কথায় বলে “যেমন মা তার তেমন ছা”; আর মায়ের গুণ আছে এমন চারা তৈরি হবে অঙ্গজ পদ্ধতিতে, বীজ থেকে নয়। আগেকার দিনে পেয়ারার চারা তৈরি হত বীজের মাধ্যমে। বীজের চারা বড় হয়ে যে ফল দেয় তার আকার, পরিমাপ, ওজন এবং উৎকর্ষতায় নানান বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। তার শাঁসের প্রকৃতি, গন্ধ, বীজের প্রাচুর্য, গাছের আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যও আলাদা রকমের। পক্ষান্তরে কলমের তৈরি চারার গাছে একটি সমতা লক্ষ্য করা যায়। এই গাছে ফল আগে আসে, গাছের শৈশবকাল ছোটো। তাই কলমের চারা তৈরি করে অর্থকরী পেয়ারা চাষ করতে হবে।
সম্প্রতি পেয়ারায় ফর্কেট মেথডে প্যাচ বাডিং বা ছাল-কলম , স্টুলিং বা দাবা কলম এবং এয়ার লেয়ারিং বা গুটি কলমের ব্যবহার বেশি। এরজন্য এলা গাছ তৈরি করতে জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হয় কলমে তৈরি উপযুক্ত গাছ থেকে। পাকা ফলের বীজ শাঁস থেকে আলাদা করে নিয়ে, তারপর তা শোধন করে বীজতলায় বুনতে হবে, যাতে চারা ড্যাম্পিং অফ রোগে কাবু করতে না পারে। চারার উচ্চতা ২-৩ ইঞ্চি হলে তাকে পলিব্যাগে স্থানান্তরিত করা হয় এবং পরে তা কলি কলম বা জোড় কলমের উপযুক্ত হয়। ৮ -১২ মাসের মধ্যে চারা কলম করার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
কলি কলম
কলি কলম নানাভাবে করা গেলেও প্যাচ বাডিং বা তাপ্পি কলম করে পেয়ারার চারা তৈরি হয়। এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী এবং সুফল বলে বিবেচিত হয়েছে; সাফল্যের হারও অধিক। সাফল্য নির্ভর করে এলাগাছ ও পরশাখী বা পর-কলির উপর। চারাগাছের বয়স হতে হবে এক বছর, তা নিতে হবে সুষম এবং গাছের কার্যকরী বৃদ্ধি দশায়। এলাগাছের কাণ্ড পেনসিলের চাইতে বেশি পুরু হবে না।
সবচাইতে ভালো হয় যদি এলাগাছের কাণ্ডের ব্যাস ১.২৫-২.৫ সেন্টিমিটার হয়। যে গাছ থেকে পরশাখী বা পর-কলি নিতে হবে তার সবজে-উজ্জ্বলতা থাকতে হবে, হতে হবে রসালো, যেন কাণ্ড থেকে কলি সহজে পৃথক করা যায়। উপযুক্ত জাতের পরশাখীর একবছরের ডালের কক্ষ থেকে বেরোনো সুপ্তি দশায় থাকা স্ফীত কলি সংগ্রহ করতে হবে। প্যাচ বাডিং-এর জন্য ১x১.৫ সেমি মাপের ছাল-সমন্বিত তাপ্পি তুলে নিতে হবে। একই মাপের তাপ্পি তুলতে হবে এলাগাছের উপযুক্ত অংশ থেকে এবং সেখানেই স্থাপন করে দিতে হবে সংগৃহীত কলির তাপ্পি। মাটি থেকে ১৫ সেমি উঁচুতে কলি কলম করা দরকার।
পলিথিন ফিতে জড়িয়ে কলির সঙ্গে এলাগাছের কাণ্ড জুড়ে দিতে হবে। কলির সঙ্গে কাষ্ঠল অংশ খাপে খাপে জুড়ে গেলেই কলম সফল বলা যায়। কলম করার দু’তিন সপ্তাহ পরে বাঁধন খুলে দিতে হবে। যাতে কলি দ্রুত জুড়ে যায়, তারজন্য এলাগাছের এক তৃতীয়াংশ শাখা প্রথমে কেটে দিতে হবে। বাকী এলাগাছের বিটপ কাটা হবে তার তিন সপ্তাহ বাদে। কেবল কলি কলমের উপর মাত্র ২-৩ সেমি কাণ্ডল অংশ অবশিষ্ট থাকবে। এই কলম করার উপযুক্ত সময় হল মে-জুন-জুলাই মাস।
