#তিন_রায়_তিন_ধর্ম_বেঙ্গাই_গাঁ

#পর্ব_৩: গুহ্যতন্ত্র সাধনা

ঋষি বলেছেন–

যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।

আনন্দংঃব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কুতশ্চন॥

মনের সঙ্গে বাক্য যাঁকে না পেয়ে নিবৃত্ত হয়, সেই ব্রহ্মের আনন্দ যিনি জেনেছেন, তিনি কিছু হতেই ভয় পান না।

ধর্মের সরল আদর্শ একদিন আমাদের ভারতবর্ষেরই ছিল। উপনিষদের মধ্যে তার পরিচয় পাই। তার মধ্যে যে ব্রহ্মের প্রকাশ আছে, তা পরিপূর্ণ, তা অখণ্ড, তা আমাদের কল্পনা-জালদ্বারা বিজড়িত নয়।

সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম

তিনিই সত্য, নতুবা এ জগৎসংসার কিছুই সত্য হত না। তিনিই জ্ঞান, এই যা-কিছু তা তাঁরই জ্ঞান, তিনি যা জানছেন তাই আছে, তাই সত্য। তিনি অনন্ত। তিনি অনন্ত সত্য, তিনি অনন্ত জ্ঞান….

বেঙ্গাই গাঁয়ে কিংবদন্তি আছে যে , ধর্মরাজ শ্যামরায় দুইশত বৎসর পূর্বে উচালনের নিকট ময়রাডাঙ্গা গ্রামে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গ্রামে অধিষ্ঠিত ছিলেন ।সেখানে সেবাপূজার অভাব দেখা দিলে তিনি স্থানান্তরে গমন করেন। এই জনশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে একবার ময়রাডাঙ্গার কয়েকজন গ্রামবাসী শ্যামরায়কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বেঙ্গাইতে উপস্থিত হন। কিন্তু বেঙ্গাই গ্রামের সেবাইতরা তাঁদের সুপ্রাচীন উপাস্য দেবতাকে কখনোই হস্তান্তর করতে রাজি হননি। প্রবল বিতর্কের মধ্যে মন্দিরের দরজা খুলে দেখা যায় যে দক্ষিণমুখী শ্যমরায় উত্তরমুখী হয়ে অবস্থান করছেন। ময়রাডাঙ্গার অবস্থান বেঙ্গাইয়ের উত্তরে। 
ধর্মরাজের অবস্থানগত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে ময়রাডাঙ্গার ভক্তরা থানচত্বরের ঈশান কোন থেকে এক চাপ মাটি তুলে নিয়ে স্বগ্রামে ফিরে যান। এদিকে ধর্মরাজ উত্তর দিকে হয়ে অবস্থান করছেন সহসা , তার ফলে বেঙ্গাই গাঁয়ের সেবাইতদের মনেও এই প্রত্যয় জন্মায় যে , হয়ত কোনো এক কালে শ্যামরায় উত্তরের ময়রাডাঙ্গায় অধিষ্ঠান করতেন। এই ঘটনার পড়ে ময়রাডাঙ্গার সদগোপ সম্প্রদায়ের ঘোষ বংশ এবং সরকার বংশ মকরসংক্রান্তিতে শ্যামরায়ের উদ্দেশ্যে আতপচাল পাঠান , দুর্গানবমীতে প্রণামী পাঠান । 
জনশ্রুতি আছে যে , শ্যামরায়তলার ঈশান কোণের মাটি ময়রাডাঙ্গা গ্রামে আজও ধর্মরাজ রূপে পূজিত হয়। 


