#বসন্তের_বাহার_বাহা

#তৃতীয়_পর্ব

এক ফাগুনের গান সে আমার   আর ফাগুনের কূলে কূলে

কার খোঁজে আজ পথ হারালো   নতুন কালের ফুলে ফুলে॥

শুধায় তারে বকুল-হেনা,   ‘কেউ আছে কি তোমার চেনা।’

          সে বলে, ‘হায় আছে কি নাই

                   না বুঝে তাই বেড়াই ভুলে

                   নতুন কালের ফুলে ফুলে।’

বসন্ত আসে বসন্ত যায় বৈজয়ন্তীর শীত শেষ হয় না ।তবু কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে প্রহর গুনতে গুনতে ঘড়ির কাঁটার চক্রপাকে আছড়ে পড়ে স্বপ্ন।

বসন্তের উন্মাদনায় বাতাসে কোকিলের কুহুতান। মাতাল হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, উতরোল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাসে, আমের মুকুলে, পল্লব মর্মরে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে শীতের রুক্ষ দিনের অবসান।

বসন্তের বাহার সকালে রাঢ় বঙ্গের  চপলা নারীরা যেদিন বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে, কপালে টিপ, হাতে কাঁচের চুড়ি, পায়ে নূপুর, খোঁপায় ফুল জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়বে সেদিন চির যৌবনা বসন্ত প্রকৃতিতে স্পস্ট হয়ে উঠে। দখিনা হাওয়া, মৌমাছির গুঞ্জরণ, কচি-কিশলয় আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন রাঢ় বঙ্গের বাহা পরব।

প্রাকৃতিক রূপ-রসে, কোকিলের কুহুতান, আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। বসন্তের রঙিনদোলা, উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি।

কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে- ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে/ ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে/ আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।’

সারদি মাহের দিন অর্থাৎ মূল বাহা পরবের দিন শুদ্ধ বস্ত্রে জাহের থানে নায়েক এসে উপস্থিত হয়। পূজার যোগাড় সাঙ্গ হলে নায়েক পূজায় বসে। জাহির থানে নায়েক মন্ত্রপাঠ শুরু করে। দেবতাদের স্মরণ করে তখন আগের দিনের মতোই তিনজন ব্যক্তিকে দেবতা ভর পায়। জঙ্গলে গিয়ে #মঁড়েক একটি শাল গাছকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ে । মারাং বুরু সেই গাছে উঠে শাল ফুল সংগ্রহ করে। নায়কে এইসব ছদ্মবেশী দেবতাদের নিকট ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য ফুল পাতা চেয়ে নেয়। এর পর ওই তিন দেবতার উদ্দেশ্যে মুরগির বাচ্চা উৎসর্গ করা হয়। নায়কে দেবতাদের বড় মিনতি করে জানায় যেন তাদের সামান্য আয়োজনে সন্তুষ্ট হয়ে গ্রামের মঙ্গল কামনা করেন। 

উৎসর্গীকৃত মুরগীর মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দেবী জাহের এরার থানে প্রসাদের উদ্দেশ্যে রাখা হয় । একে একে  রাঢ় বঙ্গের গাঁ ঘরের সবাই আসে, বলে #বোঙ্গা_সড়ে। তারপর মানুষজন জাহের থান ও নায়কে বাবাকে প্রণাম করে।  নায়কেও পূজার ডালা থেকে একগুচ্ছ করে শাল ফুল নিয়ে সকলের হাতে দিয়ে সকলের মঙ্গল কামনা করে।


নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ ঘুচাও ঘুচাও ঘুচাও সকল বন্ধ হে।

সুপ্তি ভাঙাও, চিত্তে জাগাও মুক্ত সুরের ছন্দ হে॥

তোমার চরণপবনপরশে সরস্বতীর মানসসরসে

যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে

ঢেউ তুলে দাও, মাতিয়ে জাগাও অমলকমল গন্ধ হে॥

নমো নমো নমো–

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥

এরপর শুরু হয় বাহা উৎসবের নাচ গান । বাহা সুরের তালে তালে বাহা গানের শব্দে বাহার নৃত্যছন্দ অরণ্যকে মুখরিত করে তোলে। 

