#তিন_রায়_তিন_ধর্ম_বেঙ্গাই_গাঁ

#পর্ব_২: শ্যামরায়ের হোলি খেলা 

পৃথিবীতে দণ্ড বা শাস্তি কি আগে ছিল না? যদি না থেকে থাকে তাহলে তার উৎপত্তি হলো কিভাবে ?কেনইবা হলো?  শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠির এই কথা জানতে চেয়েছিলেন । পিতামহ স্বতঃপ্রনোদিত  ভাবে প্রাচীন একটি কাহিনীর কথা বলেছিলেন । 
মহাভারতের ২১৯ তম অধ্যায় কেন্দ্রে আছেন সর্বদা তপস্যায় মগ্ন পর ধার্মিক রাজা বসুহোম ।  সুমেরুর সন্নিহিত হিমালয়ের শৃঙ্গে অবস্থিত মুঞ্জপৃষ্ঠ তীর্থে তিনি তার সহধর্মীনি কে নিয়ে গমন করলেন।  এই তীর্থ স্বয়ং মহাদেব ও পরশুরামের কাছে অত্যন্ত প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছিল । দৃঢ় নিয়মে বদ্ধ সেই স্থানে ব্রাহ্মণদের অনুমতি নিয়ে সপত্নীক মুঞ্জ বটের নিচে অবস্থান করতে লাগলেন।
 তপস্যা এবং শাস্ত্র পরিচর্যায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেবর্ষি তুল্য। একদিন সকলের কাছে সম্মানীয় , ইন্দ্রের বন্ধু , রাজা মান্ধাতা আনন্দপূর্ণ হৃদয় বসুহোমের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সৎ চরিত্রের অধিকারী রাজা মান্ধাতা কে যথাবিহিত আপ্যায়ন করে বসুহোম অবনত হয়ে বললেন, ” রাজন!  কিং করবানি তে।।” রাজা আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?
পাদ্য অর্ঘ্য নিবেদন ভূষিত হয়ে রাজা মান্ধাতা , বসুহোমকে জিজ্ঞাসা করলেন, ” হে নরশ্রেষ্ট , আপনি বৃহস্পতি ও শুক্রপ্রণীত নীতিশাস্ত্র বিষয় মহা প্রাজ্ঞ । তাই আমি জানতে আগ্রহী দন্ড কি ? এর উৎপত্তি কিভাবে হলো ? কি জন্য দন্ড উৎকৃষ্ট?
“তদহং জ্ঞাতুমিচ্ছামি দন্ড উৎপদ্যতে কথম।/ কিং চাস্য পুরবং জাগরতি কিংবা পরমমুচয়তে।” 
 প্রশ্নের উত্তরে বসুহোম যা বললেন তার সংক্ষিপ্ত আকারে এই, যে একদা সর্বলোক পিতামহ ব্রহ্মা একটি যজ্ঞ করার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু সেই যজ্ঞে তুল্ল পুরোহিত পেলেন না। যজ্ঞ সম্পাদনে কৃৎসংকলপ  ব্রহ্মা উপযুক্ত ঋত্বিক না পেয়ে বহু বছর ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন। বহু বছর অপেক্ষা করার পর তার মস্তিষ্ক চিন্তা হতে প্রজাপতির খুপের জন্ম হয় । তিনি ব্রম্ভার যজ্ঞের ঋত্বিক পদে বৃত হলেন। কিন্তু প্রজা নিয়ন্তা ব্রহ্মা যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ায় , লোক নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত দন্ড সহসা অদৃশ্য হলেন। এখানে লক্ষ্যনীয় দন্ডের অন্তর্হিত হওয়ার শব্দ বলে দিচ্ছে দণ্ডের অস্তিত্ব ছিল । বসুহোম তার উৎপত্তি কাহিনী বলছেন ঠিকই কিন্তু তা আসলে দণ্ডের পুনর উৎপত্তির বলছেন।


