বোরোধান: পৌষ মাস জুড়েই বোরোধান রোয়া চলবে। বোরোধানের উচ্চ ফলনশীল জাতগুলি হল হেক্টরে চার থেকে সাড়ে চার টন ফলনদায়ী লম্বা-সরু চালের শতাব্দী, ক্ষিতীশ, ললাট; চার টন ফলনের মাঝারি-সরু চালের পারিজাত; ছয় থেকে সাড়ে ছয় টন ফলনের লম্বা-সরু চালের সংকর জাত যেমন কে.আর. এইচ-২, প্রো অ্যাগ্রো ৬২০১ ইত্যাদি। সংকর জাতের জীবনকাল ১২৫ থেকে ১৩৫ দিন, তবে উচ্চ ফলনশীল জাতের ক্ষেত্রে ১১০ থেকে ১২৫ দিন। শুকনো জমিতে দু’বার চাষ দিয়ে, কয়েকদিন পতিত রেখে, রোদ খাইয়ে, ছিপছিপে জল ধরে, দু’তিন বার কাদা করে চাষ দিয়ে জমির আগাছা পচান দিয়ে, মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে। রোয়ার জন্য চার-পাঁচ পাতার এক মাসের চারা গুছিতে তিন-চারটি নিয়ে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি সারি দূরত্বে এবং ৬ ইঞ্চি চারা দূরত্বে বসাতে হবে। বাদামি শোষক পোকার আক্রমণ যেখানে বেশি সেখানে অন্তত বিশটি সারির পর এক সারি ফাঁক দেওয়া প্রয়োজন। রোয়া করার এক সপ্তাহের মধ্যেই চারার মৃত্যুর কারণে জমিতে ফাঁক হলে তা পূরণ করে নিতে হবে।
বোরো চাষে জমি তৈরির সময় প্রথমে একরে ১৫ থেকে ২০ কুইন্টাল জৈবসার এবং কাদা করা শেষ চাষের সময় ১২ কেজি নাইট্রোজেন, ২৪ কেজি করে ফসফেট ও পটাশ প্রয়োগ করতে হবে (এগুলি ইউরিয়া, সিঙ্গেল সুপার ফসফেট এবং মিউরিয়েট অফ পটাশের পরিমাণ আনার জন্য মোটামুটিভাবে ২.২, ৬.১ এবং ১.৬ দিয়ে গুণ করে নিতে হবে)। সংকর জাতের জন্য এই মাত্রা হবে যথাক্রমে ১৫, ৩০ এবং ৩০ কেজি। জিঙ্কের অভাবজনিত এলাকায় মূলসারের সঙ্গে একর প্রতি ১০ কেজি জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগ করা দরকার।
পৌষ মাসে তাপমাত্রা খুব নেমে যায়। এতে ধানচারার শারীরবৃত্তিয় কর্মে বিশেষ প্রভাব পড়ে, বৃদ্ধির হার কমে যায়; চারা তৈরি জন্য নির্ধারিত সময় তাই বেশি লাগে। এজন্য বোরোধানের বীজতলায় পরিচর্যার অঙ্গ হিসাবে বিকেলে জল ঢুকিয়ে, ভোরে বীজতলার দু’পাশে দাঁড়িয়ে দড়ি টেনে পাতার ডগায় জমে থাকা শিশির ফেলে দিয়ে সেই জল বের করে দিতে হবে। দেখা গেছে এতে সূর্যালোকে শারীরবৃত্তিয় কার্যের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়; বীজতলার চারাও তুলনামূলক তাড়াতাড়ি মূল জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়ে ওঠে।
গম : সেচ সেবিত এলাকার জন্য অধিক নাবি জাতের গম বোনার সময় মিলবে পৌষের তৃতীয় সপ্তাহ। যদিও নাবিতে বুনলে গমের ফলন কমে যায়; দৈনিক ১৩ কেজি করে বা তারও বেশি ফলন কম হতে পারে।
