এক দেশ এক হাট, বীজ বুনতেই লাভের পাঠ

কল্যাণ গৌতম

প্রবাদপ্রতিম বাক্য “সে কহে বিস্তর মিছা/যে কহে বিস্তর।” নতুন কৃষিবিলের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে রাজনীতির ব্যাপারীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, তারা কৃষক-বান্ধব নন, দালাল-মিত্র। কারণ, ‘কান্না’ দ্বিবিধ — সত্য ক্রন্দন এবং মায়াকান্না; মনুষ্য-অশ্রু বনাম কুম্ভীরাশ্রু। বিলে বা আইনে যা নেই, তা পরিবেশন করে মানুষের কাছে অসত্য এবং অর্ধসত্য পরিবেশন করা অপরাধ।

কৃষি বিষয়ক কী কী আইন পাশ হয়েছে
১. কৃষি পণ্য ব্যবসা-বাণিজ্য (উৎসাহ ও প্রতিশ্রুতি) আইন [The Farmers’ produce trade and commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020]
২. কৃষক (ক্ষমতায়ন ও রক্ষা) মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি পরিষেবা আইন [The farmers (Empowerment and Protection) Agreement on price assurance and farm services Act, 2020]
৩. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন [The Essential Commodities (Amendment) Act, 2020

আইন চালুর পশ্চাতে উল্লেখযোগ্য দিনপঞ্জি
৫ ই জুন: অধ্যাদেশ জারি
১৪ ই সেপ্টেম্বর: বিল আকারে লোকসভায় উপস্থাপন। উপস্থাপক শ্রী নরেন্দ্র সিং তোমর, কেন্দ্রীয় কৃষি, কৃষক কল্যাণ, গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতীরাজ মন্ত্রী।
১৭ ই সেপ্টেম্বর: লোকসভায় বিলটি পাশ
২০ শে সেপ্টেম্বর: রাজ্যসভায় বিলটি পাশ
২৪ ও ২৬ শে সেপ্টেম্বর: রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
২৭ শে সেপ্টেম্বর : আইন ও বিচার মন্ত্রকের দ্বারা সরকারি গেজেট প্রকাশ, ৫ ই জুন থেকে লাগু।

কৃষিপণ্য ব্যবসা-বাণিজ্য আইনে যা লেখা হয়েছে: An act to provide for the creation of an eco-system where the farmers and traders enjoy the freedom of choice relating to sale and purchase of farmers’ produce which facilitates remunerative prices through competitive alternative trading channels; to promote efficient, transparent and barrier-free inter-State and intra-State trade and commerce of farmers’ produce outside the physical premises of markets or deemed markets notified under varoius State agricultural produce market legislations; to provide facilitative framework for electronic trading and for matters connected therewith or incidental thereto.

কৃষি সুরক্ষা আইনে বলা হয়েছে An Act to provide for a national framework on farming agreement that protects and empowers farmers to engage with agri-business firms, processors, wholesalers, exporters or large retailers for farm services and sale of future farming produce at a maturity agreed remunerative price framework in a fair and transparent manner and for matters connected therewith or incidental thereto.

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইনে জোড়া হয়েছে নিম্নলিখিত অংশগুলি — (a) The supply of such foodstuffs including cereals, pulses, potato, onions, edible oilseeds and oils, as the Central Govt. may be regulated only under extraordinary circumstances which may include war, famine, extra ordinary price rise and natural calamities of grave nature.
(b) any action on imposing stock limit shall be based on price rise and an order for regulating stock limit of any agricultural produce may be issued under this Act only if there is (i) hundred per cent increase in thr retail price of horticultural produce, (ii) fifty per cent increase in the retail price of non-perishable agricultural foodstuffs over the price prevailing immediately preceeding twelve months; or average retail price of last five years whichever is lower provided that such order for regulating stock limit shall not apply to a processor or value chain participant of any agricultural produce, if the stock limit of such person does not exceed the overall ceiling of installed capacity of processing, or the demand for export in case of an exporter.