এদিকে তার অনস্তিত্বের ফলে যা ঘটল তা মনুষ্য সমাজের পক্ষে অনভিপ্রেত ।সমাজের দুর্নীতি দেখা দিল ।মারামারি-কাটাকাটি।  বর্ণসঙ্করের অন্ত রইল না। এই অবস্থা বর্ননা করতে গিয়ে ভীষ্ম বলছেন , ” পরস্পরং বিলুপন্তি সারমেয়া যথামিষম । অবলান বলিন ঘনন্তি নির্মর্যাদাদমবরত্ত।”
মাংসের টুকরো নিয়ে কুকুর যেরকম কলহ মত্ত হয়ে ওঠে , সে রকম মানুষরাও পরস্পর হিংসায় মত্ত হয়ে উঠল। ধন হরন শুরু করল। প্রবলেরা বধ করতে লাগল দুর্বলদের । এই ভাবে সৃষ্টি হল বিশৃংখলার।
 অরাজক অবস্থা দেখে ব্রহ্মা তখন ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তাঁর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তদন্ত শ্রেষ্ঠ চক্রপাণি নারায়ন দীর্ঘকাল চিন্তা করি নিজেকে দন্ড রূপে  সৃষ্টি করলেন এবং #দন্ডের স্থান গ্রহণ করলেন। ” আত্মানমাত্মানা দনডং সসৃজ দেব সম।”
 বৈদিক যুগে সম্ভবত লোক জীবনের একজন ধারক ও বাহক ছিলেন।কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি সত্তায় বিষ্নু,  পরিচয় দেবতারূপে । এক ,একজন শক্তিশালীকে সর্বত্র  শাসক ও পালক রূপে নিযুক্ত করলেন।
একাধারে রুদ্ররূপে ও কল্যাণ রূপে দণ্ড ও নিজস্ব বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনরূপ অসৎ পথ, নীতিসমূহকে পশ্রয় দেন না ।এই ভেদ অনুসরণ করে পুরাকালের ধর্মপ্রাণ রাজা নিজের পুত্রকে দন্ড দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না। রাজার সগর তার পুত্র অসমজ্ঞ কে নিয়ে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন । কেননা অসমজ্ঞ দুর্বল শিশুদের নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলার মত অক্ষমনীয় অপরাধ করেছিল। 
এই বলহীন শিশুরা রাজা সগরের সন্তান সম প্রজাদের পুত্রকন্যা ছিল ।
শুধু  পুত্র নয় যদি গুরুও অপরাধ করেন তবে তাকে দণ্ড দেয়া উচিত। অপরাধীদের দন্ড বিধান করা হতো কঠোর বাক্য প্রয়োগ করে , কারাগারে আবদ্ধ রেখে ,ধন-সম্পদকে করায়ত্ত করে,  প্রহারে,  অর্থদণ্ডে,  নির্বাসনে , কিন্তু সবচেয়ে কঠোর দণ্ড ছিল মৃত্যু। প্রাণ হরণের ব্যবস্থা । শূলে চড়িয়ে অপরাধীকে হত্যাই ছিল শেষতম দন্ড।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের সব পুঁথিগুলিতে ধর্মরাজকে নারায়ন তুল্য আসনে বসানো হয়েছে । ধর্মরাজের নাম দেওয়া হয়েছে #স্বরূপনারায়ণ। ভগবান বিষ্ণু তথা শ্ৰীকৃষ্ণের নাম শ্যামরায়। তিনি ই একাধারে যোদ্ধা রূপী সকল জ্ঞানের আধার শঙ্খ চক্র পদ্ম গদাধারী বিশ্বরূপ।  তিনিই একজন চরম রাজনৈতিকজ্ঞ এবং কূটনৈতিকজ্ঞ। আবার তাঁরই বংশীর মধুর সুরধ্বনি জগৎকে মাতোয়ারা করেন। তাঁরই জন্য কৃষ্ণনামের প্রেমজোয়ারে একদিন মহাপ্রভু শ্ৰীচৈতন্যদেবের সঙ্গে বঙ্গ সহ সকল ভারত শংকরাচার্যের পর আবার নতুন হিন্দুআন্দোলনে অংশ গ্রহন করেছিল। শ্ৰীচৈতন্যের কৃষ্ণ ছিলেন শ্যামরায়।

দেখ সজনি, শ্যামরায়

নয়নে প্রেম উথল যায়,

মধুর বদন অমৃতসদন

চন্দ্রমায় নিন্দিছে।

আও আও সজনিবৃন্দ,

হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ

শ্যামকো পদারবিন্দ

ভানুসিংহ বন্দিছে॥
 ক্রমে সেই দন্ডরূপী বিষ্ণু ভারতের লোকসমাজে অতি সাধারণ মানবের নিকট হয়ে উঠলেন ধর্ম স্বরূপ ধর্মরাজ। তিনিই ধর্মরাজ রূপে শ্যামরায় নামে কত শত বছর ধরে বেঙ্গাই গাঁয়ের কুলদেবতা রূপে বলতে গেলে রাঢ় বঙ্গের কুলদেবতা অবস্থান করছেন।

ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে।

          অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে

                ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র                

                   আমার হিয়াতলে।

               ঝরা পাতা গো, বসন্তী রঙ দিয়ে

                        শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ!

