

অশ্বথ্ বৃক্ষের চূড়ায় তুৎপক্ষি ডাকে ওই। হে প্রভু বটের ঝুড়ির ছায়ায় গুতরুৎ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পৃথিবীর সব কিছু চলমান। সত্যি সত্যি আহ্নিক ও বার্ষিক গতি ঘটছে।

এমনি করে নাচগান ,বাদ্য বাজনা চলে সারারাত ধরে।নায়কে সেদিন তার স্ত্রীকে স্পর্শ করে না। তারা পৃথক পৃথক মেঝেতে শয়ন করে।

বসন্ত বাহারে জ্যোৎস্না রাতে চোখ গেল পাখির অক্লান্ত শব্দে, মৃদুবাতাসে মহুয়া ফুলের গন্ধের তোড়ে রাত ভোর হয়। কোকিলের বাসন্তিকা রাগে সারা রাঢ়বঙ্গ , শালপিয়াল মহুল শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়ার অরণ্য ও আরণ্যকরা জাগ্রত হয়।

কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে

 আজ            ফাগুন-দিনের সকালে।

        তার    বর্ণে তোমার নামের রেখা,

                 গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,

                    সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে

                           আজ     ফাগুন-দিনের সকালে।

উমের পরের দিন হল মূল বাহা পরব। বাহার এই দ্বিতীয় দিনের নাম সারদি মাহ। নায়কে বাবা তার অনুচরদের নিয়ে ধামসা , মাদল ,তীর, ধনুক , কাপি করসি হাপা ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে জাহের থানে উপস্থিত হয়। কাপি, কারসি, হাপা এগুলো দেবতাদের অস্ত্র শস্ত্র। জঙ্গল হতে শাল পুষ্প আহরণ করে আনা হয়। পূজার উপকরণ হিসাবে আতপ চাল ,তেল , সিঁদুর, ধুপধুনা ইত্যাদি লাগে।আর লাগে একটি সাদা মোরগ, একটি মিশ্র রঙের মোরগ এবং কয়েকটি অন্য রঙের মোরগ।

নায়কে জাহের থানে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে কোনো জলাশয়ে স্নান সেরে পবিত্র এক বস্ত্রে থাকে। পূজার স্থানটি গোবর জল দিয়ে নিকিয়ে নিয়ে শুদ্ধ বেদী রচনা করা হয়। তার উপর বৃত্তাকার আলপনা অঙ্কিত হয়। এটি আসলে পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করার ইঙ্গিত।

৩৬৫ দিনে এক #সেরাম বা বৎসর বলতে পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে একবার বিচরণ পূর্ণ করলে এক একটি বসন্ত , এক একটি ঋতু আসে এই ধরাধামে।

সেই যে ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে –

শং নো ধাতা শমু ধর্তা নো অন্তু শং ন উরূচী ভবতু স্বধভিঃ।
শং রোদ্যসী বৃহতী শং নো আদ্রিঃ শং নো দেবানাং সুহবানি সন্তু।।

এর মধ্যে দিয়েই আসে পরবর্তী উৎসবের আগমনী বার্তা। সেই কোনো প্রাচীন ভারতের সুপ্রাচীন জাতি জনজাতি এটাই প্রমান করে আসছে পৃথিবী গোল, সে নিজের অক্ষের উপর আবর্ত মান। কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে আর্বতন করতে সময় লাগে এক বসন্ত থেকে আর এক বসন্ত।

বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির ‘পরে কী আদরে॥

তাই সে ধূলা ওঠে হেসে বারে বারে নবীন বেশে,

বারে বারে রূপের সাজি আপনি ভরে কী আদরে॥

তেমনি পরশ লেগেছে মোর হৃদয়তলে,

সে যে তাই ধন্য হল মন্ত্রবলে।

তাই প্রাণে কোন্‌ মায়া জাগে, বারে বারে পুলক লাগে,

বারে বারে গানের মুকুল আপনি ধরে কী আদরে॥

নায়কে যখন জাহের থানের উদ্দেশ্যে রওনা হয় তখন যুবক যুবতীরা নাচগান করতে করতে যায়। দ্রিম দ্রিম মাদল বাজে, ধুদুম হুদুম ধামসা বাজে….গুন গুন গান হয় সুর বাহাতে।

তকয় দকিন সাজাও এনা।
জাহের থানেতে
জাহের থানে তেদ নায়ো
সারি সরজাম দারে বুটিতে।

কারা সাজে জাহির থানের উদ্দেশ্যে , কারা রওনা দেয় পবিত্র শালগাছের নীচে ? কিসের জন্য সাজ সাজ রব জাহিরা থানে কিসের জন্য সমবেত পবিত্র শাল গাছের নীচে?

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজ : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে

প্রকৃতিককেন্দ্রিক লোক উৎসব : বাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.