বেঙ্গাই শ্যামরায় মন্দিরটি আদিতে ছিল খোড়ো চালের ছোট মন্দির। প্রায় দেড়শো বছর পূর্বে একটি বড় মন্দির নির্মাণ করা হয় যদিও তার ছাদ ছিল না, এসবেস্টর ছাউনি ছিল। সেই মৃৎ নির্মিত সেই অনালঙ্কৃত মন্দিরের পরিমাপ  ছিল – দৈর্ঘ্য ২০ ফুট ৮ ইঞ্চি, প্রস্থ ১৬ ফুট ৬ ইঞ্চি, উচ্চতা ১৫ ফুট। ভিত্তিভূমি থেকে চাতালের উচ্চতা ছিল ২ ফুট। ছাউনি ধরে রাখার জন্য ছটি স্তম্ভ ছিল। 
১৪১৯ বঙ্গাব্দে  সেবাইত শিবশঙ্কর পন্ডিত এবং গ্রামস্থ ভক্তবৃন্দের অর্থানুকূল্যে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে সুদৃশ্য পাকা মন্দির নির্মাণ করা হয়। নতুন মন্দিরের স্থপতি লস্করদীঘির ডোম সম্প্রদায়ের  শিল্পী সত্য পান্ডা। দক্ষিণমুখী এই বর্গাকার মন্দিরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২৪ ফুট ২ ইঞ্চি , উচ্চতা ৩০ ফুট। ভিত্তি ভূমি থেকে চাতালের উচ্চতা ২ ফুট । চাতালের প্রস্থ ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি। ৭ ফুট তফাতে নাটদালানটি বর্গাকার – দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২০ ফুট। নাটদালানে বারোটি স্তম্ভ আছে।


মন্দির বহির গাত্রে ধর্মমঙ্গল এ বনির্ত #হাকন্দ চিত্র অঙ্কিত আছে।স্বাভাবিক ভাবেই বাঙ্গালী হিন্দুর মনে প্রশ্ন আসবে যে এই হাকন্দ কি ? 
ধর্মমঙ্গলমধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যেরমঙ্গলকাব্য ধারার তিনটি প্রধান শাখার অন্যতম (অপর শাখাদুটি হল মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল)। এই কাব্য রচনার প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার প্রধান দেবতা ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার। এই কাব্যের উপাদান মূলত রাঢ় বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদান।ধর্মমঙ্গল কাব্যে দুটি কাহিনি সন্নিবেশিত হয়েছে: প্রথমটি পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি,এবং দ্বিতীয়টি লাউসেনের উপাখ্যান। দ্বিতীয় উপাখ্যানটিই কাব্যের মূল উপজীব্য। ধর্মমঙ্গলের আদি কবি হলেন ময়ূরভট্ট। তাঁরই রচিত কাব্য হাকন্দপুরান নামে খ্যাত।
দ্বিতীয় কবি হলেন রূপরাম চক্রবর্তী। 
চিত্রকর বেঙ্গাই নিবাসী দুলে জাতির চন্দন বাগ এই ধর্মমঙ্গলকাব্যের হাকন্দ পুরান কে মন্দির গাত্রে অঙ্কিত করেছেন।


প্রসঙ্গত ময়ূরভট্ট যে ‘হাকন্দপুরাণ’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন দুর্ভাগ্যবশত ময়ূরভট্টের হাকন্দ পুরাণের কোন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। মন্দির গাত্রে হাকন্দ চিত্রের নবখন্ড পালার দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে রচিত ঘনরাম চক্রবর্তী #শ্রীধর্ম্মমঙ্গল পুঁথিতে পশ্চিম উদয় পালায় দেখি, সমুলা লাউসেনকে বললেন মাথা কেটে পূজা করলে ধর্মরাজ সন্তুষ্ট হবেন। 
লাউসেন কঠোর তপস্যার সংকল্প করেন। কঠোর তপস্যার পর তাঁর দেহ #নবখন্ড করে গুপ্ত সাধনা করতে লাগলেন।ধর্মরাজের আসন টলে উঠল। ধর্মরাজ হাকন্দে এলেন। ধর্মরাজ হাকন্দে আসছে শুনে বেটো কুকুর তাঁকে তারা করল। ধর্মরাজ কুকুরকে পথ ছাড়তে বললেন। শেষ পর্যন্ত ধর্মঠাকুর নিজের পরিচয় দেওয়ার পর কুকুর তাঁর পথ ছাড়ল। কুকুর তাঁর নিকট বরলাভ করে চতুর্ভুজ নারায়ণ দর্শন করল। এরপর লাউসেনের সামনে ধর্মরাজ উপস্থিত হলে , লাউসেন সূর্যের পশ্চিমে উদয় বর প্রার্থনা করেন। ধর্মরাজের ঐশী ক্ষমতায় এই অসম্ভব সম্ভব হলে । পশ্চিমে সূর্য উদয় হল। হরিহর বায়েন এই আশ্চর্য অতিজাগতিক  ঘটনার সাক্ষী থাকলেন।


