#তিন_রায়_তিন_ধর্ম_বেঙ্গাই_গাঁ

 
#পর্ব_৫ : নিরাকার ব্রহ্ম স্বরূপ ধর্মশ্যামরায় এবং তাঁর শক্তি

জাগো, জাগো, জাগো ধর্মরাজ!

শ্মশানের অধীশ্বর, জাগো তুমি আজ।

হেরো তব মহারাজ্যে করিছে উৎপাত

ক্ষুদ্র শত্রু,– জাগো, তারে কারো বজ্রাঘাত

দেবদেব! তব নিত্যধর্মে করো জয়ী

ক্ষুদ্র ধর্ম হতে।

বিচিত্র জগৎসংসারকে উপনিষদ্‌ –  ব্রহ্মের অনন্ত সত্যে, ব্রহ্মের অনন্ত জ্ঞানে বিলীন করে দেখেছেন। উপনিষদ্‌ কোনো বিশেষ লোক কল্পনা করেন নি, কোনো বিশেষ মন্দির রচনা করেন নি, কোনো বিশেষ স্থানে তাঁর বিশেষ মূর্তি স্থাপন করেন নি–একমাত্র তাঁকেই পরিপূর্ণভাবে সর্বত্র উপলব্ধি করে সকলপ্রকার জটিলতা সকলপ্রকার কল্পনার চাঞ্চল্যকে দূরে নিরাকৃত করে দিয়েছেন। ধর্মের বিশুদ্ধ সরলতার এমন বিরাট আদর্শ আর কোথায় আছে?

উপনিষদের এই ব্রহ্ম আমাদের অগম্য, এই কথা নির্বিচারে উচ্চারণ করে ঋষিদের অমর বাণীগুলিকে আমরা যেন আমাদের ব্যবহারের বাইরে নির্বাসিত করে না রাখি। আকাশ লোষ্ট্রখণ্ডের ন্যায় আমাদের গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমরা আকাশকে দুর্গম বলতে পারি না। বস্তুত সেই কারণেই তা সুগম। যা ধারণাযোগ্য, যা স্পর্শগম্য, তাহাই আমাদিগকে বাধা দেয়। আমাদের স্বহস্তরচিত ক্ষুদ্র প্রাচীর দুর্গম, কিন্তু অনন্ত আকাশ দুর্গম নয়। প্রাচীরকে লঙ্ঘন করতে হয়, কিন্তু আকাশকে লঙ্ঘন করবার কোনো অর্থই নাই। 

প্রভাতের অরুণালোক স্বর্ণমুষ্টির ন্যায় সঞ্চয়যোগ্য নহে, সেই কারণেই কি অরুণালোককে দুর্লভ বলতে হবে? বস্তুত একমুষ্টি স্বর্ণই কি দুর্লভ নয়, আর আকাশপূর্ণ প্রভাতকিরণ কি কাহাকেও ক্রয় করে আনতে হয়? প্রভাতের আলোককে মূল্য দিয়া ক্রয় করবার কল্পনাই মনে আসিতে পারে না–তা দুর্মূল্য নয়, তা অমূল্য।

উপনিষদের ব্রহ্ম সেইরূপ। তিনি অন্তরে-বাহিরে সর্বত্র–তিনি অন্তরতম, তিনি সুদূরতম। তাঁর সত্যে আমরা সত্য, তাঁর আনন্দে আমরা ব্যক্ত।

ধর্মকে ধারণা করতে হবে না। তাই পুনরায় বলব ধর্মরাজ ঈশ্বর ধারণার অতীত। 

বেঙ্গাই গাঁয়ের কুলদেবতা শ্যামরায়ের দুই রকম ধ্যান মন্ত্র আছে। একটি মন্ত্রে ধর্মরাজকে নিরাকার শূন্য রূপে আরাধনা করা হয়েছে। অন্যটিতে ধর্মের সাকার রূপের ধ্যান করা হয়েছে। ধর্মমঙ্গল কাব্যেও কিন্তু ধর্মরাজ ঠাকুরকে নিরাকার পরম ব্রহ্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

