সাম্প্রতিক দুটি রাজনৈতিক খবর দিয়ে শুরু করি l ভবানীপুরে পাঞ্জাবী মহাল্লায় কৃষি বিলকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করছে তৃণমূল l অথচ সামসেরগঞ্জ বা জঙ্গিপুরের মত গ্রামীণ কেন্দ্রে এই বিল গুরুত্ব পাচ্ছে না l কেন? তাহলে কি পাঞ্জাবের মত পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষ চাষের উপর নির্ভরশীল না? দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, কয়েকদিন আগে অমিত মিত্র একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, শিল্প ক্ষেত্রে মন্দার জন্য শ্রমিকদের ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’ চলছে, মানুষ আবার কৃষি ক্ষেত্রে ফিরে আসছেন l একদম সত্য কথা বলেছেন অমিত বাবু l কিন্তু এই ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’ কি আমাদের রাজ্যেও চলছে?গত দুই বছরে কত জন কর্মী দিল্লি, বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে এসেছেন গ্রামবাংলায় চাষ করতে l গ্রাম বাংলায় দামোদর, ময়ূরাক্ষী বা কংসাবতী সেচপ্রকল্প এলাকার বাইরে কত জমি চাষ না করে ফেলে রাখা তা নিয়ে কোন সমীক্ষা করেছেন ডঃ মিত্র? উত্তরবঙ্গের সব জেলা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দুই 24 পরগনা, হাওড়া এবং দুই মেদিনীপুরে কি অবস্থা জানেন? কেন কৃষিতে এই অনিচ্ছা? আমাদের পার্শবর্তী রাজ্য বিহার যেখানে গত 15 বছরে কৃষি রপ্তানি 800 গুন বাড়িয়েছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে চাষে অনীহা কেন? বামজামানায় টানা সাড়ে তিন দশক আমাদের দুই প্রেসিডেন্সিরত্ন তথা বিদেশ থেকে পিএইচডিপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রীদ্বয় বলে এসেছেন, কৃষিতে নাকি বাংলা প্রথম আর তাই বামফ্রন্টকে গ্রামের মানুষ ভোট দেয় l অথচ তাঁরাই চলে যাবার সময় বললেন, চাষে আয় নেই, শিল্প প্রয়োজন l অর্থাৎ এই অবস্থা তো আজ এক দিনে হয় নি? তাহলে কিসের এক নম্বর? রহস্যটা তাহলে কোথায়? কোথায় ভুল হল? নাকি শুধু ভুল নয়? এক বড় ষড়যন্ত গ্রামবাংলার কৃষিঅর্থনীতির শিরদাড়া ভেঙে দিয়েছে? যখন ভারত বিশ্বের বাজার ধরার জন্য দৌড়াচ্ছে, যখন ত্রিপুরার মত রাজ্য আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যর বাজারে তাঁদের আনারস, কাঁঠাল পাঠাচ্ছে, তখন বর্গায় পাওয়া বিনে পয়সার জমি কেন ফেলে রাখছে বাংলার চাষী? চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের তথ্য বলছে ভারতের কৃষি রপ্তানি গত বছরের এই সময়ের 44.3% বেড়েছে l আগেই বললাম, বিহারে গত 15 বছরে কৃষি রপ্তানি 800 গুন বেড়েছে l তাহলে কেন জমি বেচে দিচ্ছে দক্ষিণ 24 পরগনার চাষীরা, যারা এবারও তাদের 100% রাজ্যর ক্ষমতাসীন দলকে দিয়েছে? যারা গত তের বছর তৃণমূল কংগ্রেসকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে আসছে? দেখা যাক গত 49 বছরের মূর্খতা ও ধুর্ততার ইতিহাস l
আজ থেকে 49 বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার শুরু হয় l 1972 l প্রথম পাঁচ বছর প্রশাসন এই জমি বন্টনের কাজ করে l তারপরের 34 বছর রাজনৈতিকভাবে l নাম হয় আপরেশন বর্গা l আটের দশকে বামফ্রন্টের স্লোগান ছিল “বুর্জোয়ার পতন, প্রলিটারিয়েতের জয়লাভ, দুইই সমান অনিবার্য —কাল মার্ক্স ” l আর জমির মালিক বাঙালী হিন্দুরা ছিলেন অপরেশন বর্গার অন্যতম টার্গেট ‘বুর্জোয়া’ l যদিও এই দাবী প্রথম করেছিলেন, কৃষকপ্রজা পার্টির নেতা তথা অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক l 1929 এ ( আমাদের ইতিহাস বই যদিও এই অংশ বাদ রেখেছে )l এর আট বছর পর উনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন, যা