শ্ৰী হর্ষ নৈষধচরিতে লিখেছিলেন :
বারাণসী নিবিশতে ন বসুন্ধরায়াং তত্র স্থিতির্মখভুআং ভবনে নিবাসঃ।তত্তীর্যমুক্তবপুষামত এব মুক্তিঃ স্বর্গাত্ পরং পদমুপদেতু মুদেতুকীদৃক।।
মন্দিরের নগরী বারাণসী। বারাণসী” নামটি সম্ভবত দুটি নদীর নাম থেকে এসেছে: বরুণা (বারাণসীতে এখনও প্রবহমান) ও অসি (অসি ঘাটের কাছে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী) নদী। গঙ্গার উত্তর কূলে অবস্থিত বারাণসী শহরের সীমানা নির্দেশ করছে গঙ্গার এই দুটি উপনদী। অন্যমতে, বারাণসী নামটি বরুণা নদীর নাম থেকেই এসেছে। কারণ, কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে এই নদীকেই বারাণসী নদী বলা হত। তবে দ্বিতীয় মতটি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। যুগে যুগে বারাণসী নানা নামে অভিহিত হয়েছে। যথা: “কাশী” (বৌদ্ধযুগের তীর্থযাত্রীরা বারাণসীকে এই নামে অভিহিত করতেন, এখনও করেন), “কাশিকা” (উজ্জ্বল), “অবিমুক্ত” (শিব যে স্থান “কখনও ছাড়েন না”), “আনন্দবন” ও “রূদ্রবাস” (রূদ্রের নিবাস)।
বেদে-এ এই শহরকে “কাশী” নামে অভিহিত করা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে কাশীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে। কাশী নামটির উল্লেখ স্কন্দ পুরাণ-এও পাওয়া যায়। উক্ত পুরাণের একটি শ্লোকে শিবের উক্তি রয়েছে, “তিন ভুবন আমার কাছে একটি মাত্র শহর, আর কাশী হল সেই শহরে আমার রাজপ্রাসাদ।”
এই মন্দিরের নগরীতে এমন কিছু মন্দিরও আছে যা গুপ্ত হয়ে অবস্থান করছে। যা দেখলে সহসাই হৃদয় চমৎকৃত হয়ে ওঠে। তাদের অপূর্ব স্থাপত্য ভাস্কর্য , তাদের অপরূপ অলঙ্করণ কোনো স্বর্গীয় অনুভূতিকে মস্তিষ্কের মধ্যে স্বাগত জানায়। এমনি একটি মন্দির হল কাশীর রাজকালী মন্দির। এই মন্দিরে বিরাজ করছে না মহাকালী । তাঁর সঙ্গে সদাই ধ্যানমগ্ন মহাকাল মহাদেব অবস্থান করছেন। এছাড়াও রয়েছে আরো বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। মন্দিরের দ্বার প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় উন্মোচিত হয় এবং প্রভাতী পূজা ও আরতির মাধ্যমে দিনের সূচনা হয়। সকাল এগারোটায় মন্দির বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় বিকাল চারটে মন্দির খোলে। মহাশিবরাত্রির দিন এই মন্দির মহোৎসবে মেতে ওঠে।
পাথর খোদাই করে অপরূপ নকশা ও কারিগরীর মাধ্যমে এই মন্দির রথাকৃতি ন্যায় নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন কাশীরাজ নরনারায়ণের পত্নী তথা রাজা প্রভুনারায়ণের মাতা। গোদৌলিয়া চৌহার থেকে চৌক যাবার পথে ডানদিকে অপূর্ব কারুকার্য খচিতসুবিশাল পাথরের এক দুয়ার পড়ে। এই দুয়ার ই হল রাজকালী মন্দিরে প্রবেশ করার মুখ্য দ্বার।
প্রসঙ্গত এরূপ পাথর খোদাই করে সূক্ষ্ম কারুকাজ যুক্ত রথাকৃতির মন্দির সাধারণত দক্ষিণ এবং পূর্ব ভারতে অধিক দেখা যায়। উত্তর ভারতে হিমাচল, উত্তরাখন্ড ইত্যাদিতে কিছু দেখা যায় , উদাহরণ স্বরূপ : বৈজনাথ ধাম। সেদিক থেকে দেখতে গেলে গাঙ্গেয় তীরে এই রাজকালী মন্দিরের স্থাপত্যকৃষ্টির বিশেষ উদাহরণ বহন করছে। পাথর খোদাই করে সম্পূর্ণ মন্দির নির্মিত হয়েছে এবং মন্দিরের প্রতিটি অংশকে নিখুঁত ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দির গাত্রে খোদিত প্রতিটি অলঙ্করণ নিখুঁত ও সুন্দর। এতই মনোযোগ সহকারে এই স্থাপত্য ভাস্কর্য খোদিত হয়েছিল যে মন্দির গাত্রের প্রতি অংশ এমন কি পিছন দিকও অপরূপ কাজে খোদিত হয়েছে।
মন্দির গাত্রে এমন করে দ্বার নির্মাণ করা হয়েছে যে, দূর থেকে তাকে কাঠের মনে হবে, কাছে গেলে শীলা গাত্রের সৌন্দর্য অনুভূত হবে। পাথরের মধ্যে এধরনের কাজ বিশেষ প্রশংসার নমুনা রাখে। এছাড়াও মন্দির গাত্রে ছোট ছোট মন্দির খোদিত হয়ে এবং ঘন্টার অলঙ্করণ করা হয়েছে যা এক কথা স্বর্গীয় সৃষ্টি। পাথরের উপর ত্রি স্তরীয় ভাবে মন্দিরটি নির্মাণ হয়েছে। মন্দির ভিত্তিটি অনেকটা শঙ্খাকৃতির ন্যায়।
একটি দীর্ঘ সময় ধরে মন্দির নির্মাণ হয়েছিল অত্যন্ত যত্ন সহকারে। মন্দিরের স্তম্ভগুলি এক একটি নির্মাণ করতে আনুমানিক ৬ মাস সময় লেগেছিল। মন্দির স্তম্ভগুলির সৌন্দর্য তাই আজই অক্ষুন্ন হয়ে আছে।
নিচের মন্দিরের ছবি গুলি দিলাম। এর কারুকাজ দেখুন। দেখুন আর ভাবুন এই অরূপ সৌন্দর্য পিপাসা মেটানোর জন্যই আমাদের জীবিত থাকতে হবে। লড়তে হবে সব কালবেলার সঙ্গে।
জয় মহাকালী
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কাশীকথা