অধিক নাবি জাতগুলি হচ্ছে ডি বি ডব্লু ১৪, এন ডব্লু ১০১৪, এইচ আই ১৫৬৩; যাদের হেক্টর প্রতি ফলন দেড় থেকে দু’ হাজার কেজি, যেখানে সঠিক সময়ে (১২ থেকে ১৮ নভেম্বর) লাগিয়ে ফলন পাওয়া যায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কেজি। এক্ষেত্রে জমিতে হেক্টর প্রতি ৪০ কেজি নাইট্রোজেন, ৬০ কেজি ফসফেট এবং ৪০ কেজি পটাশ দিতে হবে মূল সার হিসাবে। শোধনের জন্য প্রতি কেজি বীজে আড়াই গ্রাম কার্বেন্ডাজিম মেশালে গোড়াপচা ধ্বসা এবং ভূষা রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। হেক্টর প্রতি বীজ লাগবে সোওয়া শ’ কেজি; ১৮ সেমি সারি দূরত্বে এবং ৪-৫ সেমি গভীরতায় বীজ বুনতে হবে।
সঠিক সময়ে বোনা গমে এ মাসেই অধিক পাশকাঠি বের হয়, তাই বীজ বপনের ৪০ থেকে ৪২ দিনের মাথায় দ্বিতীয় দফায় সেচ দেওয়া দরকার। সেই সময় জমিতে দিতে হবে দ্বিতীয় দফার চাপান সার (হেক্টরে ৫০ কেজি নাইট্রোজেন); তার আগে জমির আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নাবিতে বোনা গমে (১০-১৬ ডিসেম্বর বোনা গম) মুকুট শিকড় বের হবে এই মাসে, বীজ বেরোনোর ২০-২২ দিনের মাথায়। প্রথম সেচ তখন অবশ্যই প্রয়োজন হবে; করতে হবে আগাছা দমন এবং দিতে হবে প্রথম দফার চাপান সার (হেক্টরে ৪০ কেজি নাইট্রোজেন)
আলু: পৌষের একেবারে প্রথমেই নাবি আলু বসানোর কাজ শেষ হয়ে যায়। মূল সার হিসাবে বিঘাতে ২৯ কেজি ইউরিয়া, ১২৫ কেজি ফসফেট আর ৩৩ কেজি পটাশ লাগে। জীবাণু সার পি.এস.বি এবং অ্যাজোটোব্যাকটর তিন’শ গ্রাম হারে দেওয়া ভাল। আলু লাগাতে বিঘা প্রতি আড়াই থেকে তিন কুইন্টাল বীজ দরকার হয়; এই বীজ ০.২৫ শতাংশ ম্যানকোজেব দ্রবণে কয়েক মিনিট ভিজিয়ে শোধন করে নিতে হবে। চাষ করা সমতল জমিতে ৬০ সেমি দূরত্বে নালা কেটে তাতে ২০ সেমি দূরত্বে নির্দিষ্ট গভীরতায় বীজ বুনতে হবে। বীজ আলুর চোখ নালার পাশে মুখ করে রাখলে তাতে বেশি কান্ড আর শিকড় বের হয়।
সঠিক সময়ে লাগানো আলুতে (কার্তিকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষে) এ মাসের শুরুতে (বীজ লাগানোর ২৫-৩০ দিন পর) প্রথম বার এবং শেষার্ধে দ্বিতীয় বার (৪৫-৫০ দিন পরে) গাছের গোড়ার মাটি তুলে ভেলি করে দিতে হবে। প্রথম বার মাটি দেবার আগে বিঘায় ২৯ কেজি হারে ইউরিয়া চাপান দিতে হয়। প্রথম ভেলি তোলার পর সপ্তাহে একবার এবং দ্বিতীয় ভেলি তোলার পর দশদিন অন্তর সেচের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