মন্দির গাত্রে শিল্পী চন্দন বাগ কর্তৃক অঙ্কিত রঙিন #নবখন্ড পালকর যৎসামান্য পরিচয় প্রদান আবশ্যক । কারণ বিষয়টি ধর্মরাজ সাধনার আদিম তন্ত্রের গোপন রূপটি ফুটে উঠেছে । অঙ্কিত প্রাচীর চিত্রটিও একবিংশ শতাব্দীর গ্রামীন চিত্রশৈলীর এক উল্লেখ্য নিদর্শন। চিত্রকঙ্কনের সময় রঙের তীব্র ব্যবহার এক্ষেত্রে লক্ষনীয়। যাই হোক , দেখি শ্ৰীধর্ম্মমঙ্গল পুঁথিতে দেখি রাজা লাউসেন অভিলাষ পূরণের আশায় কি করছেন –
অবশেষে উজ্জ্বল করি যজ্ঞকুণ্ড।

আরম্ভিলা মহাপূজা আদ্য নবখন্ড।।

হাকন্দে যখন হলো গত এক দণ্ডে।

দক্ষিণ উরুর মাংস দিল যজ্ঞকুণ্ডে।।

হাকন্দে হল যখন দুই দণ্ড রাতি।

বাম উরে বসাইল হীরাধার কাতি।।

হাকন্দে যখন হইল চারিদণ্ড রাতি।

দক্ষিণ পায়েতে রাজা বসাইল কাতি।।

হাকন্দে যখন হল পাঁচ দণ্ড রাতি।

বাম পাশে বসাইল হীরাধার কাতি।।

হাকন্দে যখন হল নিশা সাত দণ্ডে।

ভুজদন্ডদ্বয় মাংস কেটে দিল কুণ্ডে।।
হাকন্দে যখন নিশা গত অর্ধদণ্ডে।

কাটিয়া পৃষ্ঠের মাংস দিল যজ্ঞে কুণ্ডে।।

হাকন্দে যখন হল নয় দণ্ড রাতি।

গলায় বসায়ে কাতি করেন মিনতি।।


অর্থাৎ , লাউসেন হাকন্দ নামক স্থানে গভীর রাত্রে প্রতি ২৪ মিনিট অন্তর কাতি বা খড়্গ দিয়ে দেহের একেকটি অংশ যেমন ডান উরু, বাম উরু, ডান পা, বাম পা, দুই হাত ,পিঠের মাংস ইত্যাদি কেটে ধর্মরাজের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছেন। সব শেষে মস্তক উৎসর্গ করলেন – 
নবখন্ড হাকন্দে হইল মহাশয়।

কাটা মাথা মাগে বর পশ্চিম উদয়।।
আর কিছু দেবার নেই। সুতরাং, ভক্তের ভয়ঙ্কর সাধনায় তুষ্ট ধর্মরাজ ভক্তের মনোবাঞ্চা পূরণ করলেন। তাই , অনেকেই মনে করে ধর্মপূজা আসলেই সূর্য পূজা। এই ধর্মসাধনা গুহ্য তন্ত্র সাধনা। অভীষ্ট লাভের জন্য ভক্তের এহেন কৃচ্ছসাধন একমাত্র গুহ্য তন্ত্র ব্যতীত প্রচলিত অন্যান্য লোকাচারে বা লোকধর্মে বিরল।

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.