কৃষিপ্রধান বঙ্গদেশে ধান মুখ্য ফসল তাই নতুন চাল পৌষ পার্বণের মুখ্য উপাদান। আমাদের দেশের সব প্রান্তে পৌষসংক্রান্তির দিন ভোরবেলা স্নান করে নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা করে, নতুন চালের বিভিন্ন ব্যঞ্জন রান্না করে, ভগবানকে নিবেদন করার পর তার প্রসাদ পাওয়ার রীতি অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। কোথাও খিচুড়ি, কোথাও পায়েস, কোথাও বা আরও অনেকরকম নতুন চালের পদ। প্রকৃতির দান নতুন চালই হলো এই পার্বণের পূজ্য।
পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটিতে বিভিন্ন রকমের মিষ্ঠান্ন, পিঠেপুলি বানানো হয়ে থাকে। ঘরে ঘরে নতুন চাল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পদ তৈরি করা হয়। নানান রকমের পদ হলেও এর জন্য প্রয়োজন কিছু ঘরোয়া জিনিস যেমন—নতুন চাল, নতুন চালের গুঁড়ো, নারকেল, নতুন খেজুর গুড়, দুধ, চিনি, সামান্য ময়দা, জল। বর্তমানে টেলিভিশনের পর্দায় রান্নার যেসব ‘শো’ প্রদর্শিত হয়, তার সঙ্গে এইসব পরম্পরাগত রান্নার উপাদান, পদ্ধতি, স্বাদ, স্বাস্থ্য ও অর্থব্যয় কোনোটাই তুলনা করা যায় না। এক কথায় অতুলনীয় এই ঘরোয়া পদগুলি। সব বয়সেই মানুষেরাই পছন্দ করেন পিঠে-পুলি-পায়েস। অনেকরকমের কিছু হলো— আকে পিঠে বা সরা পিঠে, পুলি পিঠে, দুধ-পুলি, পাটিসাপ্টা, নতুন চালের পায়েস, চোহি বা চুষির পায়েস ইত্যাদি। এছাড়া নতুন ফসল রাঙা আলুর বড়াও বানানো হয়ে থাকে এই সময়।
প্রথমে আসি,আস্কে পিঠে বা সরা পিঠে প্রসঙ্গে। এর জন্য প্রয়োজন ঢাকনা সমেত মাটির সরা। এছাড়া চাই বেগুনের বোঁটা। একটি পাত্রে নতুন আতপ চালের গুঁড়ো, নারকেল কোরা, সামান্য নুন এবং জল দিয়ে মাঝারি ঘোল বানাতে হবে। এবার মাটির সরা এবং ঢাকাটি কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে নিতে হবে। এখন গ্যাসে কম আঁচে মাটির সরাটি বসিয়ে বেগুন বোঁটাতে সামান্য তেল নিয়ে তা সরার ভেতর দিকে লাগিয়ে তাতে একহাতা চাল গোলা দিতে হবে। এরপর ঢাকা দিয়ে, সেই ঢাকার চারপাশে সামান্য জল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হবে। ওই জল বুদ্বুদ্ হয়ে শুকিয়ে গেলে ঢাকা সরিয়ে আস্তে করে আস্কে পিঠে বা সরা পিঠে তুলে নিতে হবে, যা দেখতে অনেকটা ইডলির মতো। নতুন খেজুরের ঝোলা গুড়ের সঙ্গে খুবই উপাদেয় এই পিঠে। সাধারণত গৃহস্থ বাড়িতে এই পিঠে দিয়েই ওইদিন পিঠে বানানো শুরু হয় এবং প্রথম বানানো পিঠেটি অগ্নিদেবতাকে নিবেদন করা হয়।
দ্বিতীয় বা তার পরের তৈরি পিঠেগুলি প্রসাদ হিসাবে খাওয়া হয়। ব্যবহারের পরে ওই মাটির সরা এবং ঢাকনা বাড়িতে ভালোভাবে রাখা থাকে। আগামী বছর নতুন সরা এলে, তখন ওই পুরানো সরা ফেলে দিতে হয়।
পুলিপিঠের জন্য প্রয়োজন নতুন চালের গুঁড়ো, সামান্য নুন, নারকেল এবং নতুন খেজুর গুড়। প্রথমে নারকেল কুরিয়ে গুড় দিয়ে মেখে কড়াইতে জ্বাল দিয়ে নাড়াচাড়া করে নারকেলের ‘ছেই’ বানাতে হবে। অনেকে এতে ক্ষীরও দিয়ে থাকেন। এবার চালের গুঁড়োতে সামান্য নুন মিশিয়ে অল্প অল্প করে গরম জলে রুটির আটার মতো মেখে ‘খোলা’ নামাতে হবে। বেশ নরম মাখা হলে গরম অবস্থাতেই গোল করে নারকোলের ছেইয়ের পুর দিয়ে পুলির আকার দিয়ে ধারগুলি ভালো করে বন্ধ করে, পুলির গায়ে হাল্কা তেল লাগিয়ে ভাপে বসাতে হবে। আগে হাঁড়িতে জল ফোটাতে দিয়ে তার ওপর কাপড় বেঁধে পুলি সাজিয়ে দিয়ে কম আঁচে ১৫ মিনিট রাখলেই সুস্বাদু পুলিপিঠে তৈরি।
দুধপুলি বানানোর জন্য পুলি ভাপে সেদ্ধ করে ফুটন্ত দুধের আঁচ কমিয়ে সামান্য চিনি দিয়ে আধঘণ্টা মতো ফোটাতে হবে। এরপর ঠাণ্ডা হলে নতুন গুড় ভালভাবে মিশিয়ে নিলে তৈরি দুধপুলি।
পাটি সাপ্টার জন্য আগে থেকে অল্প চিনি জলে গুলে নিতে হবে। নতুন চালগুড়ি এবং চিনি গোলা জলের মিশ্রণ বানিয় রাখতে হবে। এবার কম আঁচে চাটু রেখে বেগুন বোঁটায় করে সামান্য সাদা তেল চাটুতে লাগাতে হবে। এরপর গোলা ছড়িয়ে দিয়ে গোলাকার হলে, তার একদিকে নারকেলের ছেই দিয়ে খুন্তির সাহায্যে গোল করে ঘুরিয়ে পাটিসাপ্টার আকার দিতে হবে। উপাদেয় এবং ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি পিঠেগুলি সত্যিই অনবদ্য।
পায়েস বানাবার জন্য প্রয়োজন দুধ, নতুন গোবিন্দভোগ চাল, চিনি ও গুড়। দুধ ফুটে উঠলে তাতে পরিমাণমতো চাল (সাধারণত একলিটার দুধে ৫০ গ্রাম চাল) দিয়ে কম আঁচে বসিয়ে, মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হবে। চাল সেদ্ধ হলে তাতে চিনি দিয়ে ফোটাতে হবে। ঠাণ্ডা হলে তাতে নতুন খেজুর গুড় মিশিয়ে দিতে হবে।
সুতপা বসাক ভড়