আলুতে পৌষ মাস থেকে জাব পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পৌষের শেষে আক্রমণের প্রবণতা বাড়ে। জাব পোকা কুটে রোগ ছড়ায়। অন্তর্বাহী কীটনাশক প্রয়োগে জাব পোকা দমন করা যায়। এই মাসেই আলুতে জলদি ও নাবি ধ্বসা রোগ লাগে। চারার বয়স ১৫-২০ সেমি হলেই ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হবে। জলদি ধ্বসার জন্য তিন’শ লিটার জলে এক কেজি ডায়থেন জেড-৭৮ এবং নাবি ধ্বসার জন্য এক লিটার রিডোমিল গুলে এক একর আলুতে প্রয়োগ করতে হবে। আলুতে এই সময় (লাগানোর ৫০ দিন পর) কাটুই পোকা ও ঘুরঘুরে পোকার জন্য নজর দেওয়া প্রয়োজন। পোকা দমন করতে লিটার প্রতি দেড় মিলি ক্লোরোপাইরিফস অথবা মিথাইল ডেমিটন বা মেটাসিসটক্স প্রয়োগ করতে হবে।
সরষে:
পৌষ মাসে সরষের জাবপোকা ও ধ্বসা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এসময় ঠান্ডার মাঝে সহসা গরম পড়লে এবং বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বাড়লে এই সমস্যা বাড়ে। প্রথমাবস্থায় জাবপোকা দমনের জন্য নিমঘটিত কীটনাশকে কাজ হলেও (অ্যাজাডিরেকটিন ১৫০০ পিপিএম প্রতি লিটার জলে ৩ মিলি অথবা অ্যাজাডিরেকটিন ১০,০০০ পিপিএম ১.৫ মিলি অথবা অ্যাজাডিরেকটিন ৫০,০০০ পিপিএম ১ মিলি গুলে স্প্রে করতে হবে) জাবপোকার মাত্রাতিরিক্ত আক্রমণের মোকাবিলায় ইমিডাক্লোপ্রিড ১৭.৮ এস এল প্রয়োগ করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় (প্রতি ১০ লিটারে ৩ মিলি)। সরষের ধ্বসা রোগের জন্য প্রতি লিটার জলে আড়াই গ্রাম হারে ম্যানকোজেব ৬৪ শতাংশ বা মেটাল্যাক্সিল ৮ শতাংশ স্প্রে করতে হবে।
ডালশস্য: সাধারণভাবে বিনা সেচে ডাল চাষ হলেও গাছের বৃদ্ধি ঠিকঠাক না হলে মুসুর, ছোলা, খেসারি, মটর ইত্যাদি ডালশস্যে এই মাসে ফুলের কুঁড়ি আসার সময় এবং দানা ধরার সময় হালকা সেচ দেওয়া উচিত। ডালের রোগ-পোকার জন্যও নজর রাখতে হবে।
ফুলচাষ: পৌষ মাসের মাঝামাঝি ফুলদায়ী গোলাপে গাছ প্রতি একশ’ গ্রাম খোল এবং ৫০ গ্রাম হাড় ও শিং-এর গুড়ো দেওয়া দরকার। যারা নতুন গাছ বসাবেন তারা জাত ভেদে এবং পরিচর্যা ভেদে এই সময় ৬০x৬০ সেমি/৬০x৩০ সেমি/৪০x৩০ সেমি দূরত্বে গাছ লাগান।
