তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি কোটিপতি যাঁর জাহাজ সাত সমুদ্র পেরিয়ে প্রথম পৌঁছেছিল আমেরিকায়।
আমেরিকার ব্যবসাতেও বিনিয়োগের কারণে সেই আমলে বঙ্গোপসাগরের বুকে চলা প্রতিটি আমেরিকান জাহাজের তরফ থেকে ব্যবসার লভ্যাংশ অর্জন করতেন রামদুলাল।
সত্যি বলতে যে কাজে হাত দিতেন তাতেই সোনা ফলত৷
নিজের বাড়ির পুজোয় পশুবলি বন্ধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। আজও উত্তর কলকাতায় তার নামে রয়েছে এক প্রশস্ত পথ। তিনি রামদুলাল সরকার। অষ্টাদশ শতকের নবজাগ্রত বাংলার অন্যতম বাঙালি উদ্যোক্তা। হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠায় অকাতরে অর্থসাহায্য করেন। ….. পড়ুন পিএইচ ডি গবেষক শ্রেয়সী সেনের কলমে বিশেষ প্রতিবেদন …. ভালবাসি বাংলা পেজে৷
পারিবারিক পদবী ছিল দে, উপাধি সরকার। শৈশবে দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী, সঙ্গে ভাগ্য বিরূপ। কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই পিতৃমাতৃহীন রামদুলালকে কলকাতায় নিয়ে আসেন মামাতো দাদু রামসুন্দর বিশ্বাস। দারিদ্র্য ছিল তাঁরও নিত্যসঙ্গী। রামসুন্দর এর স্ত্রী হাটখোলার দত্তবাড়িতে রাঁধুনির কাজ করতেন। তারই সূত্রে মদনমোহন দত্তের কাছেই প্রতিপালিত হন রামদুলাল। লেখাপড়াও শেখেন তাঁর বদান্যতায়। হয়ে ওঠেন দক্ষ লিপিকর। এরপর পাঁচ টাকা বেতনের বিনিময়ে মদনমোহন দত্তের কাছারিতে হিসাবরক্ষক পদে নিযুক্ত হন।
সেই সামান্য বেতনের টাকা জমিয়ে দাদুকে সাহায্য করতেন। তাঁর দক্ষতা ও অধ্যবসায়ে ধীরে ধীরে উন্নীত হন মুহুরী পদে। কিছুদিনের মধ্যেই মদনমোহন দত্ত তাঁকে চোদ্দো হাজার টাকা দিয়ে ‘তুলোহ্ অ্যাণ্ড কোং’ কোম্পানিতে একটি নিলামে পাঠান কিছু কিনে আনার জন্য। কিন্তু পথিমধ্যে দেরি হয়ে যাওয়ায় সঠিক সময়ে নিলামে উপস্থিত হতে পারেননি তিনি। মনমরা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গার মোহনায় তিনি লক্ষ করেন একটি পণ্যবাহী জাহাজ ঘাটের কাছেই নিলাম হচ্ছে। সেই নিলামে যোগ দিয়ে একলক্ষ চোদ্দো হাজার টাকায় সেই জাহাজ তিনি বিক্রি করে দেন এক ইংরেজ সাহেবকে। ফিরে গিয়ে সম্পূর্ণ টাকাটাই মদনমোহনকে ফেরত দিয়ে দেন রামদুলাল। তাঁর এই সততা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে মদনমোহন পুরো এক লক্ষ টাকাই রামদুলালের হাতে দিয়ে নিজস্ব ব্যবসা চালু করার পরামর্শ দেন।
স্বাধীন ব্যবসার দুনিয়ায় পদার্পণ করে রামদুলাল প্রথম ক্যাপ্টেন হ্যানা নামের এক পর্তুগিজ সাহেবের সঙ্গে বাণিজ্য করে লাভবান হন। শোনা যায়, তিনি যে কাজে হাত দিতেন তাতেই ফলত সোনা। তীক্ষ্ণ ব্যবসায়ী বুদ্ধি, মেধা আর দর কষার দক্ষতার কারণে ক্রমেই ব্যবসার বাজারে তাঁর প্রভাব বাড়ছিল। ইংরেজ বণিকদের বদলে তিনি আমেরিকান বণিকদের সঙ্গেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমেরিকান বণিকরা বঙ্গোপসাগরের পথে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন শুরু করে।