#তিন_রায়_তিন_ধর্ম_বেঙ্গাই_গাঁ

 #পর্ব_৭: চিরসখা হে

কপিলা গোমঞে পবিত্র কৈল মাটি ।

তিনবার দিলেক চন্দনের ছড়া ঝাঁটি।।

টাঙ্গাল্য আলম-চাঁদা করে ঝলমল।

পরিপাটি সুন্দর পূজার কৈল স্থল।।

চারিদিকে রাখিল পূজার আয়োজন । 

রবি জবা সমান সিঁদুর আশি মণ।।

সন্ন্যাসী ভকিতা ডাকে ধর্ম্ম জয় জয়।

রঞ্জাবতী কাঁদিয়া করুণা কিছু কয়।।


গাজন শুরু হবার ছয়দিন পর শনিবার ও মঙ্গলবার দেখে গ্রামস্থ #ধোপাবাউন পুকুর থেকে #কামিন্যা_ঘট তোলা হয় । ১০৮ জন রমণী সেই মঙ্গল ঘট তোলেন।গাজনের দশম দিনে #গামারি_কাটা হয়। গামারি বৃক্ষকে পূজা করে তার ডাল কেটে আনা হয়। সেই ডাল কামারশালে পাঠানো হয় । কর্মকার সেই গামার বা গাম্ভারি কাষ্ঠ দিয়ে #ঝাঁপকাঠি তৈরি করে দেন। ওই ঝাঁপকাঠি গাজন পূজায় ব্যবহৃত হয়। 


গাজনের একাদশ দিনে #রাতগাজন পালিত হয়। সেবাইতরা ওইদিন আতপচালের একটি কচ্ছপ মূর্তি তৈরি করে। সেই কূর্মপৃষ্ঠে পাদুকা স্থাপন করা হয়।সেই কূর্মের দুই পাশে কালো মুগ এবং লাল মুসুরডাল দিয়ে দুইটি সর্প নির্মাণ করা হয়। এছাড়া #চার_পন্ডিত অর্থাৎ, রামাই, নীলাই , শ্বেতাই এবং কংসাই পন্ডিত , #চার_আমিনী অর্থাৎ বসুয়া, চরিত্রা, গঙ্গা এবং দুর্গার প্রতীক মূর্তি নির্মাণ করা হয়। সবাইকে যেখানে একসঙ্গে স্থাপন করা হয় , সেটিকে #মুক্তাঘর বলা হয়। 
সকালে পূজাপাঠ ও ফুল কাড়ানোর পর শ্যামরায়ের অনুমতি প্রার্থনা করে সন্ন্যাসীরা ঘাট পূজা করতে যান। তাঁদের পরনে থাকে গেরুয়া বস্ত্র , গলায় উত্তরীয় , হাতে বেতের ছড়ি। গ্রামের লক্ষ্মীতলার কাছে ধোপাবাউন পুকুরে #ঘাটপূজা করা হয়।


বাক্য পড়ে পন্ডিত ভট্ট বেদ গান।

চম্পকে করিতে স্নান রঞ্জাবতী যান।।

চাঁপাই নদীর ঘাটে দিলা দরশন ।

রায়টী পাথরে বান্ধা ঘাট বিলক্ষণ।।

পলাশের বন যেন পরিপূর্ণ পানা।

ঘাট মুক্ত আপনি  কর‍্য‍চ্ছে ইছারানা।

নীরে গিয়া নাম্বিলা ভকিতা বারোজন।

পূর্বমুখে স্নান করে ধ্যানে বিচক্ষণ।

সঙ্গে শুয় সামুলা আমিনী রঞ্জাবতী।

চম্পকে করিলা স্নান ধ্যান একমতি।।


শ্যমরায়কে চালের ধুনুচির মধ্যে বসিয়ে পুকুরের জলে ডুবিয়ে স্নান করানো হয়।সেই ধুনিচি ধোয়া জল সন্ন্যাসীরা ভক্তি ভরে মাথায় নেন। এই স্নানের নামই হল #মুক্তাস্নান । স্নান সমাপান্তে শ্যামরায়ের হাতে কামিন্যা দান করা হয়।অর্থাৎ ধর্মরাজের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী শক্তির বিবাহ হয়। সুদূর অতীতে মৃৎনির্মিত কামিন্যা দান করতেন ভক্তরা। বর্তমানে পিতল নির্মিত কামিন্যা দান করেন ভক্তরা। সেই সময় স্নান সেরে অনেকেই দন্ডী খাটেন। এর নাম #প্রণাম সেবা।