মজিয়া বিদ্যার রসে   পড়িশুনি নানা দেশে   

     নাহি জানি গীতের সরণি।

আপুনি করিয়ে দয়া  দিলে ধর্ম্ম পদছায়া         

আমি মূর্খ কি বলিতে জানি।।

এক ব্রহ্ম সনাতন  নিরাকার নিরঞ্জন         

নিয়ম করিতে কিন্তু নাঞি।

কিবা রূপগুন কথা  হরিহর ইন্দ্রধাতা   

      যত কিছু আপনি গোঁসাঞি।।

প্রসঙ্গত , সে সব মন্ত্র ও ছড়ায় বেশ কিছু শব্দ অশুদ্ধ এবং অর্থহীন। এছাড়াও ছন্দপতন জনিত কারণে ছন্দ দোষে দুষ্ট হয়েছে মন্ত্রগুলি। এর অন্যতম কারণ হল ছড়া বা মন্ত্রগুলি বেশিরভাগ স্থানেই মৌখিকভাবে বংশানুক্রমিকভাবে প্রচলিত । ফলত স্থানবিশেষে এর ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। বহু আঞ্চলিক লৌকিক শব্দ এই ছড়া বা মন্ত্রগুলিতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। সেটা ভালো না খারাপ তা বিচারের ক্ষমতা আমার মতো নগন্য মানুষের নেই। তবে অবশ্যই একটা অদ্ভুত বৈচিত্র সৃষ্টি হয়েছে এটা বলতেই হবে।আর দুচার ক্ষেত্রে লিখিত আকারে যা পাওয়া যায় , তাও লিখন প্রমান দুষ্ট।


কেমন সেসব মন্ত্র ? আমি সামান্য লিখছি । কারন সব দেবতার সব মন্ত্র , সব সাধন পদ্ধতি সবাইকে জানতে নেই। ধর্মরাজ শ্যমরায়কে শূন্য রূপে ধ্যান মন্ত্রে এবং প্রণাম মন্ত্রে উভয়তেই নিরাকার নিরঞ্জন রূপে পূজা করা হয়েছে। 
শূন্য রূপে শ্যামরায়ের ধ্যান মন্ত্র হল :

 
ওঁ যস্যান্তং নাদি মধ্যাং নচ কর চরণং

নাস্তি কায়া নিনাদাং নাকারং নাস্তি রূপং

নাস্তি জন্ম যস্য যোগীন্দ্র ধ্যান গম্যং

সকল জলগত সর্বব সংকল্পহীন তত্রৈব

সোমর বরদ পাত্তব শূন্যমূর্ত্তি স্বশিরসি পুষ্প দত্যা

আপুনি দেব রূপংবিভাব্য।


সাকার রূপে শ্যামরায়কে চতুর্ভুজ, কোটি চন্দ্রের প্রভার ন্যায় উজ্জ্বল, শ্বেত সিংহাসন আরোহিত, আজানু লম্বিত মালা পরিহিত , সুন্দর ও সুঠাম , গঙ্গার ও কর্পূর ন্যায় শুভ্র , সুস্মিত , উল্লুক বাহন নিয়ে নিরঞ্জন অবস্থায় আরাধনা করা হয়। 


প্রণাম মন্ত্রে পুনরায় তাঁকে নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম হিসাবে প্রণাম করা হয় :
ওঁ নির্বিকার নিরাকার নির্বিকল্প নিরঞ্জন।

গুনতৎ পরম ব্রহ্ম ত্বং ধর্ম্ম নিরঞ্জন পাপহরম।।

স্বর্ব পাপ বিনাশয় সর্বব দুঃখ হরায় চ।

মম বিঘ্ন বিনাশায় ধর্ম্মরাজ নমঃস্তুতে।।


বেঙ্গাইতে একসময় একটি ছিন্ন কীটদংশিত ধর্মরাজের পুঁথি ছিল। সেটির কয়েক ছত্র সেবাইত কার্ত্তিক পন্ডিত একসময় তার খাতায় লিখে রেখে দিয়েছিলেন।সেও গ্রাম্য লিপিকরের লিখিত ধর্মসেবার বিবরণ।
ধর্মরাজের স্ত্রী শক্তি হলেন কামিন্যা এই কথা আমি পূর্বেই বলেছি। তাঁদের ধ্যানমন্ত্র এবং প্রণামমন্ত্র অনুসারে ধর্মরাজের কামিন্যাগণ কামরূপ কামাখ্যার মন্ত্রসিদ্ধা, তন্ত্রসিদ্ধা , স্বয়ংসিদ্ধা এবং রহস্যময়ী দেবী। এনাদের সেই অর্থে চোখে দেখা যায় না । অনুভব করা যায়। তন্ত্রে যেমন আছেন -ডাকিনী, হাকিনী, যোগীনি ইত্যাদি , তেমনি ধর্মরাজের কামিন্যারাও আছেন।