আমাদের ইতিহাস বই থেকে সযত্নে বাদ রাখা হয় l কিন্তু মনবসনা পূরণ করতে ব্যর্থ হন l ফজলুল হক সাহেবের দাবী ছিল হিন্দু জমিদারদের জমি কেড়ে নেয়া হবে, কিন্তু কোন ক্ষতিপূরণ বা মূল্য দেবে না ব্রিটিশ সরকার l দেশভাগের ত্রিশ বছর পর তাঁর সেই স্বপ্ন পুরণে এগিয়ে এলেন জ্যোতি বসু, অশোক মিত্ররা l হিন্দু বাঙালীদের জমি কেড়ে নেয়া শুরু হল l সঙ্গে শুরু হল অত্যাচার l যাতে গ্রামের ভূমিহারারা কলকাতা শহরের অসামাজিক ক্ষমতাবান হিন্দুসমাজের সমর্থন না পায়, তাই শুরু হল গননাট্য সঙ্ঘ থেকে বিভিন্ন গ্রূপের থিয়েটার, নাটক ও সিনেমা এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ l সঙ্গে বন্ধ করা শুরু হল বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন মনসা পূজা ইত্যাদি l ‘অমানুষ’ থেকে ‘শত্রু’ ইত্যাদি বিভিন্ন চলচ্চিত্র মানুষকে বোঝানো শুরু করলো যে ‘মহিম ঘোষাল’ বা ‘নিশিকান্ত সাহা’রাই সমাজের মূল শ্রেণী’শত্রু’l জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকল বামফ্রন্টের l গ্রামে দাঁত ফোটাতে পারলো না বিরোধী কংগ্রেস l হয়তো তাদের হাইকমান্ড চায় নি দাঁত ফোটাতে l দ্রুত পরিবর্তন হওয়া শুরু হল গ্রামের জনবিন্যাস l এর উপর সরকারি শিক্ষা ব্যাবস্থায় অনাচার, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় অবনতি, পার্টির সমান্তরাল ক্ষমতা প্রশাসন ও বিচার ব্যাবস্থা এই জনবিন্যাস পরিবর্তন করল দ্রুততর l
এদিকে বর্গাদারদের লাভের গুড় খেয়ে গেল সরকারী অকর্মণ্যতা এবং মার্ক্সবাদী দলের ক্যাডাররা l সঙ্গে বামফ্রন্টের বিভিন্ন দলের সম্পর্কের অন্তর্বর্তী রসায়ন l আরএসপি পেল সেচ এবং পূর্ত দপ্তর l এই খানে মনে রাখতে হবে, আরএসপির জন্ম কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতি l ত্রিশের দশকে তৎকালীন লেবার পার্টির ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ৱ্যামসে ম্যাকডোনাল্ড আমাদের দেশের জেলে ভারতীয় বিপ্লবীদের কমিউনিস্ট মন্ত্রে দীক্ষিত শুরু করলে, অনুশীলন সমিতির একটা অংশ কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেন রাজপূতনার একটা জেলে এবং তার নাম হয় আরএসপি l ফলে চীনপন্থী সিপিএম এর সঙ্গে এঁদের সংঘাত প্রথম থেকেই এবং সেটি জিনগত l যে সেচ দফতর সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সময়ে গণিখান চৌধুরীকে দেয়া হয়েছিল এবং বাজেটের একটা বড় অংশ যে দপ্তরে দেয়া হত, সেই দপ্তরের বরাদ্দ হঠাৎ কমিয়ে দেয়া হল 1977 এর পর l মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল তিস্তা, কংসাবতী সেচপ্রকল্প l শুরুই করা গেল না সুবর্ণরেখা, কেলেঘাই কপালশ্বরী, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান, দারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরী, সিদ্বেশ্বরী-নুনবিলের মত সেচ প্রকল্প l যে ফারাক্কার জন্য ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইন ভাঙতে পিছপা হয় নি, সেই ফারাক্কার জল আজও পেল না মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং দুই 24 পরগনা l যে তিস্তার জন্য আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে কেন্দ্র, সেই তিস্তার জল পেলনা কোচবিহার, দুই দিনাজপুর বা মালদা l
