#পর্ব_৪: লোকছড়ায় আচার পালন
একে শনিবার তায় ঠিক দুপুরবেলা
।সম্মুখে দন্ডাইল ধর্ম্ম গলে চন্দ্রমালা।।
গলায় চাঁপার মালা আসাবাড়ি হাথে।
ব্রাহ্মণ রূপে ধর্ম্ম দন্ডাইল পথে।।
রাঢ় বঙ্গের অন্ত্যজ দরিদ্র শ্রেণীর সাধারণ মানুষের ঠাকুর হলেন নারায়নের লৌকিক রূপ স্বরূপনারায়ণ অর্থাৎ ধর্ম্মঠাকুর। তিনি রাঢ় বঙ্গের সাধারণ মানুষের ত্রাণ কর্তা। তাঁর নিকট লাউসেনও যা কালু ডোমও তাই। ধর্মমঙ্গল তাই হয়ত রাঢ় বঙ্গের মহাকাব্য।ধর্মমঙ্গল থেকে জানা যায় তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিস্থিতির কথা। এসব কারণেই রাঢ় বঙ্গের গাঁয়ে গাঁয়ে ধর্ম ঠাকুর নানা নামে স্বয়ং অবস্থান করেন।
উর ধর্ম্ম আমার আসরে।।
কাতর কিঙ্কর ডরে আসরে স্মরণ করে।
তেজ ধর্ম্ম বৈকুণ্ঠ নগর ।।
বিড়ম্বনা দন্ড কত দেখ নাট শুন গীত।
আপনি আসরে কর ভর।।
বেঙ্গাই গাঁয়ের ধর্মরাজ শ্যমরায় , কুলদেবতা শ্যমরায় কূর্মরূপ ধারণ করেছেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি ১২ ফুট দৈর্ঘ্য , ২ ফুট প্রস্থ এবং ২ ফুট উচ্চতাযুক্ত বেদীর উপর কাঠের সিংহাসনে অধিষ্ঠান করছেন রুপার পৈতাশোভিত ধর্মরাজ শ্যামরায়। কূর্মরূপী ধর্মরাজের পৃষ্ঠে পাদুকা চিন্হ খোদিত আছে। শ্বেত শুভ্র উত্তরীয় শোভিত শ্যামরায়ের অধিষ্ঠান করছেন অমরপুর থেকে আগত #ক্ষুদিরায় ধর্ম এবং বেঙ্গাই উত্তরপাড়া থেকে আগত #ক্ষুদিরায় ধর্ম। এছাড়া বেদী র উপর অবস্থান করছেন ধর্মরাজের স্ত্রী শক্তি #কামিন্যা – সর্বমঙ্গলা , বিমলা , কমলা।
তাঁদের সঙ্গে অবস্থান করছেন অদ্যাশক্তি । আদ্যাশক্তি এখানে একটি কৃষ্ণবর্ণের শিলা। বহুকাল ধরে তিনি সেবা পূজা পেয়ে আসছেন। ধর্মরাজের গাজনের সময় ধর্মরাজের সঙ্গে বিবাহের লৌকিক সূত্রে ভক্তরা কামিন্যা দান করে থাকেন। গর্ভগৃহে রক্ষিত সর্বমঙ্গলা দান করেছেন বেঙ্গাই পশ্চিম ঘোষপাড়ার বাসিন্দা সদগোপ সম্প্রদায়ের জ্যোতির্ময়ী হাজরা। হরিশচন্দ্র পুরের সদগোপ সম্প্রদায়ের কানাই প্রতিহার বিমলা কামিন্যা দান করেছেন। কমলা কামিন্যা সদগোপ সম্প্রদায়ের দিলীপ রায়ের মা চন্ডীদেবী কর্তৃক প্রদত্ত। ধর্মমঙ্গল কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে বিমলা , অমলা , কলিঙ্গা ও কানাড়া নামক চার দেবকন্যার উল্লেখ পাই। ধর্মরাজের সেবক লাউসেনের স্ত্রী হবার জন্য জন্ম গ্রহন করেছিলেন।
দেবকন্যা জগতে জন্মিল চারিজন।
জন্মিল সূর্য্যের বাজী ভক্তের কারণ।।
বিমলা ,অমলা আর কলিঙ্গা ,কানাড়া ।
আন্ডীর পাথর নামে গৌড়ে হৈল ঘোড়া।।
শ্যামরায়ের নিত্যপূজা সকাল ১১ টায় সিদ্ধ চাল ও আতপচালের নৈবেদ্য সহকারে হয়। নিত্যপূজার পূর্বে কূর্মাকৃতি ধর্মশিলাকে তৈল মদর্ন পূর্বক স্নান করানো হয়। সুর্যাস্তের পর জলবাতাসা দিয়ে আরতিসহ শীতল পূজা করা হয়। পয়লা বৈশাখ থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত আখের গুড় ও ছোলা নিবেদন করে শীতল পূজা দান করা হয়। ওই একমাস #বসুধারা দেওয়া হয়। প্রকৃত পক্ষে বসুধারা হল অভ্যুদায়িক শ্রাদ্ধের পূর্বে গৃহের ভিত্তিতে সিঁদুর চিন্হ দিয়ে সাতবার বা পাঁচবার ঘৃতধারা দেওয়া। তবে এখানে বসুধারা বলতে জলের ধারাকে বোঝানো হয়। বসু অর্থাৎ জল।
