১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই, দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এক নার্সিংহোমের আটতলার ৭২২ নম্বর ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন মহুয়া রায়চৌধুরী (Mahuya RoyChowdhury)। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি, এবং হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অভিনেত্রীর শেষ দৃশ্য। টানটান উত্তেজনা। ঠিক এরকমটা যদি কোনো চলচ্চিত্রের অভিনয় হতো তবে হয়তো টানা ১১ দিনের যুদ্ধ শেষে বাজিমাত হতো নায়িকার। হাততালি আর প্রশংসায় ফেটে পড়তো দর্শকমহল। অথচ তার কোনোটাই হল না, সেই প্রথম কোনো দৃশ্যে হেরে গেলেন অভিনেত্রী। চিরকালের জন্য চলে গেলেন পর্দার আড়ালে।
২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৮, দমদমের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। আসল নাম শিপ্রা রায়চৌধুরী। অর্থাভাবের কারণে নিজের পড়াশুনাটাও শেষ করে উঠতে পারেননি তিনি। খেলাধুলার প্রতিও তাঁর প্রেম ছিল ছোটোবেলা থেকেই। দাদার পিছুপিছু খেলা দেখতে ছুটে যেতেন মাঠে, খেলোয়াড় কম পড়লে নেমেও পড়তেন গোলরক্ষকের ভূমিকায়। তবে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক অন্য জগৎ। পিতা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী ছিলেন একজন নৃত্যশিল্পী। ছোটো থেকেই বাবার তালিমে নাচ করতেন মহুয়া। নাচ দিয়েই প্রাথমিক পরিচিতি পান তিনি।
ক্ষণজন্মা এই তারকার অভিনয় জীবনের সূত্রপাত উত্তর কলকাতার চৌধুরীপাড়ার একটি অস্থায়ী স্টেজ থেকে। সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সুচিত্রা সেনের মতো তারকারাও উপস্থিত ছিলেন। তারকাদের সামনেই সেদিন নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী বহুকষ্টে তাঁর মেয়ে শিপ্রার নাচের ব্যবস্থা করেন। ৭ বছরের ছোট্ট মেয়েটি তার নৃত্যশৈলী দিয়ে নিমেষেই মন কেড়ে নিয়েছিল সকলের। সেই শুরু। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ওইটুকু বয়স থেকে স্টেজে নাচ করে উপার্জন শুরু করেন তিনি। তারপর বাবার পরিচিতির সুবাদেই শুরু হল টলিপাড়ায় যাতায়াত। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের পৃথিবীতে পদার্পণ ঘটলো শিপ্রার।
অবশেষে ১৯৮৬ সাল। ফ্লোরে শুটিং চলছে ‘আশীর্বাদ’ ছবির। চিত্রগ্রাহক শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যামেরার সামনে মহুয়ার শেষ শট। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফোনে বলছেন, “আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও।” সে কি শুধুই অভিনয় ছিল? নাকি জীবনের যবনিকা পতনের কোনো এক ক্ষীণ ইঙ্গিত?
সত্তরের দশকে মাত্র তেরো বছর বয়সে তরুণ মজুমদার-এর পরিচালনায় ‘শ্রীমাণ পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে কিশোরী বধূর বেশে নাচের জগৎ থেকে সিনেমার জগতে পা রাখেন মহুয়া। রোগাসোগা চেহারার মেয়েটি
সেদিন ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেলেও খ্যাতির মুখ দেখতে পারেননি। এর কয়েক বছর পর, ১৯৮০ সালে তরুণ মজুমদারের ছবি ‘দাদার কীর্তি’ তাঁকে এনে দেয় প্রতিপত্তি। প্রায় ৫০ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বক্স অফিসে দুর্দান্ত সাড়া ফেলে দেয় মহুয়া-তাপস পাল জুটি। তরুণবাবুই তাঁর নাম বদলে রাখেন মহুয়া। সার্থক ছিল সে নামকরণ। মৃত্যুর ৩৬ বছর পর এসে আজও আপামর বাঙালি মহুয়াতে মাতাল।
নীলাঞ্জন রায়চৌধুরীর কন্যা, তিলক চক্রবর্তীর স্ত্রী, তমালের মা সমাজ নির্দিষ্ট এইকটা পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠলেন মহুয়া রায়চৌধুরী। নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের গণ্ডি ছাপিয়ে ভূষিত হলেন ‘অভিনেত্রী’, ‘লিটল গ্লোরিয়াস টুইলাইট’, ‘জাত শিল্পী’ সহ আরও অনেক সম্মানীয় বিশেষণে। তাঁর মাত্র ১৫ বছরের অভিনয় জীবনে সবথেকে বড়ো প্রাপ্তি হল প্রায় নব্বইটিরও বেশি ছবি থেকে সঞ্চয় করা দর্শকানুকল্য, দাদার কীর্তি-তে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার এবং দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান।