শ্যামরায়ের মুক্তাস্নানের সময় একটি বিশেষ ছড়া পাঠ করা হয়। তার কিয়দ্ অংশ উল্লেখ করলাম-


মুকুতা সিনানে সাজিল দেবলোক।

মুকুতা গলে দোলে সুবর্ণের থোপ।।

আমিনী সন্ন্যাসী যত আগে পিছে ধায়।

ব্রতদাসীগন যত চামর ঢুলায়।।

পন্ডিত সেতাই সাজে বসুয়া আমিনী।

চারিশয় গতি সাজে দিয়ে জয়ধ্বনি।।

নীলাই পন্ডিত সাজে চরিত্রা আমিনী।

আটশত গতি সাজে দিয়ে জয়ধ্বনি।।

পন্ডিত কংসাই সাজে গঙ্গা আমিনী।

বারশয় গতি সাজে দিয়ে  জয়ধ্বনি।।

রামাই পন্ডিত সাজে দুর্গা আমিনী।

ষোলোশত গতি সাজে দিয়ে জয়ধ্বনি।।

একে একে সাজে যত নগর রমণী।

হরিশচন্দ্র রাজা সাজে মদনা পাটরাণী।।

একে একে সাজে যত নগর অঙ্গনা।

মুকুতা সিনানে সাজে বিয়াল্লিশ বাজনা।।

মুকুতা সিনানে যত দেব লোক সাথে।

হনুমন্ত ডাকি দেহ পুষ্করিনী কাটিতে।।


রাত গাজনের পর হয় #লুইজাগানো পালা। এই মহাগাজনের তিন চার বছর আগে একটি পাঁঠাকে লুইয়ের পাঁঠা বলা হয়। কয়েকবছর এদিক সেদিক ঘুরে গাজনের দিন পাঁঠাটি ঠিক গ্রামে ফিরে আসে।ওই পাঁঠাই রাত গাজনের দিন বলি দিয়ে একটি মাটির হাঁড়ির ভিতর ছিন্ন ছাগমুন্ড রেখে লুইজাগানো লোকাচার পালিত হয়। রাজা হরিশচন্দ্র  নিজ পুত্র লুইচন্দ্রকে উৎসর্গ করেছিলেন ধর্মরাজের বিশেষ পূজায়।সেই থেকেই লুইজাগানো প্রথার শুরু। প্রথায় সন্তান কামনায় নারীরা ছিন্ন ছাগমুন্ডের উপর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সারারাত জেগে বসে থাকেন। 


পঞ্চপাত্র দুয়ারী বেতাল আবাহন।

জবা ফুল সূর্য্য তবে সম্মুখে অর্চ্চন।।

গাজন বাহিরে থাকে কুবের ভান্ডারী।

উকদন্ড সম্মুখে জ্বলিল সারি সারি।।

প্রজাপতি পবন পূজিল ডানি ভাগে।

প্রতি বোলে রঞ্জাবতী সন্তান বর মাগে।।

প্রবাদ – ভক্তিতে অচলা হলে ছিন্ন ছাগ মুন্ড মধ্যরাতে ডেকে উঠবে।পরদিন অর্থাৎ #দিনগাজন এর দিন অর্থাৎ দ্বাদশ দিন সকালে পূজা সেরে লুইয়ের হাঁড়ি ভাসানো হয় গাজন পুকুরে অর্থাৎ গ্রামস্থ ধোপাবাউন পুকুরে।


কালদন্ড দুই হাতে আগুন জ্বলে তায়।

ধুনা দিতে অমনি জ্বলিয়া পড়ে গায়।।

চূর্ণমণি পাবকে পোড়া সব তনু।

দিবসে দ্বিগুন দেখি তপনে রেনু।।

রঞ্জাবতী একে একে করিছে সন্ন্যাস ।

বিষম খেঁজুর কাঁটা করে সর্বনাশ।।

ভারতের প্রায় প্রতি গ্রামে একজন করে গেরাম দেবতা বা বিশেষ গ্রাম দেবতাকে পাওয়া যায়। তবুও গ্রামের সার্বিক কল্যাণ ও স্থিতি বজায় রাখার জন্য একজন দেবতা বা দেবীকে গ্রামের প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যে  সমাজ ব্যবস্থার আদিমতম রূপকল্প টি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রবর্তনার কাল থেকে দেব স্থানগুলি একই জায়গায় অবস্থান করছে । 
পুরোহিতরাও এখানে বংশানুক্রমিকভাবে পুজোর কাজ করে। অঞ্চলে যে সমস্ত প্রাচীন সনাতন ধর্মীরা বসবাস করে থাকেন তাদের প্রত্যেকের গ্রামের সন্নিহিত কোন ফাঁকা জায়গায় গুটিকয়েক গাছের নিচে সিঁদুর চর্চিত কিছু পোড়া মাটির হাতি ঘোড়ার মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে যে, ওগুলো গেরাম দেবতার থান। 