এমতাবস্থায়, বাম নেতারা গ্রামের মানুষকে বিদ্যুৎ চুরি করে যথেচ্ছ ভূগর্ভস্থ জল তুলে সেচের অনুমতি দিল, নিজেদের সেচের ব্যর্থতা ঢাকতে l পানীয় জলে আর্সেনিক, ফ্লোরিন উঠা শুরু হল l বাড়তে থাকলো বিদ্যুতের দাম l এরমধ্যে আরও এক সমস্যা শুরু হল l 2009 তে হারার পর বামফ্রন্ট সরকার নতুন করে সিদ্ধেশ্বরী-নুনবিল, দ্বারেকেশ্বর গন্ধেশ্বরী, সুবর্ণারেখা, তিস্তা নিয়ে ভাবা শুরু করলো l কিছু প্রকল্প হয় পাশ হল না, নয় শেষ হল না l তিস্তা ও আইলাতে 90% টাকা দেবার ঘোষণা করল কেন্দ্র l কিন্তু পরিবর্তন হল সরকার এবং 2011 তে এলো তৃণমূল কংগ্রেস l এবার জমি জটে আটকে গেল কেন্দ্রের অনুদানপ্রাপ্ত সব প্রকল্প l আইলার অধিকাংশ টাকা ফিরে গেল l যখন আবার আম্ফান এলো, নোনা জলে সুন্দরবনের জমির উর্বরতা গেল নষ্ট হয়ে l অথচ সরকার যদি কিছু জমি অধিগ্রহণ করে এই প্রকল্প করতো, আজ অম্ফানের পর গোসাবা, বাসন্তীর মানুষ ভিটে মাটি ছেড়ে, জমি বেচে কলকাতার দিকে যেত না l যেই মুর্শিদাবাদ সেচের জলের অভাবে সারা দেশে পরিযায়ী শ্রমিক পাঠায়, সে জানেই না তাকে সেচের জল দেবার জন্য ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে ফারাক্কা বানিয়েছিল l যেখানে সুবর্ণরেখা ব্যারেজ বানানোর কথা সেখানে রাজ্য সরকার বানিয়ে বসে আছে একটা ব্রিজ l জমি জটে আটকে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান l আর কতদিন এঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে? কেন এঁদের মা বোনেরা লক্ষ্মী ভান্ডারের জন্য লাইনে দাড়াবে? মেদিনীপুরের তো অধিকাংশ মেয়ে স্নাতক কিম্বা স্নাতকোত্তর? কেন তারা সমাজ তাদের শিক্ষিকার সন্মান দিয়ে মাথায় তুলবে না?
আরেকটা বড় কারণ যা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষকে কৃষিবিমুখ করছে সেটি হল, কৃষি বিপণনে দুর্নীতি এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি বাবুদের অসাধু যোগসূত্র l অত্যাবশ্যক পণ্য আইন এবং কৃষি বিপণন আইনের গেরোয় উদ্ভুত প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা গ্রামের বাঙালীর ছিল না l তাঁরা হিমঘর এবং গুদাম বিক্রি করে তাঁদের জীবিকা পরিবর্তন করে l পরবর্তীকালে গুটিকতক অসৎ মধ্যসত্ত্বভোগীর হতে চলে যায় কৃষকদের ভাগ্য l চাষীরা তাদের পণ্যের দাম থেকে বঞ্চিত হাতে শুরু করে l 2013 তে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার চাষীদের সুবিধার্থে খুচরো বাবাসায় প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের বিল আনলে, তৎকালীন রাজ্যের শাসক তৃণমূল তা প্রত্যাখ্যান করে এবং কেন্দ্র সরকার থেকে বেরিয়ে আসে l 2020 তে বর্তমান সরকার কৃষি বিপণনে আরও বড় সংস্কার আনেন উপরোক্ত বিলের পারিবর্তন করে তিনটি বিল এনে, যেখানে চাষীর কাছে বিদেশের বাজার পর্যন্ত খুলে যায় l কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজ্য আবার বিরোধীতা করে l ফলে, বাংলার চাষীর কাছে সেই কতিপয় মধ্যসত্ত্বভোগী ছাড়া আর কোথাও যাবার রাস্তা নেই l খোলা বাজার না পেলে কেন একজন চাষী চাষ করবে?
অপেরেশন বর্গা, ভুল অর্থনীতি, জনমোহিনী রাজনীতি, বদ্ধ কৃষিবাজার এবং বর্তমান সরকারের জমিনীতির চাপে আজ মৃত্যুমুখে গ্রামবাংলার অর্থনীতি l পরিস্থিতির যত অবনতি হচ্ছে, সরকার ততই ত্রাণ দিচ্ছে l কিন্তু পরিত্রান কিভাবে? যে মানুষ বিনা পয়সায় জমি পেয়ে নিজেকে জয়ী ভেবেছিল একদিন, কেন সে আজ দিল্লি মুম্বাইতে কনস্ট্রাকশন প্রকল্পে অতি কম বেতনে রক্ত ঝড়াচ্ছে? আর কত দিন গ্রামবাংলার মানুষ এই পরিকল্পনাহীন ডোল রাজনীতি বলি হবে?
পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব l দুজনেই দেশভাগের বলি l পাঞ্জাবে আগে সেচ এবং কৃষি পরিকল্পনা শুরু করি আমরা l সবুজ বিপ্লবের দশ বছর আগে আমাদের রাজ্য দামোদর এবং ময়ূরাক্ষী প্রকল্প শেষ করে বসে আছে l কিন্তু তারপরে এতো অধঃপতন? নগরবাসী প্রবাসী পাঞ্জাবীদের জীবনে যদি কৃষি প্রভাব ফেলতে পারে, তবে গ্রাম বাংলা কেন কৃষিতে উদাসীন?
সুদীপ্ত গুহ