আশির দশকে বাংলা ছবির জগতে নায়িকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের দাবিদার ছিলেন মহুয়া। শোনা যায়, ছবি প্রতি মোটামুটি এক লাখের ওপরে পারিশ্রমিক নিতেন। যা সমকালীন নায়ক-নায়িকাদের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আর হবে নাই বা কেন? সিনেমার পোস্টারে তাঁর নাম বা ছবি যে অসংখ্য দর্শক টানতো! এমনকি চিত্রনাট্যও লেখা হতো তাঁকে মাথায় রেখেই। অগ্রগামী, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় থেকে তপন সিংহ অথবা তরুণ মজুমদার সকলেরই নজরে সেসময় প্রথম সারিতে থাকতেন মহুয়া।
ঘরোয়া মেয়ের সাধারণ চেহারা, তবে প্রতিভা নেহাতই সাধারণ নয়। বলিষ্ঠ ভঙ্গিমায় তিনি ধরা দিতেন পর্দায়। নাচের পাশাপাশি অভিনয় দক্ষতায়, প্রত্যেক চরিত্রে নিজেকে ভেঙে গড়ে তৈরি করেতেন নয়া মেজাজ। অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে ১৯৭৬-এর ২ মে, বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মহুয়া গাঁটছড়া বাঁধেন বাল্যবন্ধু, ব্যাঙ্কে কর্মরত কিশোরকণ্ঠী তিলক চক্রবর্তীর সঙ্গে। বিয়ের পরের দিনগুলো কেটেছিল ছবির মতো। একদিকে সংসার অন্যদিকে অভিনয়। এরই মাঝে ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন মহুয়া। কিন্তু কর্মজীবনে বিরতি নেননি তিনি। একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ রীতিমত সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
দীপঙ্কর দে, সন্তু মুখার্জী, তাপস পাল, চিরঞ্জিত, প্রসেঞ্জিত চট্টোপাধায়ের মতো তাবড় তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে জুটি বেঁধে উপহার দিয়েছেন একের পর এক সফল ছবি। তাঁর অভিনীত দাদার কীর্তি, পাকা দেখা, ঘটকালি, সাহেব, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, বেহুলা লখিন্দর, অনুরাগের ছোঁয়া, আশীর্বাদ, অভিমান, পারাবত প্রিয়া, ইমন কল্যাণ, কপালকুণ্ডলা, আলোয় ফেরা –এর মতো অজস্র ছবি আজও বাঙালির স্মৃতিতে স্বমহিমায় বহাল। আজও তাঁর অভিনয়ের নম্রতা দেখে যে কেউ সহজেই মিলিয়ে নিতে পারেন পরিচিত কোনো ঘরোয়া মেয়েটির সঙ্গে।
শোনা যায়, অভিনেত্রী সাবিত্রী চ্যাটার্জী এবং সন্ধ্যা রায়, মহুয়া রায়চৌধুরীকে নিজের বোনের মতো করে অভিনয়ের পাঠ দিয়েছিলেন। মহুয়াও যেমনটা করেছিলেন আবার দেবশ্রী রায়ের প্রতি।
আরও পড়ুন: পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহে যেকোনো গবেষকের ঈর্ষার কারণ হতে পারেন ক্লাসিক অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী
অবশেষে ১৯৮৬ সাল। ফ্লোরে শুটিং চলছে ‘আশীর্বাদ’ ছবির। চিত্রগ্রাহক শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যামেরার সামনে মহুয়ার শেষ শট। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফোনে বলছেন, “আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও।” সে কি শুধুই অভিনয় ছিল? নাকি জীবনের যবনিকা পতনের কোনো এক ক্ষীণ ইঙ্গিত? মহুয়ার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বয়ান, তুলে রাখা তদন্ত, সবই এই মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনার তকমা দিয়েছে ঠিকই তবে রহস্যের জট এখনও ছাড়েনি। সত্যিই কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি আত্মহত্যা অথবা পরিকল্পিত হত্যা? সংশয় রয়ে গেছে আজও। মহুয়া চলে গিয়েছেন। থেকে গিয়েছে শুধু মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলে যাওয়া শেষ সংলাপটুকু। “আমার গোলাকে দেখিস”। আর এই সংলাপেই সেকালের দাপুটে সুন্দরী অভিনেত্রী থেকে বেরিয়ে মহুয়া আবারও ধরা দিয়েছেন একজন ঘরোয়া বাঙালি মায়ের ভূমিকায়।
©কঙ্কনা মুখার্জী
বঙ্গদর্শন