কৃষিবিলের তত্ত্ব, তথ্য আর সত্য

অর্থনীতিতে একটা স্বীকৃত তত্ত্ব আছে যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক নিয়ম, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রথাকে প্রভাবিত করে। বাংলায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কৃষক নিয়ে আমাদের যে পারসেপশন তৈরি হয়েছে বঙ্কিমের বঙ্গদেশের কৃষক থেকে সলিল-সুকান্তের তেভাগা-তেলেঙ্গানা হয়ে নকশাল ও উত্তরনকশাল মানসে, তার মূলে ছিল ব্রিটিশ আমলের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধাঁচা: খাজনার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কৃষক বলতে বাঙালীদের চোখে এখনও ভেসে ওঠে কপনিসার রোদে পোড়া চলে ভেজা একটি নিপীড়িত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের (পুরুষের) ছবি। পূর্ব ভারতে কৃষকের এই ধারাবাহিক দুর্দশার জন্য প্রধানত দায়ী ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমির স্বত্ব দিয়েছিল খাজনা আদায়কারীকে, প্রত্যক্ষভাবে কৃষককে নয়। এমআইটির অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের লক্ষ্মী আইয়ার ২০০৫ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছিলেন, জমির মালিকানাস্বত্ব দীর্ঘ সময় কৃষকের হাতে না থাকায় বাংলার মত এলাকাগুলিতে কৃষিতে বিনিয়োগ হয়েছে অনেক কম, ফলে এইসব এলাকা কৃষি উৎপাদনশীলতার ভিত্তিতেও ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়েছে দেশের অন্য অংশের চেয়ে। ১৯৬৫ সালের পরে গ্রামীন উন্নয়ন যোজনাগুলোর মারফত এ দেশে উচ্চফলনশীল বীজ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে যে নতুন কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠল, উত্তর-পশ্চিম ভারত তার পুরো সুবিধাটা পেয়েছে, বাংলা প্রায় কিছুই পায়নি।

এখানে দুটো ব্যাপার লক্ষ্য করার। প্রথমত, আমাদের মনে কৃষকের স্টিরিওটাইপটি তৈরি হয়েছে মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে দুমড়ে থাকা কৃষকসমাজকে দেখে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর ভূমিসংস্কার, বিশেষত অপারেশন বর্গা বাংলার কৃষককে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদে খুব একটা লাভ হয়নি। দেশের অন্যান্য অংশের, বিশেষত উত্তরপশ্চিম ভারতের কৃষকরা কৃষি থেকে যে স্বাচ্ছন্দ্য ও লাভ তুলতে পেরেছেন, বাংলার কৃষকরা তার ছিঁটেফোঁটাও পাননি। এটা তথ্য দিয়েও প্রমাণ করা যায়। এনএসএস-র ৭০তম রাউণ্ডের (২০১৩) রিপোর্ট বলছে: কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর গড় আয়ের নিরিখে পাঞ্জাব (২১৭৪৫০), হরিয়ানা (১৭৪১৬৩) বড় রাজ্যগুলোর শীর্ষে, আর সবার নিচে বিহার (৪৪১৭২) আর পশ্চিমবাংলা (৪৮১৯৫)। গত এক দশকে কৃষিভিত্তিক আয়ের বৃদ্ধির ছবিটাও অনেকটা একই রকম: সবার উপরে হরিয়ানা (৮.৩%), পাঞ্জাব (৫.১৩%) মাঝামাঝি আর গোটা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন স্থানে পশ্চিমবঙ্গ (-১.২৫%): অর্থঅৎ ২০০২-০৩ থেকে ২০১২-১৩ এই দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের আয় বাড়ার বদলে কমেছে।