দাবা কলম
দাবা কলম বা স্টুলিং হচ্ছে পেয়ারার সবচাইতে সহজ ও কম খরচের কলম পদ্ধতি। তাড়াতাড়ি চারা বাড়াতে, ভালো জাতে এবং এলাগাছে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে শেকড় যুক্ত কাটা কলম বা গুটি কলমের চারা স্টুলিং বেডে বা দাবা-কেয়ারিতে ০.৫ মিটার দূরত্বে রোপণ করা হয়। তিন বছর পর্যন্ত তা কেয়ারিতে থাকে। তারপর তার মাথাটি মার্চ মাস নাগাদ মাটির কাছ ঘেঁষে ছেঁটে দেওয়া হয়। ছাঁটা গাছের গাদায় বেশ কিছু নতুন বিটপ বেরিয়ে আসে। মে মাস নাগাদ এই বিটপীয় অংশের গোড়ার ৩.০ সেমি মাপের একটি গোলাকার ছাল অংশ তুলে নিতে হবে এবং ছালের নিচে থাকা ক্যাম্বিয়াম অংশটিও চেঁছে তুলে দিতে হবে।
এর পর মাটি গাছের গোড়ায় ৩০ সেমি পর্যন্ত চাপাতে হবে যা সয়েল-মাল্চ রূপে মাটিতে আর্দ্রতা বাড়াবে। এর দুমাস বাদে বর্ষার সময়,যখন শেকড় তৈরি হয়ে যায়, তখন মা-গাছ থেকে শিশু চারাগাছগুলিকে পৃথক করে দিতে হবে। এজন্য গোলাকার রিং-এর নিচে কাটা হবে। এর বিটপীয় অংশ পুনরায় কেটে তার শেকড়-বিটপ ভারসাম্য আনতে হবে এবং তারপরই তা আলাদা হয়ে নার্সারীতে লাগানোর উপযুক্ত হবে। মা-গাছকে সে বছরই দ্বিতীয় বারের জন্য দাবা-কলমের কাজে ব্যবহার করা যায় এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তা শুরু করতে হবে। শেকড়-গজানো বিটপগুলিকে মা গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। একই মা-গাছকে স্টুলিং -এর জন্য বছরের পর বছর কাজে লাগানো যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে প্রাপ্ত চারার সংখ্যা বাড়ে। বীজের চারার চাইতেও দাবা-কলমে প্রাপ্ত চারার জোর বেশি, বাড়বাড়ন্তও খুব হয়। এই কলমে শেকড় তৈরি হতে হর্মোন ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না।
গুটি কলম
পেয়ারার জন্য এই পদ্ধতি সবচাইতে জনপ্রিয়। জুলাই থেকে আগষ্ট মাস এই পদ্ধতিতে চারা তৈরির ভালো সময়। ১.২ সেমি মাপের ব্যাস-বিশিষ্ট শাখা নির্বাচন করে তার ২ সেমি পরিমাণ ছাল তুলে ফেলা হয়। ছাল-তোলা অংশ জড়িয়ে দিতে হয় ভেজা মাটি বা স্ফ্যাগনাম মসের দলা দিয়ে (যার মাপ হবে ৭ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট, ১০-১৩ সেমি লম্বা)। এটি আবার জড়িয়ে দিতে হয় পলিথিন চাদর দিয়ে হাল্কা করে যাতে ভেতরের আর্দ্রতা বজায় থাকে। তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে কলমে শেকড় গজিয়ে যায়। যখন সেই শেকড় পুরো বলটা জুড়ে ছড়িয়ে যায়, তা মাতৃদেহের কাণ্ডল অংশ থেকে বিচ্যুত করা হয়। তারপর ছাড়ানো হয় তার পলিথিন চাদর, চারা বসানো হয় টব বা পলিব্যাগে রক্ষিত মাটিতে। ছায়ায় রেখে যত্ন নিতে হয় চারার, যতক্ষণ না পর্যন্ত নতুন পাতা ছাড়ছে। যখন নতুন বৃদ্ধি ১৫-২০ সেমি মাপের হয়, তখন তা মূল জমিতে লাগানো যায়।
তথ্যসূত্রঃ বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সি.আই. এস. এইচ, লক্ষ্নৌ।