দেলাং সারো হো সারো ঞেলগে সেরেঞ হো

 দেলাং সারো হো সারো ঞেলগে দুরৌং হো।

মাদলের তালে নাচ গানের সঙ্গে বেজে ওঠে বাঁশির সুর, শিঙ্গার ধ্বনি, নুপুরের ঝম ঝম , কাঁকন চুড়ির ঝিন ঝিন শব্দ । 

মেয়েরাও আঁচল পেতে ফুল গ্রহণ করার সময় গান গায়। 

মঁড়ে কোওআঃ নাজিঞ সারজম বাহা হো

তরুয় কোওআঃ নাজিঞ মাতকম বাহা 

আতাং তালাং নাজিঞ মাতকম বাহা 

তেলায় তালাং নাজিঞ মাতকম বাহা।।

অর্থাৎ, চেয়ে নেব দিদি চেয়ে নেবে , মঁড়ে কো’র কাছে শালের ফুল খোঁপায়  গুঁজব দিদি খোঁপায় গুঁজব, খোঁপায় গুঁজব দিদি মহুয়াএ ফুল …. এইভাবে সকলে মিলে জাহের থানকে কেন্দ্র করে কয়েকবার বাহা নৃত্য সম্পাদন করে।তারপর নায়কে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। 

এরপর পালিত হয় বাহা দাঃ আরেচ …..জল খেলা উৎসব। জল খেলা উৎসব ছাড়া বাহা পরব সম্পূর্ণ হয় না। আমরা তো দোল , হোলি ,হুলি বা হরিতে আবীর খেলি, রঙে রঙে মাতাল হই, তেমন রাঢ় বঙ্গের আদিম জনজাতি বাহা পরবে জল খেলায় মাতোয়ারা হয়। নায়কের দেওয়া শাল ফুল গুলো একটি বৃহৎ জলের পাত্রে রেখে সেই জল নিমন্ত্রিত অথিতি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সকলের মধ্যে ঢালাঢালি হয়। তবে সে ক্ষেত্রে সম্পর্কগুলি হতে হয়  দেওর বৌদি, ঠাকুমা দিদিমা , জামাইবাবু শ্যালক ইত্যাদির মধ্যে। এই পুরো অনুষ্ঠানটিকে সাঁওতালি ভাষায় বলা হয় #বাহা_দাঃ_আরেচ।

বাহা পরবের শেষ দিন হল #সেন্দরা পরব । গাঁয়ের  যুবকরা শিকার করতে যায়। শিকারে কিছু জুটলে তারা নায়েকের ঘরে নিয়ে আসে। শিকারের মাংস দিয়ে পেট ভর্তি করে খাওয়া হয়, নাচ হয় , ফুর্তি হয়। সাধারণত তৃতীয় দিন আর বাহা নাচ হয় না , হয় #লাগাড়ে নাচ। তারপর যে যার ঘরে ফিরে যায়। সে বছরের মতো বাহা পরব সাঙ্গ হয়। শাল বন, মহুল গাছ, মহুয়ার গন্ধ, শিমুল পলাশ ফুল দিগন্ত আলো করে কোকিলের ডাকের সঙ্গে সেই চৈত্র মাসের প্রহর শেষের রাঙা আলোয় বাহা পালন করতে থাকে।

তবে বর্তমান প্রযুক্তির উন্নতির ছাপ এদের উপরও পড়েছে। তাই আদিম সনাতনী প্রথা, উৎসব কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে এসেছে। আধুনিকতার জৌলুসে আর বিদেশি মিশনারীদের লোভের স্বীকার হয়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলছে। আদিবাসী সমাজ তাদের মূল্যবান ঐতিহ্য পূর্ণ বাহা পরব ও সংস্কৃতিকে খোয়াতে বসেছে।

বৃক্ষ ভূমির বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায় কিন্তু শিকড় খোঁজে মৃত্তিকা ও তার অভ্যন্তরের টান। এটুকু যেন তারা ভুলে না যায়। 

এক ফাগুনের মনের কথা   আর ফাগুনের কানে কানে

গুঞ্জরিয়া কেঁদে শুধায়,   ‘মোর ভাষা আর কেই বা জানে।’

আকাশ বলে, ‘কে জানে সে   কোন্‌ ভাষা যে বেড়ায় ভেসে।’

          ‘হয়তো জানি’ ‘হয়তো জানি’

                   বাতাস বলে দুলে দুলে

                   নতুন কালের ফুলে ফুলে॥

#সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী 

তথ্যঃ পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজ : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে

প্রকৃতিককেন্দ্রিক লোক উৎসব : বাহা 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.