তত্ত্ব আর তথ্যের পালা শেষ, এবার অপ্রিয় সত্য বলার সময়। ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু কায়েমী স্বার্থের শক্তপোক্ত ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে যেমন বড় ব্যবসায়ীরা রয়েছে, তেমনিই রয়েছে পাশ্চাত্য শিক্ষিত শহুরে এলিটরা। গোলা পাবলিক যেরকম ভাবে, একদিকে দেশের সমস্ত নিরন্ন অসহায় শাসিত জনতা এবং অন্যদিকে এইসকল ভেস্টেড ইন্টারেস্ট লবির শাসক, ব্যাপারটা আসলে সেরকম নয়। রাজনৈতিক যুদ্ধের ব্যাটল লাইনের দুদিকেই কিছু কায়েমীস্বার্থের লোকজন এবং কিছু হ্যাভনটস মিলিজুলি করে থাকেন। ঘটনাচক্রে এ দেশে সেই রাজনৈতিক সংঘাতগুলোই “খবর” হয়, যেখানে দুদিকেই কায়েমী স্বার্থের কিছু বড় ঘুঁটি থাকে। সবার উপরে বাজার সত্য। ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও মূলত কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত, তথাকথিত “পুঁজির বিরুদ্ধে ভুখা মানুষের লড়াই”-কে ফ্রন্টপেজ আইটেম করে তুলতে তাদের স্রেফ বয়ে গেছে। কংগ্রেস ও বিজেপি দুই আমলেই তেলেঙ্গানা বা মারাঠাওয়াড়ার কৃষকরা মাঝে মাঝেই দিল্লিতে এসে কখনও মুখে মরা ইঁদুর নিয়ে, কখনও মাটিতে গর্ত করে বসে থাকতেন। মিডিয়া সেই অর্থে পাত্তা দিত না, জনতা দুদিন চুক চুক করে পরের খবরে শিফট করত। এক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন এইভাবেই স্পেকট্যাকল তৈরি করে কিছুদিন খবরে থাকে, তারপর হারিয়ে যায়। নির্দিষ্ট দাবিগুলোর কী পরিণতি হল তা প্রায় কখনোই আমরা জানতে পারি না। এই মুহূর্তে ভারত জুড়ে যে আন্দোলনের স্পেকট্যাকল রচনা করা হচ্ছে তা মূলত পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বড় কৃষকদের আন্দোলন। কৃষিবিলের ফলে এই বড় চাষীরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা করছেন।

কৃষিবিলের অনেকগুলো দিক আছে, সেসব নিয়ে কৃষি অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। সামান্য যেটুকু বুঝেছি, এই কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি বজায় রাখা। বাজার অর্থনীতির নিয়মে এমএসপি থাকলে তা প্রাইস ফ্লোর হিসেবে কাজ করবে, অর্থাৎ বাজারে চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হবে। এমএসপির মূল যুক্তিটা ছিল কম চাহিদার সময়ের যোগান এফসিআই মারফত প্রোকিওর করে বেশি চাহিদার সময়ে কাজে লাগানো। ষাট ও সত্তরের দশকের খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের ভূত মাথা থেকে নামিয়ে যদি ভাবি তাহলে বুঝতে পারব এ দেশে “খাদ্যের অভাব” বস্তুত গত বেশ কয়েক দশকে নেই। রে রে করে তেড়ে আসবেন না, তারপরও যে বহু লোকে আজকের ভারতে পেট ভরে খেতে পায় না ইহা সত্য। কিন্তু তার কারণ খাদ্যশস্যের অভাব নয়, ক্রয়ক্ষমতার অভাব। বহুবার এমন ঘটেছে যখন দেশের একপ্রান্তে লোকে খেতে পাচ্ছে না ঠিক সেই সময়েই অন্য প্রান্তে এফসিআইয়ের গুদামে গম পচছে। ক্রয়ক্ষমতা যদি না বাড়ে, বহুজাতিক সংস্থার অফিসের ছাদে জল জমিয়ে ধানচাষ করলেও যারা খেতে পাচ্ছে না তাদের পাতে ভাত জুটবে না। এমএসপি বিগত যুগের সোনালি স্মৃতিমাখা ভোঁতা তরোয়ালের মত, তা দিয়ে আজকের দিনের যুদ্ধে আর লড়া যাবে না। ভারতীয় কৃষির আজকের দিনে প্রধান সমস্যা, গ্রামীণ জনসংখ্যা বেড়ে যাবার সাথে সাথে কৃষিজমির গড় আকার ছোট হয়ে চলেছে, লক্ষ লক্ষ অতি ক্ষুদ্র জমির টুকরো আলাদা আলাদা হয়ে রয়েছে। আগামী দিনে চাষের বাণিজ্যীকরণ অবশ্যম্ভাবী, ইতিহাসের চাকা লালঝাণ্ডার ডাণ্ডা দিয়ে গুঁতো মেরে উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না। ছোট জোতগুলিকে মুক্ত বাজারে স্বাধীন কোঅপারেটিভের মারফত একজোট করতে না পারলে ভারতের কৃষি আয় বাড়ানো সম্ভব না।