রাজনৈতিক তরজার পর কৃষিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
বিল পেশের পর থেকেই দেশব্যাপী বিরোধীরা অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছে। বিরোধী পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে সহায়ক মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব সরকার আর বহন করবে না। পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলি কৃষিপণ্যের দরদাম নিয়ন্ত্রণের অধিকার ভোগ করবে, তারা কৃষককে কুক্ষিগত করে রাখবে, সরকার রক্ষাকবচ দিতে পারবে না। এ প্রেক্ষিতে কৃষিমন্ত্রী স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল সংগ্রহের কাজ যেমন চলছে, সেই ভাবেই চলবে। প্রধানমন্ত্রীও ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন।

২৪ শে সেপ্টেম্বর কৃষিমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র সিং তোমর বিলের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির অপপ্রচারের প্রেক্ষিতে দু’টি টুইটার করেন —

  1. Firstly, Bill will give price guarantee to farmers at time of sowing. Second, selling agreements will only deal with the produce and there can be no mention of farmland. Farmers can opt out of agreement, traders cannot. Farmers and their land are fully protected. অর্থাৎ, প্রথমত এই বিল চাষীকে বীজ বোনার সময়েই ফসলের দামের গ্যারান্টি দেবে৷ দ্বিতীয়ত, বিক্রয় চুক্তি কেবলমাত্র উৎপাদনের উপর, তার সঙ্গে কৃষিজমির ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। কৃষক চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে, ব্যবসায়ী পারবে না। কৃষক ও তার কৃষিজমি পুরোপুরি সুরক্ষিত।
  2. Has MSP ever been part of law? Congress ruled for 50 years, why didn’t they incorporate it in law? They’re making issue as they don’t have anything to criticise. MSP has always been Govt of India’s administrative decision and remains so. অর্থাৎ, কোনোদিনই কি ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য আইনের অঙ্গ ছিল? কংগ্রেস তো ৫০ বছর শাসন করেছে। তারা কেন এতদিন তা আইনের অঙ্গীভূত করল না? তারা এটাকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু করেছে, যেহেতু এই বিলের বিরুদ্ধে সমালোচনার আর কোনো জায়গা নেই। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সবসময় ভারত সরকারের একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তই ছিল এবং থাকবে। বিরোধীরা যা বলছে তা কী সত্য?

বামপন্থী, তৃণমূলী ও কংগ্রেসী ঘরানারা সংবাদপত্রগুলির দাবী এই আইনে আত্মনির্ভর নয়, আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে কৃষকেরা। এই বিল ও আইনপ্রণয়ন এক তুঘলকি কাণ্ড, স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত; এতে নাভিশ্বাস উঠবে কৃষকের।

মূল সত্য হল, এই আইন কিন্তু বিচ্ছিন্ন চিন্তা-ভাবনা থেকে করা হয় নি। করা হয়েছে আত্মনির্ভরশীল ভারতরাষ্ট্র নির্মাণের প্রয়াসের হিসাবে, পরিপূরক ও সাযুজ্যপূর্ণ সরকারি প্রচেষ্টারূপে। যেমন নতুন শিক্ষানীতিতে সামগ্রিক কৃষিশিক্ষার বিশেষ বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে, ক্লাস সিক্স থেকে পেশাভিত্তিক ও কারিগরি শিক্ষার সূত্রপাতে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষুদ্রশিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া; বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধিকরণ; তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে কৃষি-গ্রামীণ শিল্পকে উৎসাহ দান; ভারতবর্ষকে ‘Food busket of the world’ হিসাবে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক স্তরে সমৃদ্ধ ও সশক্ত-ভারতের আত্মপ্রকাশের দীপ্তি; ২০২০ সালের মধ্যে কৃষকের দ্বিগুণ লাভ পাইয়ে দিয়ে কৃষিকাজে আকৃষ্ট করা — এ সমস্তই হচ্ছে এক অভিন্ন চিন্তনের ফলশ্রুতি। একে যারা তুঘলকি বলছেন, তারা আসলে কেবলমাত্র তুঘলকের ইতিহাসটুকুই পড়েছেন, পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়, কারণ ইতিহাস অমন করেই লেখা হত, ভারতবর্ষে তুঘলকি ইতিবাসবেত্তাদের জমপেশ আড্ডা ছিল।

