ভারতীয় কিষান বার্তা, দত্তপন্থ ঠেংড়ী বিশেষ সংখ্যা, – ১০ ই নভেম্বর, ২০২০ – সম্পাদকীয়

ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ, ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ সহ একগুচ্ছ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ বাপুরাও ঠেংড়ী। তাঁরই জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে ২০১৯-২০ বর্ষে। রাষ্ট্রঋষির জন্মশতবর্ষ উৎযাপনে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ প্রথমাবধি সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু সঙ্ঘ চেষ্টা করছে শুধু শ্রবণে, অধ্যয়নে, মননে নয়; রাষ্ট্রঋষি যেন উপস্থিত হন আমাদের কর্মে ও রূপায়ণে। আমাদের সার্বিক বোধের দুয়ারে দত্তপন্থজীর উপস্থিতি চিরকালীন হোক।

দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী এক অসাধারণ সংগঠক, এক অতুল্য দেশপ্রেমিক, অতল মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। শুধু সংগঠন রচনার মধ্যে তিনি নিজের কাজটি সীমাবদ্ধ রাখেন নি। কার্যকর্তা নির্মাণ করেছেন, নির্মাণের সূত্র দিয়েছেন, সংগঠক ও সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলেছেন, সংগঠক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারণ সংগঠক নিজে নির্মিত না হলে কোনো সংগঠনই দাঁড়ায় না, কাউকেই দাঁড় করানোও যায় না। আবার নেতৃত্বহীন সংগঠন কোনো কাজ করলে শেষ পর্যন্ত তা এগোয় না। সামগ্রিক নেতৃত্বের দ্বারাই সংগঠনের ভিত রচিত হয়।

ঠেংড়ীজী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের কার্যকর্তাদের কৃষক আন্দোলনে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনি উদাহরণ স্বরূপ বলেছেন, ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রথম কৃষক আন্দোলন হয়েছিল গুজরাটে; ৪০-৫০ জনের একটি যুবদল সেখানে সক্রিয় হয়েছিল, তারা সাইকেল-মোটরসাইকেলে চড়ে হাজার হাজার কৃষককে জড়ো করালেন; পুলিশ লাঠি চালালো, গোলাগুলি চললো, অনেকে হতাহত হলেন, তার মধ্যে দু’জন মহিলাও ছিলেন। তখন গুজরাটে কংগ্রেসী শাসন, মুখ্যমন্ত্রী অমর সিং চৌধুরী। সবাই মুখ্যমন্ত্রীকে বললেন, আপনি এদের সঙ্গে কথা বলুন; এদের দাবী কী? মুখ্যমন্ত্রী বললেন, আমি কার সঙ্গে কথা বলবো? আমি কী হাওয়ার সঙ্গে কথা বলবো? এটা তো একটি নেতা-বিহীন আন্দোলন! শেষে সংগঠনের তরফ থেকে হাসমুখভাই দাবে-কে সংগঠনের তরফে পাঠানো হল। মুখ্যমন্ত্রী কথা বললেন। অর্থাৎ বোঝা গেল, সংগঠনের জন্য সামগ্রিক নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। তাই ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের সমস্ত স্তরের কার্যকর্তাকে সবসময় আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখতে হবে, যথাযথ মাঙ্গলিক ও হিতকরী নেতৃত্ব দিতে হবে। বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনো কাজ করলে চলবে না। কোন কাজের কী গুরুত্ব, তা বুঝতে হবে। কোনো অশুভ শক্তি যেন কৃষক-আন্দোলনের নামে সহজ-সরল মানুষদের বিপথে চালিত না করেন, তাও খেয়াল রাখতে হবে। ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে একটি বৃহৎ শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে, তাই কার্যকর্তারা যেন সাংগঠনিক শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে অরাজনৈতিক বাতাবরণে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রনির্মাণে সামিল হন। কৃষক সমাজের বিকাশের পাশাপাশি কারা তাদের পক্ষে বিপদ, তার প্রতিও সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে। সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই সংগঠনে যত এগিয়ে আসবেন, ভারতবর্ষ ততই এগিয়ে যাবে। ভারতবিকাশে কৃষি সম্পৃক্তি কোনোভাবেই হেলাফেলা করার বিষয় নয়। কৃষকের ক্ষমতায়ন ও আয়বৃদ্ধি করা হলেই ভারতের শ্রীবৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ঠেংড়ীজীর স্বপ্নপূরণ করতে হলে আত্মনির্ভর কৃষি চাই। ভারতের গ্রামগুলিকে যথাসম্ভব উৎপাদনে, আয়োজনে, জীবনচর্যায় আগের মতোই সাবলম্বী করা চাই।

ঠেংড়ীজীর সাংগঠনিক মার্গদর্শন যেন আমাদের চলার পথে যথাযথ পাথেয় হয়ে ওঠে। কার্যকর্তা কীভাবে কাজ করবেন? তাঁকে প্রতিটি মজদুর বা কৃষককে বা সদস্যকে প্রাধান্য দিতে হবে, তাকে জাগ্রত করতে হবে, নির্দিষ্ট কাজের জন্য উদ্যত করতে হবে, তাকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে সংগঠনের মতাদর্শে। এটাই সামগ্রিক নেতৃত্বের মূল কাজ।

নেতৃত্ব কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবেন? এ প্রসঙ্গে দত্তপন্থ ঠেংড়ী আমেরিকান সাহিত্য সমালোচক স্টিফেন কোভে-র প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। কোভে দেখিয়েছিলেন, ইংরেজি সাহিত্যে দু’শো বছরের ইতিহাসে প্রথম ১৩০ বছর ছিল সাহিত্যে ব্যক্তিচরিত্র নির্মাণের যুগ; যাকে বলা হয় Character Ethic. How to become great? কী করে চরিত্রগুলি নিজেরা মহৎ হয়ে উঠেছে। কিন্তু পরবর্তী ৭০ বছরে দেখা গেলো চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে Personality Ethic. How to appear great. তারা ‘গ্রেট’ কিনা বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু ‘গ্রেট’ দেখাতে হবে। গ্রেট সাজতে ও সাজাতে হবে।