এই কৃষক আন্দোলন মোটের উপর একটি ভুল আবেগ, অনিশ্চয়তা এবং কিছু কায়েমী স্বার্থের জোটের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে আরও একখানা অপ্রিয় কথা বলার আছে। আমরা আর নেহরুভিয়ান সমাজতান্ত্রিক অন্ধকূপে বসবাস করি না। ফলে “বড়লোকরা আন্দোলন করছে, ফলে এই আন্দোলন ভুল” এরকম স্লোগানধর্মী এক বাক্যে ব্যাপারটাকে নাকচ করে দেওয়ার যে কাজটা দক্ষিণপন্থীরা অনেকেই করছেন সেটাও ঠিক হচ্ছে না। এটা ঠিক যে, কৃষিবিলের বিরোধিতায় মূলত বড় চাষীদের প্রতিনিধি দলগুলো সোচ্চার, সম্প্রতি এসএডি শাসক জোট এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। পশ্চিম ভারতের বিপুল সংখ্যক ধনী কৃষকদের প্রায় সকলেই কৃষিবিলের ব্যাপারে সত্যিই উদ্বিগ্ন এবং সত্যি কথা বলতে কী ধনী কৃষক হওয়াটা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো অপরাধ নয়।

কিন্তু এই আন্দোলনের আবেগ যদি ভুলও হয়, তবু সেখানে যখন বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়িয়ে গেছেন তখন প্রশাসনের উচিত পুরো ব্যাপারটাকে ঠাণ্ডামাথায়, সহানুভূতির সঙ্গে, ধারাবাহিক আলোচনার মারফত সমাধান করা। ভুল আবেগের আন্দোলনের পিছনেও যদি পপুলার সাপোর্ট থাকে, তাহলে লাঠি-জলকামান-টিয়ার গ্যাসের হাইহ্যাণ্ডেড অ্যাপ্রোচ নিয়ে সেটাকে ঠেকাতে গেলে পশ্চিম ভারতে যাঁরা একটা নতুন ফল্টলাইন তৈরি করতে চাইছেন তাঁদের সুবিধে করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু লাভ হবে না। আন্দোলনকারীদের সকলে কখনোই খালিস্তানি নন, তাঁদের এভাবে একটা ঢালাও ট্যাগ দিয়ে খালিস্তানিদের দিকে ঠেলে দেওয়া আত্মঘাতী পদক্ষেপ। আমি সিপিএমের নৃশংস সমালোচক। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এক যুগ আগে পশ্চিমবঙ্গের মত অর্থনৈতিক দুরবস্থার চোরাবালিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকা রাজ্যে শিল্পায়নের লক্ষ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ঠিক এইরকম ভুল আবেগের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার সমাধান করতে না চেয়ে বাম সরকার একান্ত উদ্ধত ও অসংবেদীভাবে গায়ের জোরে তার মোকাবিলা করতে যায়। এর চার বছরের মধ্যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বামেদের ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হল এবং রাজ্যের শিল্পায়ন প্রায় এক দশক পিছিয়ে গেল। কেন্দ্রের শাসক দলের শুভানুধ্যায়ীরা নিশ্চয়ই সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাইছেন না।

*
ছবি: আজ বিকালে বিজ্ঞান ভবনে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য যাওয়া কৃষকদের প্রতিনিধি দল। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী আজকের আলোচনায় সমাধানসূত্র এখনও বেরোয়নি, আগামী পরশু আবার আলোচনায় বসছেন কেন্দ্রীয় সরকার এবং কৃষক প্রতিনিধি দল।

Soham Pal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.