যারা কৃষি বিলের রাজনৈতিক বিরোধী, তারা কোন জায়গা থেকে বিরোধিতা করছেন? তারা কী বলতে চান, এই আইন আসার আগে দীর্ঘ ৭০ বছর যাবৎ কৃষকের অবস্থা ভালো ছিল? আইন আসার পর সব খারাপ হয়ে যাবে? মানে, সব কৃষক এখন ঠিকঠাক বাজার দর পাচ্ছেন, লাভ নিয়ে ঘরে যাচ্ছেন? এখন আইন রূপায়ণ হলেই সব বন্ধ হয়ে যাবে? তারমানে কৃষকদের জন্য ৭০ বছর যাবৎ বলবৎ রাখা ব্যবস্থাটাই ভালো, তাই তো? মানে অসংখ্য দেশী ফড়ে, দালাল, রাজনীতির রক্তচক্ষু দেখানো নেতার নিয়ন্ত্রণে থাকা বাজার মান্ডিতে চাষীরা খুব ভালো দাম পাচ্ছেন! বোঝাতে চাইছেন, এখন কৃষক নিজের ইচ্ছেমতো চাষ করে, তা বিক্রি করতে পারছেন! বিক্রির কোনো চিন্তা নেই, ফসল বাড়ি এসে লাভজনক দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ফড়েরা? চাষে লাভ হওয়ায় সব চাষীই চাষে নিয়োজিত! গ্রামে চাষ ছেড়ে কেউ শহরে আসে নি? গ্রাম-উদ্ভূত পরিযায়ী শ্রমিক — এসব মিথ্যে কথা? তারা কী ভাবছেন, যারা সংগঠিত নয়, যাদের উপর সহজেই প্রভুত্ব বিস্তার করা যায়! বোকা হাবা কৃষকের জন্য না ভেবে চালাকচতুর, রাজনীতি-নিবিড় কমিশন এজেন্টদের জন্য ভাবলেই হবে? দালালরা হল্লা করতে পারে, সুবিধা পেলেই রাজনীতির ঝোলার মধ্যে আশ্রয় নিতে পারে; ধমকাতে চমকাতে পারে। আর পারে বলেই তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি আছে। সেজন্যই কৃষককে বাদ দিয়ে দালালদের দেখতে হবে? বহু রাজনীতির নেতা কমিশন এজেন্ট হয়ে আড়তদারি-গদিতে বসে আছেন। তাই তাদের হয়ে চিল-চীৎকার করে বিলের শুভঙ্করী দিকগুলি আড়াল করা হচ্ছে।