এর প্রভাব ভারতবর্ষেও পড়লো, কারণ শিক্ষিত ভারতীয়রা সবসময় পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে। ফলে ভারতীয় সাহিত্যে এই How to become great বদলে গিয়ে How to appear great — এই চর্চা শুরু হল, তার প্রতিমা নির্মাণ চললো। এল ১৯৪৭; যা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছর। স্বাধীনতার আগে আর পরে ভারতীয় নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য পাল্টে গেল। ৪৭-এর আগে ছিল How to become great, ৪৭-এর পর হল How to appear great.

একজন কৃষক-নেতার বা যেকোনো নেতার কী কী সদর্থক গুণ থাকা উচিত, আর কী কী নঞর্থক গুণ থাকা উচিত নয়, সে বিষয়ে আলোচনা জরুরী। দত্তপন্থ ঠেংড়ী উল্লেখ করেছেন পিটার ড্রাকারের ‘Science of Management’ এবং ‘Practice of Management’ বইটির কথা। বলেছেন ‘Beware of Charisma’-র কথা, ক্যারিশ্মা থেকে সাবধান হবার কথা। রিয়ালিটি প্রতিষ্ঠার কথা জানতে হবে, অভ্যাস করতে হবে, বলতে হবে, শেখাতে হবে। একজন নেতা কেমন হওয়া উচিত, তা আপন আচরণে, নিজের সৌকর্যে শিখিয়েও দিতে হবে। দত্তপন্থজীর জীবন ও দর্শন পুরোটাই আমাদের শিক্ষণীয়। তিনি সংগঠনে কেবলই দিতেই এসেছিলেন, কিছু নিতে আসেন নি। এমন নির্লোভ ব্যক্তিত্ব ভারতবর্ষে কমই জন্মেছেন। নেতাকে সবসময় হতে হয়, How to become great; কখনোই ইমেজ ব্রিডিং না করা।

দত্তপন্থজী উদাহরণ দিয়েছেন, ইমেজ ব্রিডিং আছে এমন তিন বিশ্বনেতার, যারা বিগত শতকে বহুশ্রুত, অথচ হারিয়ে গেছেন; হিটলার, মুসোলিনি এবং স্ট্যালিন। তারা স্ফূলিঙ্গের মতনই বিরাট ক্যারিশ্মাতে প্রচণ্ডভাবে জ্বলে উঠলেও বেশিদিন স্থায়ী থাকতে পারেন নি। অথচ পাশাপাশি আরও দুই বিশ্বনেতার কথা বলা যায়। প্রথম জন জার্মানীর অ্যাডেনআওয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশনেতার অভাব হয়ে পড়ে সেদেশে। কার হাতে দেশের দায়িত্ব দেওয়া হবে? একজন আর্মি অফিসার অ্যাডেনআওয়ার-এর নাম এলো পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলার হিসাবে। তিনি সেনা অফিসার, সৎ, দায়িত্ববান, নিয়মানুবর্তী; কিন্তু রাজনীতিবিদের ক্যারিশ্মা ছিল না তার, সামাজিক পরিচিতিও ছিল না। অথচ তিনিই সাড়ে তিন বছরের মধ্যে নতুন জার্মানীর ভিত তৈরি করলেন। এরপর আমেরিকার দৃষ্টান্ত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিয়েছিলেন ট্রুম্যান-কে। সবসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাধারণভাবে একজন অদক্ষ মানুষকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে বাছতেন; যাতে গ্ল্যামারে, ক্যারিশ্মায় প্রেসিডেন্টকে তিনি ছাপিয়ে যেতে না পারেন। রুজভেল্টের ক্যারিশ্মা ছিল, ট্রুম্যান তার ধারেকাছেও ছিলেন না। প্রবল জনপ্রিয় থাকা অবস্থাতেই মারা গেলেন রুজভেল্ট। আর ভাইস-প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট। আমেরিকার মানুষের দুঃখের শেষ রইলো না। সবাই ঠাট্টা-তামাশা করতেন। চলতি কথা ছিল, “ভুল কাজ মহিলারা করে, আর ভুলকাজ করেন ট্রুম্যান”। এই ট্রুম্যানের হাতেই আধুনিক আমেরিকা তৈরি হল। তিনি যেটা জানেন না জেনে নিয়ে, পড়াশোনা করে, শিখে সে দেশ চালাতে লাগলেন। ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা ছিল না তাঁর, কিন্তু How to become great-এ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন।

কার্যকর্তাকে হতে হবে যোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য, ক্যারিশ্মা না হলেও চলবে। সাংগঠনিক নেতার বা কার্যকর্তার ব্যক্তিগত স্তাবকতা বর্জন করতে হবে। দত্তপন্থের জীবনী ও কাজ অনুসরণ করলে আমরা তা বুঝতে সক্ষম হবো। সংগঠনে ব্যক্তিপুজো সার্বিকভাবে বন্ধ হলে সংগঠন ডগমগে যৌবন নিয়ে বেড়ে ওঠা পুঁইমাচার মতোই হবে। প্রাণোচ্ছল সংগঠন চাই, মানুষের জন্য যথাযথ কাজ করা চাই। ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের সমস্ত সদস্য ও কার্যকর্তার কাছে এই আবেদন জানিয়ে দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর জীবনচরিত পড়ার অনুরোধ রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.