ধর্মরাজের কামিন্যাগণ কুষ্ঠরোগ নিরাময়কারী ও অন্ধত্ব হরণকারী লোকদেবী রূপে পল্লী বাংলায় সুপ্রসিদ্ধ । তাঁরা নারায়ণীর অংশ বিশেষ। তাই তাঁদের প্রণাম মন্ত্রের ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়। বেঙ্গাইতে কামিন্যার মূর্তি তিনটি পিতল নির্মিত। মূলতঃ ঘটের উপরে স্থাপিত মুন্ডমূর্তি।
একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।

দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছেন আদি শক্তি দেবী, যিনি নিত্য কিংবা সনাতনী , তিনি ভাগ হয়ে যান চরিত্রের আপাত ভিন্নতায়। ভাগ হয়ে যান সমাজ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে র , একাধিক রূপে। বেদের উষা সরস্বতী, অদিতি বা পৌরাণিক দুর্গা, চন্ডী তন্ত্রের মধ্যে হয়ে যান জগতধাত্রী, অন্নপূর্ণা, চামুন্ডা , দশমহাবিদ্যা।আবার সেই আদি শক্তিই সকল দার্শনিক ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে এসে নেমে আসেন মাটির নিকট নিতান্ত লৌকিক রূপে। তিনি তখন আমাদের গৌরী ,উমা বা মঙ্গলকাব্যের মঙ্গলচন্ডী বা অন্নপূর্ণা। তিনি তখন বন্যপশুর রক্ষীয়ত্রী চন্ডী, তিনি তখন কৃষি জীবী বা বল্লুকা কুলে মাছ ধরা শিবের ঘরণী। তিনি ভালোবাসেন শাঁখা পড়তে। তিনি ধান ভাঙেন, বেতের ধামা কুলো বোনেন, সংসার প্রতিপালন করেন। যোগনিদ্রা হতে তিনি যুক্ত হন গ্রামীন আচার অনুষ্ঠানে, আশা আকাঙ্খায়।ফ্রাই বলেছেন A divine figure বা Earth a female figure….. দেবীকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন ভাবনায়। সব কিছুর সমন্বিত চেহারা নিয়েই তিনিই দেবী দুর্গা , আদিমাতা , পৃথিবীমাতা।  এক ও অদ্বিতীয়া দেবীরই সাত্ত্বিকী , রাজসী, তামসী শক্তিকে অবলম্বন করে মহালক্ষ্মী , মহাসরস্বতী , মহাকালীর উদ্ভব। এনারা একই আদিশক্তির ত্রিতত্ত্ব।

দুর্গা নবমীতে দুইটি ছাগ উৎসর্গ সহ ধর্মরাজ শ্যামরায়ের ষোড়শপচারে পূজা হয়। বেঙ্গাই – ভট্টাচার্যপাড়ার শশধর ভট্টাচার্যের সন্তান হয় শ্যামরায়ের দোর ধরে।তিনি প্রতি বছর একটি পাঁঠা উৎসর্গ করেন।আর একটি পাঁঠা সেবাইতদের তরফ থেকে উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গ করার কাজ করেন সেবাইত নবকুমার পন্ডিত। অতীতে এই কাজ করতেন তাঁর পিতা নিমাই পন্ডিত। 


ঢাক বাজান পালা অনুসারে দুর্গাপুর গ্রামের খাঁদু দাস ও তাঁর পুত্র গোপাল দাস অথবা যতন রুইদাস ও তাঁর পুত্র পিরু রুইদাস। বলির পর একটি পাঁঠার সমাংসরুধির সরায় করে নিবেদন করা হয়।অন্য পাঁঠাটির মাংস দিয়ে ভোগ রন্ধন করা হয়। ছাগ ভিন্ন ছাঁচি কুমড়ো , আখ , আদা ও কলা উৎসর্গ হয়। সেবাইত বাড়ির পুরুষরা এই ভোগ রন্ধন করেন। 

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.