সুপারফাস্ট ট্রেন চালু হবার পর যখন অনেক স্টেশনে না দাঁড়িয়ে যাত্রীস্বার্থে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, তখন কিছু স্টেশনের স্টলে বিক্রিবাটা কম হয়, সেই স্টেশন চত্বরের বাইরে থাকা হোটেল-রেষ্টুরেন্ট, পানশালায় যাত্রী সংখ্যাও কমে যায়। ধরা যাক এই ক্ষোভ প্রশমনের জন্য সব স্টেশনে ঘ্যানঘেনি-দাঁড়ানো হতে থাকলো, তাতে যাত্রীস্বার্থ বিঘ্নিত হবে। কারণ বহু জরুরি কাজে দূরপাল্লায় যাত্রীরা যান, কেউ চিকিৎসার জন্য, কেউ চাকরির পরীক্ষা দিতে, কেউ জরুরি পরিষেবা দিতে। তেমনই ‘ক’ স্থান থেকে ‘খ’ স্থানে পৌঁছাতে উড়ালসেতু যখন নির্মিত হয়, কোনো রাস্তা মেরামতের প্রয়োজনে কোনো বিশেষ দিকে গাড়িঘোড়া ঘুরিয়ে দেওয়া হয় — সবটাই যাত্রীস্বার্থের কথা ভেবে, সেই রাস্তায় গড়ে ওঠা পানশালা, রেষ্টুরেন্টে বিক্রিবাটার আবদার বজায় রাখার জন্য তো নয়! তেমনই এই কৃষি বিষয়ক আইন কৃষক ও ভোক্তার প্রয়োজনের কথা ভেবে করা হয়েছে — কৃষক দাম পাবেন বেশি, দালাল-হীন বাজারে ভোক্তার মূল্য চোকাতে হবে কম। দালাল শ্রেণীর স্বার্থ দেখার জন্য এই আইন তৈরি হয় নি। কৃষকের স্বেদ-শোণিত উজাড় করা ফসলে, শ্রমকিণাঙ্ক কঠিন হাতের সামনে ত্রস্তা-ধরণীর নজরান-রূপ ফসলে বাটপারি করার সুযোগ জিইয়ে রাখার জন্য এই আইন করা হয় নি। যাদের স্বার্থে ঘা লেগেছে, তারাই চ্যাঁচাচ্ছে, তারাই উত্তাল রাজ্যসভায় বিলের প্রতিলিপি, রুল বুক ছিঁড়ছে — এটা ছিন্নতার রাজনীতি, এটা দালালির রাজনীতি; এটি যেদিন কৃষক বুঝতে সক্ষম হবে তখনই আসবে আত্মনির্ভর কৃষি।

অনেকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, অকালি নেত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরসিমরত কউর বাদলের প্রতিবাদ এবং পদত্যাগ; যেন সরকারের ঘরেই আগুন লেগে গেছে! কে এই হরসিমরত? তিনি হচ্ছেন পাঞ্জাবে বিজেপির শরিক আকালি দলের প্রধান সুখবীর সিং বাদলের পত্নী। অনেকেই জানেন, সুখবীর পাঞ্জাবের একজন হেভিওয়েট মজুতদার, জানেন তাদের কৃষি ব্যবসার বিপুল আয়ের পরিমাণ, কৃষকদের মধ্যে কমিশন এজেন্ট হিসাবে তার কমিশন শতাংশ। তথ্যভিজ্ঞ মহল অনুমান করতে পারবেন, এক ঝটকায় ওই নেতাদের কত হাজার কোটি টাকা কমিশন বাবদ লাভ করা থেকে ক্ষতি হল। মহারাষ্ট্রেও একই অবস্থা! শরদ পাওয়ার কন্যা সুপ্রিয়া সুলের কৃষি থেকে কত হাজার কোটি টাকা বা লক্ষ টাকার আয়! বিশেষজ্ঞ মহল জানেন রাজনীতিতে কোন কোন পরিবার পেঁয়াজ, লঙ্কা, আঙুরের ব্যবসায়ে নিয়ন্ত্রণ পুষে রেখেছে। তাই এই আইন সরকার রচনা করেছে দালাল বৃক্ষের ডাল কাটতে নয়, সরাসরি শিকড় উৎপাটন করতে। শরিক দল, আপন দল, বিরোধী দল বাছবিচার না করে এই আইন সরকারের এক নির্মোহ-চিন্তন; তাতে কোনো সুখী নেতা ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বেরোবেন কিনা, সেটা চিন্তা করলে কৃষকদের প্রতি অবিচার হবে।