একটি ছিদ্র যুক্ত তামার খুঁড়িতে দূর্বা ঘাস দিয়ে ছিদ্রটিকে ঢেকে ,খুঁড়িটি জলপূর্ণ করে শ্যামরায়ের মাথার উপর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সারাদিন সেই তৃণাচছাদিত ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ধর্মরাজের পৃষ্ঠদেশে পড়তে থাকে। এই ভাবে নিদাঘ গ্রীষ্মে ধর্মরাজ শীতল থাকেন।
বেঙ্গাই এর ধর্মরাজ পূজায় বেশ কিছু ছড়া পাঠ হয়। গ্রাম্য লোক বাংলাভাষায় ছড়া। অধিকাংশ পূজানুষ্ঠান ওই ছড়া দিয়েই সম্পন্ন হয়। পাঠ শুরু হয় সকালে মন্দিরের দরজা খুলে ধর্মরাজের নিদ্রাভঙ্গ করার সময়। এই ছড়ার নাম তাই #নিদ্রাভঙ্গ।
উঠ ধর্ম পোয়াল রজনীগা তোল
অখিলের পতিমুখে লহ ভৃঙ্গারের পানি।
গোঁসাই রহিলেন নিদ্রার ঘোরেনানা
রঙ্গ কতূহলে অন্তত যুগের যুগনাথ
পূর্বতত্ত্ব ধ্যায় মণি তুমি গতি ত্রিভুবনই উঠ রাত্রি প্রভাত হইল।
কোকিল কলরব করে, সারী ( শালিক ) , শুয়া (শুকবা টিয়া) সুস্বরে
ঘন ঘন ডাকেন সপ্তদিকে চিয়াইয়া চেতন কর ধ্যান ভঙ্গ যুগেশ্বর
প্রভু ভক্ত আইলেন তোমার সাক্ষাতে।
এত শুনি নিরঞ্জন শীঘ্র হইলেন সচেতন
বসিলেন পালঙ্কের উপরে।
দুই দিকে দুই পাত্র সুরপতি ধরেন ছত্র
সম্মুখে উল্লুক খগেবর।
বসুয়া আমিনী যথা , যোগাইল আম্রের পাতা,গঙ্গা দিলেন সুভাষিত জল।
এরপর তৈল মর্দন সহ ধর্মরাজের #স্নান এর ছড়া –
সোনার পুষ্করিনীখানি
রুপার চারিঘাট
এই ঘাটে স্নান করেন প্রভু ধর্মরাজ।
স্নান করে উঠেন প্রভু
বল্লুকার তীরেঅখন্ড তুলসীপত্র অঙ্গের উপরে।এই জলপানে অপুত্রের পুত্র হয়,নির্ধনের ধন; উঠে কানা কামদেব নির্বাণ হয়এই দেউলে পড়ে জয় জয়কার।দাতা দানপতির গৃহে বিঘ্ন কর নাশ,নমঃ শ্ৰী দেব নিরঞ্জনায় নমঃ।।
উপরোক্ত দুটি ছড়ায় ব্যবহৃত , নিরঞ্জন, গোঁসাই , বসুয়া, আমিনী, কামদেব, নির্বাণ ইত্যাদি শব্দগুলি গবেষণার নতুন দিক উন্মচন করে। এছাড়া দুইটি নদীর নাম আছে – গঙ্গা এবং নানা জৈন মার্গীয় গ্রন্থাদিতে বিশেষ ভাবে উল্লিখিত অধুনা লুপ্ত নদী #বল্লুকা।
প্রসঙ্গত ধর্মমঙ্গল কাব্যগ্রন্থ গুলিতে এবং শূন্যপুরান কাব্যে এই বল্লুকা র কথা উল্লেখ আছে।
রূপরাম চক্রবর্তী রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যে রাজা হরিশচন্দ্র ও রানী মদনার ধর্মপূজার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন –
বল্লুকা নদীর তটে পূজা করে পানিপুটে চারি পন্ডিত পূজে নিরঞ্জন।
ঘন পড়ে জয়ধ্বনি দূরে হৈতে শুনি জয় জয় সআল ভুবন।।
যদুনাথ রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যে পুজায় উপবিষ্ট রানীমদনা কে সাদা বসন পড়তে দেখতে পাওয়া যায় –
করিয়া যুগল পানি বন্দ্যেমাতা বাগবানী
শুক্লবসন পরিধান।।
আবার ধর্মপূজার আয়োজন পূর্বে রাজা হরিশচন্দ্র রানী মদনা নির্দেশ দিচ্ছেন-
শুক্লবসন লহ বল্লুকার জলে যাহস্নান করি আসিয়া এখন….।
‘#শূন্যপুরাণে’ও চাষের অনেক কথা এবং বল্লুকা নদীর কথা আছে। শিব মুগ তিল সরষে আখ কাপাস প্রভৃতি চাষ করছেন। এখানেও তাঁকে সাহায্য করছেন ভীম, কিংবা হনুমান। এখানেও ভীম হাল বাইছেন, ধান রুইছেন, ধান কাটছেন, ধান ঝাড়ছেন।
চাষ করিতে যায় ভোলানাথ বল্লুকা কুলে গো।
কোথায় আছো গৌরী দেবী দাওনা শঙ্খের ধ্বনি গো।।
আগে চলে দেব ভোলানাথ শেষে নারদ গো।
বল্লুকা কুলে আসি তারা উপনীত হলো গো ।
হাল জোড়ে হাল জোড়ে দেব ভোলানাথ গো ।
সিংগা বাজায় দেব ভোলা বাঁশের উপর বসে গো।।
এক চাষ , দুই চাষ, তিন চাষ দিল গো।।।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)