 গ্রাম্য দেবতাকে গেরাম ঠাকুর, গরাম দেবতা,  গরাম ইত্যাদি বিভিন্ন নামে সম্বোধিত করা হয় । আখ্যান যাত্রা দিন,  হাঁস-মুরগি পায়রা ইত্যাদি বলি দিয়ে , যদি বৈষ্ণব মতে হয় তাহলে পায়েস ইত্যাদি ভোগ প্রদান করে সেখানে পুজার বিধি প্রচলিত রয়েছে।ওই দিনটি ছাড়া গেরাম ঠাকুরের পুজোর মাসিক বা কোন ঋতুভিত্তিক কোন দিন থাকেনা।  তবে গ্রামে চাষবাস হচ্ছে না,  বৃষ্টি হচ্ছে না,  অপদেবতার কোপ পড়েছে,  প্রবল বর্ষণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, দূর্বিক্ষ মহামারি প্রকট পড়েছে এমন অবস্থায় অকালবোধনের ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায় । 


বেঙ্গাই তথা সমগ্র রাঢ় অঞ্চলের কুলদেবতা হলেন ধর্মরাজ। তাঁর উপর যুগ থেকে যুগান্তে মানুষ বিশ্বাস রেখে চলেছেন। সেই যুগান্তের বিশ্বাসে ভর করেই শ্যামরায় ধর্মরাজের সেবায়েতরা বিবিধ রোগের লৌকিক চিকিৎসা করে থাকেন। কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। বস্তু মিলুক না মিলুক,বিশ্বাস করতে ক্ষতি কী? তাঁদের দেওয়া সেই ঔষধের নাম হল #কালাপুষ্প। তাতে বন্ধ্যাত্ব, বাধক, নানা স্ত্রীরোগ নাকি নিরাময় হয়। এটা বেঙ্গাই গাঁয়ের বিশ্বাস। এই ওষধি পুষ্প গাবায় হয়। গাবা বা গাবাল পুকুরের ঢালু অংশকে বলা হয়। এছাড়াও দৈব কবচ প্রদান করা হয় একশিরা রোগে। সেসব ওষুধ ,কবচ নিলে বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। মানত থাকে শ্যামরায়ের নিকট। বিবিধ বিচিত্র লোকাচারে সিক্ত হয়ে বেঙ্গাইয়ের শ্যামরায় রাজার রাজা সম্রাট হয়ে অবস্থান করেন গাঁয়ের। তিনিই তাই পরম ব্রহ্ম , তিনিই কূর্মরূপী নারায়ণ ,তিনিই অনাথের নাথ , চিরসখা হয়ে বেঙ্গাই আলো করে বেঙ্গাইয়ের মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।

চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।

সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো ॥

এবারের অক্ষয়তৃতীয়ায় ঘুরে আসুন ধর্মরাজ শ্যামরায়ের মন্দিরে।পথ বাতলে দিচ্ছি আমি । হাওড়া আরামবাগ ট্রেনে করে সোজা আরামবাগ স্টেশনে নামবেন।তারপর যাবেন আরামবাগ বাস স্ট্যান্ড । সেই বাসে দারকেশ্বর নদ পেরিয়ে বেঙ্গাই চৌমাথা। এরপর মোরামের পথ দিয়ে মিনিট চল্লিশ পদব্রজে হাঁটলেই পেয়ে যাবেন বেঙ্গাই পন্ডিতপাড়ায় শ্যামরায় মন্দির। ঘুরে আসুন… একটা সুন্দর প্রকৃতি পাবেন , লৌকিক ও অলৌকিককে পাবেন । মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা আপনার হৃদয়কে অসম্ভব শান্ত করবে। মন্দিরের গায়ে অঙ্কিত হাকন্দ পালা গ্রামীন চিত্রশৈলীর এক উল্লেখ্য নিদর্শন তা আমি আগেই বলেছি। সেগুলো নিয়েও যাঁরা পড়াশুনা করতে চান করতে পারেন। সর্বপরি যাঁরা বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের একটি বার এই মন্দির দর্শন আবশ্যক। 

অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল।

জরাভারাতুরে নবীন করো ওহো সুধাসাগর ॥

#সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.