বিরোধীরা কেন হৈচৈ করছে

বিরোধী দলের পাণ্ডারা হৈ-হট্টগোল কেন করছে, কারণ কৃষকদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়াতে চাইছে তারা। এবং নিজেদের রাজনৈতিক লাভ জোটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজের জমি নিয়ে কৃষকের সবসময় একটা আতঙ্ক আছে, একটা দীর্ঘ লোকস্মৃতির ফলশ্রুতি এই আতঙ্ক। হাজার বছর ধরে বিদেশি আক্রমণকারী, বিদেশী শাসক, তাদের বশংবদ জমিদার, ধর্মীয় মৌলবাদীদের যোগসাজশে নিজের বাপ-ঠাকুরদার জমি হারিয়েছে অনেক ভারতবাসী। কাজেই জমি বন্ধকের কথা গেলালে, জমি হারানোর মিথ্যে ভয় দেখালে কৃষককে এককাট্টা করা যাবে, লোকও জমতে পারে বিস্তর। তাই প্রথমে ভয় ধরানো কথা বলতে হবে — এই বিলে জমি চলে যাবে কৃষকের। যেন ‘কাকে কান নিয়ে উড়ে গেছে’। জমি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই! বাস্তব সত্য হল, এই বিলে জমি নেওয়ার কোনো কথা নেই। আছে মধ্যসত্ত্বভোগীর অন্যায় ভীড় খালি করে দেওয়ার কথা, কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেবার বন্দোবস্ত, তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা। চেষ্টা হচ্ছে কৃষিপণ্যরূপ লক্ষ্মী যেন মাটিতে গড়াগড়ি না খায়। ফসল অযত্নে পচে নষ্ট হওয়া মানে সারা দেশের ক্ষতি। সারা বিশ্বের বহুদেশে বহু অযোগ্য শাসনে মানুষের মুখে অন্নের যোগান নেই। আর একটি দেশে ফড়েদের উৎপাতে আলু-টমেটো থেঁতলে গড়াগড়ি খাবে, দাম পাবে না – এ হতেই পারে না। অধিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা হবে, সংরক্ষণের আরো বিপুল আয়োজন হবে — তবে একটা দেশ লক্ষ্মীমন্ত দেশ হয়ে উঠতে পারে। খনিজতেল উৎপাদনকারী দেশগুলি সমবেতভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সারাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, তবে কেন ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ফসল-ভাণ্ডার নিয়ে সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে না? ভারতের এই নবতর রাজবেশ ধারনের বিরোধীরাই আসলে আত্মনির্ভর ভারতের বিরোধী, কৃষির সর্বোচ্চ গরিমায় পৌঁছানোর বিরোধী। এই বিরোধী শক্তি ভারতকে লক্ষ্য পৌঁছাতে না দেবার পণ করেছে, দেশবাসী তা যত তাড়াতাড়ি বোঝে ততই মঙ্গল।

কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে!

এই আইন পাশে কংগ্রেসের সমর্থন দেওয়ার কথা, সেখানে তারা বিরোধিতা কেন করছে? জানা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে APMC অর্থাৎ এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেটিং করপোরেশন আইন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাতে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পণ্য বিক্রি সংক্রান্ত বাধা দূর করার কথা ছিল, আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারের বাধা দূর করার কথা ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আইন তুলে দেবার, ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই মর্জিমাফিক পণ্য বিক্রির কথা। তাহলে তারা বিরোধিতা করছে কেন? বিরোধিতা করছে, কারণ বিরোধী আসনে বসে যা জ্ঞান দেওয়া যায়, ক্ষমতায় বসে তা রূপায়ণ করার দম থাকে না অনেক রাজনৈতিক দলের। কংগ্রেসের হয়েছে সেই দশা! রবীন্দ্রনাথের ‘জুতো আবিষ্কার’-এর মতো, “কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে!”