তাই ধর্মরাজ শ্যামরায় রূপে আবীরে রঞ্জিত হয়ে দোল খেলেন , পরিকরসহ রথে আরোহণ করেন। বেঙ্গাইয়ের #শ্যামরায়ের দোল হয়। দোল পূর্ণিমার পূর্ব রাত্রে পালিত হয়  #বহ্ণুউৎসব । একটি ছোট খড়ের কুটির নির্মাণ করে তার সামনে বসে পূজা করা হয় , হোম হয়। সবশেষে শ্যমরায় #হোলিকা_দহন করেন। এরপর বাদ্য বাজিয়ে শ্যামরায়কে পালকিতে গ্রাম পরিক্রমার পালা।পরদিন শ্যামরায় দোল খেলেন।

খেলিলে হোলি ধুলায় ঘাসে ঘাসে

          বসন্তের এই চরম ইতিহাসে।

               তোমারি মতো আমারো উত্তরী

             আগুন রঙে দিয়ো রঙিন করি,

             অস্তরবি লাগাক পরশমণি

                   প্রাণের মম শেষের সম্বলে॥
কাঠের পালকিটি দান করেছেন বেলেপাড়ার সদগোপ সম্প্রদায়ের জনৈক অশোক ঘোষ। পূর্বতন পালকিটি সেবাইতদের উদ্যোগে কামারপুকুরের দারুশিল্পীরা নির্মাণ করেছিলেন।
বেঙ্গাইতে #শ্যামরায় পন্ডিত উপাধিধারী গ্রামস্থ বর্গক্ষত্রিয়দের উপাস্য। এর আদি সেবায়েত ছিলেন অমূল্য পন্ডিত, রামাই পন্ডিত  ( প্রসঙ্গত ইনি কিন্তু  শূন্যপুরান রচয়িতা রামাই পন্ডিত নন) ও গোলাপী পন্ডিতদের পরিবারবর্গ।  অপুত্রক অমূল্য পন্ডিতের পর দৌহিত্র সূত্রে পশ্চিম অমরপুরের ক্ষুদি রায় ধর্মের সেবক মৃত্যুঞ্জয় পন্ডিত শ্যাম রায় ধর্মের সেবাপূজার অধিকার পান। এনারা সকলেই শান্ডিল্য গোত্রধারী ।
রামাই পন্ডিত অপুত্রক অবস্থায় প্রয়াত হলে তাঁর জামাতা বংশ বাঁকুড়া জেলার তাজপুর থেকে বেঙ্গাইতে এসে পাকাপাকিভাবে বাস শুরু করেন এবং শ্যামরায়ের সেবার পালা ভাগ পান। এঁরা আঙ্গিরস গোত্রধারী।শ্যামরায়ের সেবাইতদের তৃতীয় শাখার গোলাপী পন্ডিত তাঁর পালা দিয়ে যান ভ্রাতুষ্পুত্র আঙ্গিরস গোত্রধারী চন্ডীচরণ পন্ডিতকে।  প্রসঙ্গত আঙ্গিরস দেবগুরু বৃহস্পতির বংশধরদের গোত্র। 
শ্যামরায়ের সেবক এই #পন্ডিতরা ডান বাহুতে তামার বালা ধারণ করেন। অতীতে তাঁরা বক্ষদেশে তাম্রসূত্র পরিধান করতেন। তাম্রদীক্ষার সময়কাল বিধিমত তিনটি -১০ বর্ষ ১০ দিন অথবা  ১২ বর্ষ ১২ দিন অথবা ১৪ বর্ষ ১৪ দিন।জীবৎকালে এই তিন বয়সে ধর্মসেবকদের তামা ধারণ করতে হয়।তামা ধারণ করার পর  সারাজীবন গুগলি ,শামুক, গেঁরি ও মুরগী খাওয়া নিষেধ হয়। 

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.