বেল-জুঁই গাছে পৌষ মাসের শেষাশেষি ডাল ছাঁটাই করা দরকার। বেলের গাছ ৩০ সেমি এবং জুঁই গাছ ৪০-৫০ সেমি উপরে ছাঁটাই করতে হবে। গাছে পার্শ্বমুখী ডাল বেশি রেখে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ছাঁটাই পর্বের পর চাপান সার দিতে হবে; প্রতি হেক্টরে ৫০ টন জৈব সার, নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ লাগবে যথাক্রমে ১৫০, ২০০ এবং ১৫০ কেজি। আগাছা দূরীকরণ করতে হবে আর ১২ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।
ফলবাগিচা: পৌষের প্রথম সপ্তাহেও পেয়ারাতে ডাল বেঁকানো ও টানা দেওয়ার কাজ চলতে পারে, যার ফল পাকবে মে-জুন মাসে। এই সময় পেয়ারায় সাধারণভাবে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। এই মাস থেকেই কুলের ফল পাওয়ার শুরু।
এই মাসে পুরনো ও অনুৎপাদনশীল আম বাগানে ব্যাপক ছাঁটাই পর্ব শুরু করা যায়। গোড়া থেকে দু’-আড়াই মিটার উপরে এবং কান্ডের দু’-আড়াই মিটার বিস্তারে তিন-চারখানা প্রধান ডাল রেখে বাকি সব ডাল ছেঁটে দেওয়া হয়। কাটা অংশে অনতিবিলম্বে কপার ঘটিত ছত্রাকনাশকের লেই মাখিয়ে দিতে হবে।
সবজি: পুষ্টি বাগানের জন্য শীতকালীন সবজির মধ্যে টমেটো পৌষ মাসের প্রথমে তৃতীয় দফায় জন্য লাগানো যায়। নবীন, নিধি ইত্যাদি ভাল জাত। চারা লাগাতে হবে ৯০x৬০ সেমি দূরত্বে। এছাড়া সম-বিন্যস্ত সংকর জাত ৯০x৭৫ সেমি এবং অসম-বিন্যস্ত সংকর জাত ৯০x৯০ অথবা ৯০x৭৫ সেমি দূরত্বে লাগাতে হবে। বীজের হার হবে হেক্টরে ৪০০-৫০০ গ্রাম, সংকর জাতে ১২৫-১৭৫ গ্রাম।
লঙ্কা এই মাসে লাগানো যাবে। উচ্চ ফলনশীল জাতে হেক্টরে বীজ লাগবে ৫০০-৬০০ গ্রাম, সংকর জাতে ২৫০-৩০০ গ্রাম। বেঁটে ও মাঝারি জাতের দূরত্ব হবে ৪৫-৬০x৩০-৪৫ সেমি এবং সংকর জাতে ৭৫x৬০ সেমি।
শীতকালে চাষ করা যেসব গ্রীষ্মের সবজি আগে লাগানো যায় নি সেগুলি এ মাসে লাগানো যাবে। আর শীতকালীন সবজিতে জমির রস বুঝে এই সময় ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।
অল্প মূল্যের পলিথিনের ছাউনির মধ্যে অসময়ের ঢ্যাঁড়স (যেমন ‘সগুন’ জাত) লাগাতে হবে ৪০x২০ সেমি দূরত্বে।
পুষ্টি-বাগানে পৌষ মাসে ৬-৮ সপ্তাহ বয়সের ১২-১৫ সেমি লম্বা পেঁয়াজের চারা রুইতে পারা যায়। এমনকি চার-পাতাযুক্ত ৪-৬ সপ্তাহের বেগুন চারাও রোয়া যাবে।
সুন্দরবন অঞ্চলের জন্য আমন ধান তুলে মিষ্টি আলুর লতা বসানো যাবে। লতার দৈর্ঘ্য হবে ৮ ইঞ্চির ডগা বা ডগার নিচের অংশ। লতা ৬০x২০ সেমি দূরত্বে ২-৩ পর্ব মাটির নিচে রেখে লাগানো হয়। স্বাভাবিক সময়ে লাগানো মিষ্টি আলুর জন্য এইসময়ে চাপান সার দিয়ে (বিঘা প্রতি ৭.৫ কেজি ইউরিয়া) সারিতে মাটি তুলে দিতে হবে।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।