তৃণমূল কংগ্রেসেরও এই আইনের বিরোধিতা করা নৈতিকভাবে অনুচিত। ২০১৪ সালে রাজ্য সরকার চালু করেছিলো এমন আইন যার ফলে আজ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা যেমন মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি, রিলায়েন্স ফ্রেশ, পেপসি তাদের প্রয়োজনের নানান ফসল চাষ করিয়ে নিতে পারছে।

অনেক রাজ্যে কৃষি বিপণন আইন পরিবর্তন করে এমন করা হয়েছে, যার ফলে চাষীদের পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয় নির্দিষ্ট মান্ডিতে, আর মান্ডি চালায় সেই রাজ্যের শাসকদলের ছোটো বড় নানান মাপের নেতা। তারা সেখানে কমিশন এজেন্ট হিসাবে প্রতিভাত।

কৃষিবিল নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ছড়া

মারছে কারা?
##কচ

আতঙ্কটা ছড়িয়ে কৃষে
ভোটে জেতার নেশা
বিল-বিরোধী সাপের বিষে
দালালীটাই পেশা।
মায়াকান্না যেসব দলের
কৃষক-দরদ ভাব
চাষের দাম দেয়নি ফলের
এটাই যে স্বভাব!
বাঁচাও যদি গরীব চাষী
বাজার খুলে দিয়ে
চ্যাঁচাও ওরে গুপ্তবাসী
থামলো যেন বিয়ে!
গরীব গরীব গরীব করে
রাখবো বেঁধে পায়
কৃষিবিলের আইন জোরে
ওদের নৌকা ধায়।
কোথায় আছিস কোথায় যে বিষ
ডুবাস চাষীর না
সাঁতার দিয়েও বাঁচবি না রে
ঝোলাস ওদের গা।
বলবে ওরা মরেছে গলে
কাপাস চাদর ঝুলে
আমরা সদাই কৃষক দলে
খবর দিও ঘুলে।

সত্য আসল হয় যে মিছে
হাজার মিথ্যে বুলি
সবাই ভাবে রুপোর বিছে
দিচ্ছে আমায় তুলি।
কৃষক-বাঁচার চাও যদি মন
সারা জীবন যারা
তোমায় দিলে পেটের সে ধন
বইয়ে ঘামের তাড়া।
ওদের হয়ে একটি তালি
না হয় দিলে আজ
ফড়ের গুড়ে পড়ল বালি
একেই বলো বাজ?

কৃষিবিল বিষয়ে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের অবস্থান

২২ শে সেপ্টেম্বর ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের পক্ষ থেকে অখিল ভারতীয় মহামন্ত্রী শ্রী বদ্রী নারায়ণ চৌধুরীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি বিশেষ পত্র সর্ব সাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রচারিত হয়েছে, তাতে কিষান সঙ্ঘের অভিমত ব্যক্ত রয়েছে।

শ্রী চৌধুরী লিখছেন, ৫ ই জুন কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা তিনটি অধ্যাদেশ আনা হয়েছিল, যেখানে ভারতীয় কৃষক দেশ জুড়ে যেকোনো কৃষিজ পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এটিই বিল রূপে লোকসভা ও রাজ্যসভায় পেশ ও অনুমোদিত হয় এবং তা মহামহিম রাষ্ট্রপতিজীর কাছে স্বাক্ষর করার জন্য প্রেরিত হয়। পরে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ভারত সরকার তা আইন রূপে গেজেট আকারে প্রকাশ করে।

বিল সম্পর্কে ২২ শে সেপ্টেম্বর ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের পর্যবেক্ষণ ছিল, এই বিল কৃষককে পণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়াতে সহায়তা দেবে। মান্ডি বা কৃষি-বাজারে যেভাবে কৃষকেরা আর্থিকভাবে শোষিত হয়, মানসিকভাবে প্রতারিত হয়, তা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করবে এই বিল৷ কিন্তু পাশাপাশি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ। কৃষি পণ্য বেচাকেনায় লাভকারী মূল্য যে মিলবে, কৃষকের সঙ্গে যে ধোঁকাবাজি করা হবে না, সে বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি এই কানুনের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে সমর্থন মূল্যের কথা (Minimum Supporting Price) নেই। এই প্রেক্ষিতে কিষান সঙ্ঘের দাবী, যদি কৃষককে ঠিকঠাক দাম দিয়ে চাষে লাভ পাইয়ে দিতে হয়, তাতে কমপক্ষে ফসলের সমর্থন মূল্যে বেচাকেনার কানুন আনা উচিত। একটি আলাদা কানুন তৈরি করে দেশের যেকোনো ফসল সমর্থন মূল্যের কমদামে বিক্রি হবে না, সেই পথ সুনিশ্চিত করার আইন আনতে হবে।