এই সকল আমেরিকান বাণিজ্যতরীর ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিলেন রামদুলাল দে সরকার। আমেরিকার ব্যবসাতেও বিনিয়োগের কারণে বঙ্গোপসাগরের বুকে চলা প্রতিটি আমেরিকান জাহাজের তরফ থেকে ব্যবসার লভ্যাংশ অর্জন করতেন রামদুলাল।১৮০০ সাল পর্যন্ত কলকাতা বন্দরে আসা সকল জাহাজই রামদুলালকে তাদের মুৎসুদ্দি বা স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৮০০ সালে তিনি কলকাতায় নিজস্ব ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং এজেন্সিও প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার বন্দর থেকে মার্কিন মুলুকে রামদুলালের চারটি জাহাজ চলাচল করত। সেই জাহাজগুলির নাম ছিল কমলা, বিমলা, ডেভিড ক্লার্ক আর রামদুলাল। মার্কিন বাণিজ্য সম্প্রসারণে রামদুলালের এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ মার্কিন বণিকরা শিল্পী স্টুয়ার্ট গিলবার্টকে দিয়ে জর্জ ওয়াশিংটনের প্রথম একটি তৈলচিত্র আঁকিয়ে উপহারস্বরূপ রামদুলালকে পাঠান। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম নিজের জাহাজ নিয়ে পশ্চিম গোলার্ধ বা আমেরিকায় নৌবাণিজ্য পরিচালনা করেছেন এবং তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যিনি কলকাতায় পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে ব্যবসায়িক হিসাব এবং ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন।
কেবল ব্যবসা নয়, বিবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন রামদুলাল সরকার। হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠায় অকাতরে অর্থসাহায্য করেন। সুদূর আয়ারল্যাণ্ডে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে প্রভূত অর্থ পাঠান। মাদ্রাজে দুর্ভিক্ষের সময়েও তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেলগাছিয়ায় দুঃস্থদের জন্য একটি অতিথিশালা নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং বারাণসীতে তাঁর উদ্যোগেই তেরোটি শিব মন্দির স্থাপন করা হয়। শোনা যায়, বিডন স্ট্রিটের কাছে তাঁর নিজের বাড়ির দুর্গাপুজোয় রামদুলাল বলিপ্রথা বন্ধ করে দেন। তাঁর বসতবাড়ির অতিথিশালায় প্রত্যহ দুঃস্থদের চাল, ডাল, আলু, ঘি, কাঠ ও মাটির হাঁড়ি বিতরণ করা হত। অষ্টাদশ শতকের বাংলায় তিনি কোটিপতি ছিলেন, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও তাঁর জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। সারাজীবনে খেদ বলতে ছিল তাঁর একটাই, কায়স্থ থাকা, উচ্চবংশের সম্মান না পাওয়া। যে কারণে পুত্রের বিবাহের সময় তিনি তাঁর পদবি পরিবর্তন করে ‘দেব’-এ রূপান্তরিত করেন। ১৮২৫ সালে তিয়াত্তর বছর বয়সে রামদুলাল সরকার এর মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে, তাঁর দুই পুত্র আশুতোষ ও প্রমথনাথ তথা ছাতুবাবু লাটুবাবুর বিলাসিতা এবং অকর্মন্যতায় রামদুলাল সরকারের ফলাও ব্যবসার অকালমৃত্যু ঘটে।
????️ শ্রেয়সী সেন
তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, সব বাংলায়, ক্যালকাটা দ্য লিভিং সিটি।