পাঁচ হাজার বছরেরও পুরনো সময় থেকে পরবর্তী পাল, সেনযুগ পর্যন্ত সময়কার ঐতিহাসিক নিদর্শন মিলেছে বারবারই। সুন্দরবনের (Sunderban) নদী তীরবর্তী এলাকায় এখনও মাঝেমধ্যেই হদিশ মেলে প্রত্নতাত্ত্বিক (Archeological sites)বহু সামগ্রীর। সেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে মৌর্য, শুঙ্গ ও কুষাণ যুগ এমনকী, পাল-সেন যুগের সময়কার বলেই দাবি প্রত্নতত্ত্ব গবেষকদের। বছরের পর বছর ধরে সংগ্রহ করা সেসব অমূল্য নিদর্শন পরম যত্নে ঠাঁই পেয়েছে সুন্দরবন প্রত্ন গবেষণাকেন্দ্রে।বঙ্গোপসাগরের মুখেই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত পাথরপ্রতিমার জি-প্লট, গোবর্ধনপুর, রাক্ষসখালি, সাগরদ্বীপের মন্দিরতলা, হরিণবাড়ি, চকফুলডুবি, রায়দিঘির বরাশি (ছত্রভোগ), কঙ্কনদিঘি, জটার দেউল, জয়নগরের তিলপি, ডায়মন্ড হারবারের দেউলপোতা, হরিনারায়ণপুর এলাকা জুড়ে বিরাজ করছে প্রত্নতত্ত্বের অফুরন্ত ভাণ্ডার।
হুগলি নদী কিংবা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিভিন্ন সময় পাওয়া গিয়েছে দেড়-দু’হাজার বছর কী তার আরও আগেকার টেরাকোটা ও পাথরের উপর ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপিযুক্ত শীল, দু’হাজারেরও বেশি বছরের আগের লিঙ্গদেব, তিন হাজার বছর আগের কার্নেলিয়ান, অ্যাগেট, জেসপার, ক্রিস্টালের মতো রকমারি পাথরের পুঁতিযুক্ত হার। পাওয়া গিয়েছে হাজার পাঁচেক বছর আগের পুরুষ প্রকৃতি মুণ্ডমূর্তি ও পাত্রের উপর বিচিত্র মানবীমুখের নিদর্শন, হাতির দাঁতের তিরফলা, পশুর হাড়ের উপর আঁকা নানা শিল্পকর্ম, পক্ষীচঞ্চুযুক্ত নারীমূর্তি। সুন্দরবনের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় এখন সেসব সযত্নে ঠাঁই পেয়েছে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের নানা পাথরের অস্ত্রশস্ত্র, মাইক্রোলিথিক যন্ত্রপাতি, পশুর হাড়ের তৈরি হাতিয়ার, পোড়ামাটি ও পাথরের তৈরি দুর্গা, সরস্বতী, বিষ্ণু ও সূর্যমূর্তিও ঠাঁই পেয়েছে সেসব সংগ্রহশালায়। সুন্দরবনের নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে পাওয়া গিয়েছে গন্ডার, জলহস্তী, ষাঁড়ের দাঁত, হাড়, টেরাকোটার উপর লিপিবদ্ধ জাতক ও রামায়ণ কাহিনি, ধাতব অগণিত বৈদেশিক মুদ্রা, তাম্রপ্রস্তর যুগের মাতৃকামূর্তি, এক বিশেষ কায়দায় আগুনে পুড়িয়ে বানানো কালো-লাল মৃৎপাত্র, মাদুলি, ধারালো ছেদক, অলঙ্কার ইত্যাদি আরও কত কী! বুড়োবুড়ির তট থেকে পাওয়া বৈদেশিক স্বর্ণমুদ্রা, মসুর ডালের আকৃতির পাথরের উপর নারী-পুরুষের অর্ধেক পাখি ও অর্ধেক মানবমূর্তি, মদ রাখার বড় উঁচুগলা পাত্র অ্যামফোরা, সাড়ে তিনহাজার বছর আগের বয়নশিল্পেরও নিদর্শন হিসেবে খুঁজে পাওয়া সুতো কাটার তকলি, পানের বোঁটা ও ধানের জীবাশ্ম ও আরও কত কিছুই না ঠাঁই পেয়েছে মথুরাপুরের সুন্দরবন প্রত্ন গবেষণাকেন্দ্রে।
খুঁজে পাওয়া নানা নিদর্শন পরীক্ষানিরীক্ষা করে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, জলে ও জঙ্গলে ঘেরা এখনকার সুন্দরবনে হাজার হাজার বছর আগে ছিল ঘন জনবসতি। উপকূলবর্তী এলাকা জুড়ে এখনও খুঁজে পাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি বহু প্রাচীন সেই সভ্যতাকেই প্রমাণ করে বলে তাঁদের অভিমত। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুঁজে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে গবেষকদের দৃঢ় ধারণা, একসময় ওই সমস্ত এলাকার মানুষ জলপথে ভারত এমনকী, বহির্বিশ্বের সঙ্গেও বাণিজ্য চালাতেন। নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু হয়ে তাম্রপ্রস্তর যুগ এবং মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণযুগ পরবর্তী পাল-সেন যুগ পর্যন্ত চলে আসা নানা সময়কার এমন বহু আশ্চর্য নিদর্শনের সম্ভার রয়েছে সুন্দরবন প্রত্ন গবেষণাকেন্দ্রে। যেখানে ২৬০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর সমসাময়িক তাম্রপ্রস্তর যুগ কি তারও আগের নব্য প্রস্তর যুগের সংগৃহীত বহু নিদর্শনও রয়েছে।
গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান প্রত্নতত্ত্ব গবেষক দেবীশঙ্কর মিদ্যা জানিয়েছেন, “সুন্দরবন জুড়ে রয়েছে প্রত্নতত্ত্বের অফুরান ভাণ্ডার। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের উদাসীনতায় বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও খননকার্য চালানো হয় না। অবহেলায় পড়ে থাকা সুন্দরবন এলাকার হাজার হাজার বছরের মূল্যবান ইতিহাস তাই ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।” প্রাচীন সেসব ইতিহাস কি তবে সত্যিই হারিয়ে যাবে কালের অতলে? সুন্দরবনবাসীর মনে এখন এই প্রশ্নই উসকে উঠছে।