কিষান সঙ্ঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারের ঘোষিত উদ্যোগ যদি সফল করতে হয়, তাহলে এই পরিবর্তনগুলি করতে হবে।
১. কৃষিজ যাবতীয় পণ্য যেকোনো স্থানে ক্রয়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের কম দেওয়া যাবে না। এজন্য আলাদা করে আইন তৈরি করতে হবে।
২. কৃষি ব্যবসায়ীদের নিবন্ধীকরণ কেন্দ্রগুলি ব্যঙ্কের সিকিউরিটির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে এবং সেই সংক্রান্ত জ্ঞাতব্য তথ্য সরকারী পোর্টালের মাধ্যমে উপলব্ধ হতে হবে।
৩. এই সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদ নিরসনের জন্য স্বতন্ত্র কৃষি ন্যায়াধিকরণ স্থাপন করতে হবে। এবং এই বিবাদ প্রত্যেক জেলার কৃষকদের জন্য আলাদাভাবে নিরসন করতে হবে।
৪. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বা জীবনাবশ্যক বস্তুর অধিনিয়ম সংশোধন করার সময় ভাণ্ডার সীমার উপরের সমস্ত বাধা সরিয়ে দিতে হবে। শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতেই এই নিয়ম চালু হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ এই বিল/আইনের বিরুদ্ধে নয় তা পরিস্কার করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেবল কৃষকদের মূল্য গ্যারান্টির ক্ষেত্রে তারা অধিক সচেতন, পৃথক কানুন চায়। অন্য রাজনৈতিক দলের অবস্থান আর ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের অবস্থান এক নয়, অনেকে তা একইভাবে প্রচার করতে চাইছে, এটাই অপপ্রচার। পাশাপাশি স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেছিল কৃষি বিলে ন্যূনতম বিক্রয় মূল্যের বা এম.এস.পি-র গ্যারান্টি দেওয়া হোক এবং এম.এস.পি থেকে কম দামে ক্রয় হলে সেটা যেন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়। এখন আগামীদিনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে সরকার নতুনভাবে কী করে সেটাই দেখার। তবে এই বিলের সবচাইতে বড় পাওনা হল, “এক ভারত এক বাজার”। মানসিক চাপ দিয়ে কৃষককে জোর করে মান্ডিতে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করার দিন শেষ। সাধারণ মানুষও আশা করবে জিনিসের দাম কমার, কারণ দালাল শ্রেণীর অপসারণ এই আইনের লক্ষ্য। এই আইনের ফলে আগামীদিনে ভারতের কৃষি উৎপাদন ও উৎকর্ষতা বাড়বে, তথ্যভিজ্ঞ মহল একরকম নিশ্চিত। বাড়বে কৃষকের আয়। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে কেন্দ্র সরকার যে ডাক দিয়েছিল, তা রূপায়ণ হওয়া এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ সরকারের। কৃষকের সন্তানেররা দিকে দিকে কেন্দ্রীয় সরকারী প্রকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার নানান প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুক, সাংখ্যিকী প্রযুক্তিতে পারদর্শী হয়ে উঠুক, দেশের সাধারণ মানুষের কৃষিজীবী মানুষের কাছে এই আবেদন করছে৷

@ কল্যাণ গৌতম
ছবি : ড. গোপী ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.